ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

৩৭১ কোটি টাকা আত্মসাত

অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় নিরাপদে জমির টেলিকম

এম এ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় নিরাপদে জমির টেলিকম

এম এ রহমান : বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় এখনো ধঁরাছোয়ার বাইরে জমির টেলিকম।

 

অথচ প্রাক্তন স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের দুই ছেলে নওশের জমির ও নওফেল জমিরের মালিকানাধীন ওই প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিটিসিএলের বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ প্রায় ৩৭১ কোটি টাকা। এমনকি বকেয়া রাজস্ব আদায়ে হাইকোর্টের নির্দেশনাও উপেক্ষিত হচ্ছে। দুদকের অনুসন্ধানে মিলেছে এমন তথ্য।

 

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, জমির টেলিকমের প্রতি এই টাকা আত্মসাতের অভিযোগ বেশ পুরনো। মূলত বিটিসিএলের আইন শাখার সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগশাজসে এসব টাকা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কথিত মামলার নামে সরকারি ওই টাকা লোপাট হয়েছে। অনুসন্ধানে বিটিসিএলের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগশাজসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন শুধু প্রমাণের অপেক্ষা।

 

বর্তমানে জমির টেলিকমের কাছে বিটিসিএলের পাওনার পরিমাণ ৩৭০ কোটি ২৪ লাখ ৫৭ হাজার ৮৪১ টাকা। প্রাক্তন স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের দুই ছেলে নওশের জমির ও নওফেল জমিরের মালিকানাধীন জমির টেলিকমের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

 

অনুসন্ধান আমলে নেওয়ার পর দুদক উপ-পরিচালক যতন কুমার রায়কে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি অবসরে গেলে দীর্ঘদিন অনুসন্ধান কাজে স্থবিরতা দেখা দেয়। এরপর উপ-পরিচালক আব্দুস ছাত্তার সরকারকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

 

অনুসন্ধানের স্বার্থে ওই কর্মকর্তা বিটিসিএলের এমডি বরাবর নথিপত্র তলব করে চিঠি দেয়। যেখানে আগামী ৩ মার্চের মধ্যে চাহিদাকৃত নথিপত্র পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুদকের একটি সূত্র বিষয়টি রাইজিংবিডিকে নিশ্চিত করেছে।

 

ওই চিঠিতে যেসব নথিপত্র তলব করা হয়েছে, তা হলো- জমির টেলিকম লিমিটেড কর্তৃক আরপিটেশন আবেদন ও রায়ের কপিসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ, জমির টেলিকমের অনুকূলে বিলের ছায়াকপি ও জমির টেলিকম শুরু থেকে হালনাগাদ ইনভয়েস, পরিশোধিত বিলের পরিমাণ এবং বকেয়ার পরিমাণসহ বিভিন্ন নথিপত্র চিঠিতে চাওয়া হয়েছে।

 

অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরসহ ২০টি দেশের ১০৬টি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের কাছে বিটিসিএলের পাওনা হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা পাওনা রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জমির টেলিকমের কাছে। যার কর্ণধার বিএনপি নেতা ও প্রাক্তন স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকারের ছেলে মো. নওফেল আরশাদ জমির।

 

যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি জমির টেলিকম মূলত ইউরোপের কল বাংলাদেশে পাঠায়। ২০১০ সালে জমির টেলিকম আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ নিয়ে ইউরোপ থেকে কল বাংলাদেশে আনার দায়িত্ব পায়। দায়িত্ব পাবার পরপরই নানা অজুহাতে অর্থ পরিশোধ না করে উল্টো বিটিসিএলের বিরুদ্ধে মামলা করে কালক্ষেপণ ও বকেয়া না দেওয়ার পাঁয়তারা করেছে জমির টেলিকম।

 

দুদক সূত্রে জানা যায়, জমির টেলিকমের সঙ্গে বৈদেশিক কল আদান-প্রদানের চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০০৭ সালের ১৬ জানুয়ারি। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বিল বকেয়া রাখার কারণে ২০১০ সালে জমির টেলিকমের সিগন্যাল লিংক বন্ধ করে দেয় বিটিসিএল। পরে জমির টেলিকমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। হাইকোর্ট আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনালে বিচার নিষ্পত্তি না পাওয়া পর্যন্ত জমির টেলিকমের সিগন্যাল লিংক চালু রাখার নির্দেশ দেন। এর পরে ২০১৩ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত জমির টেলিকম কোনো বিলই জমা দেয়নি। ফলে আগের ১১২ কোটি টাকা থেকে পাওনার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত পাওনার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৭০ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের ২০ মার্চ ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জমির টেলিকমের সিগন্যাল লিংক আবারও বন্ধ করে দেয় বিটিসিএল।

 

এরপর ওই বছরের ৬ মে এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে কেন জমির টেলিকমের সিগন্যালিং লিংক বিচ্ছিন্ন করা হয়, এ কারণে বিটিসিএলের এমডিসহ তিন জনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলের নিষ্পত্তি করে ১২ মে জমির টেলিকমের সিগন্যালিং লিংক সংযোগ দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ আদেশ স্থগিত চেয়ে বিটিসিএল আবেদন করলে ২০১৪ সালের ১৮ মে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে আবেদনটি শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। ওই বছরের ২৯ মে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের আদেশ জমির টেলিকমের সংযোগ বিচ্ছিন্নের আদেশ বহাল রাখা হয়।

 

এ বিষয়ে বিটিসিএলের পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোরশেদ আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জমির টেলিকমের কাছে বিটিসিএলের পাওনা ৩৭১ কোটি টাকা। পাওনা পরিশোধ না করার কারণে আদালতের নির্দেশে এখনো জমির টেলিকমের সংযোগ বন্ধ রয়েছে। আইন শাখা বিস্তারিত বলতে পারবে।’

 

অন্যদিকে বিটিসিএলের একটি সূত্র আরো জানায়, জমির টেলিকমের মতো অন্যান্য আন্তর্জাতিক কোম্পানিও টাকা পরিশোধ না করার কৌশল হিসেবে বিভিন্ন মামলা করে। আদালতের নির্দেশে অনেকে টেলিকম কোম্পানির সংযোগ বন্ধ রয়েছে। আন্তর্জাতিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হোম অ্যান্ড ফোন ইনকরপোরেশনের কাছে পাওনা ৮ কোটি ৮২ লাখ, সিঙ্গাপুরভিত্তিক ম্যাক্সওয়েল পাওয়ার সার্ভিস ও আইপাওয়ারের কাছে পাওনা যথাক্রমে ৮ কোটি ৮২ লাখ ও ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ম্যাক্সটেলের কাছে ৮ কোটি ২০ লাখ, মোবিলিংকের কাছে ৪ কোটি ৬৫ লাখ ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক টেলকোটেক কোম্পানির কাছে ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে বিটিসিএলের। এরকম দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ক্যারিয়ারের কাছে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।

 

**

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/এম এ রহমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়