ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ধীরে চলো নীতিতে বিএনপি

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩০, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ধীরে চলো নীতিতে বিএনপি

এস কে রেজা পারভ্জে : দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায় নিয়ে আপাতত কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে না বিএনপি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার এটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে- এ বিষয়টিকে প্রধান‌্য দিয়ে ধীরে চলো নীতিতে থাকছে দলটি। এজন‌্য রায় পরবর্তী পরিস্থিতি এবং কর্মকৌশল নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠক করতে যাচ্ছেন দলটির নেত্রী খালেদা জিয়া।

শনিবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির সঙ্গে বৈঠকের মাধ‌্যমে তা শুরু করেছেন তিনি। রোববার রাতে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের নিয়েও বসছেন বিএনপি প্রধান। শিগগিরই বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং খালেদা জিয়ার পরামর্শক হিসেবে যারা পরিচিতি তাদের নিয়েও বসবেন তিনি। বৈঠক হবে দলের নির্বাহী কমিটির সদস‌্যদের নিয়েও। সার্বিক বিষয়ে মতামত গ্রহণ এবং পর্যবেক্ষন শেষে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন খালেদা জিয়া।

দলীয় সূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে বিএনপি এতোদিন যা ভেবে আসছে তার পুরোপুরি বিপরীত ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা। সরকার খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে বড় ধরনের ‘ষড়যন্ত্র করছে’ আশঙ্কা করে এ নিয়ে ধীরে চলো নীতিতে চলতে চাইছে দলটি। বিএনপির নীতি নির্ধারকরা তাদের দেওয়া বক্তব‌্যে হার্ডলাইনে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেও দলটি শেষ পর্যন্ত কি ধরনের কৌশল নেবে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করতে চাইছেন বিএনপি নেত্রী। অতীতের দু’দফা সরকার পতনের আন্দোলনের মতো কোনো সিদ্ধান্তে এবার যাচ্ছে না দলটি।   

আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের মামলার রায় ঘোষণা করবেন ঢাকার পঞ্চম জজ আদালত। জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালে দায়ের করা আলোচিত মামলায় দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান রায়ের দিন আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি ঠিক করেন।

অভিযোগ প্রমাণিত হলে এ মামলায় খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানও এ মামলার আসামি। মুদ্রা পাচারের দায়ে সাত বছর কারাদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে পালিয়ে আছেন দেশের বাইরে। এ মামলাতেও তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

যদিও খালেদার আইনজীবী রেজাক খান বলেছেন, ‘এটি একটি অসার মামলা। খালেদা জিয়া খালাস পাবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। আসামিপক্ষের অধিকাংশ যুক্তিও খণ্ডন করতে পারেনি।’

রায় পরবর্তী বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে আলোচনার জন‌্য শনিবার রাতে দলের নীতি নির্ধারকদের নিয়ে বৈঠক করেছেন খালেদা জিয়া। বৈঠকে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব‌্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব‌্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ড. আবদুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। সেখানে রায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সূত্র বলছে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ব‌্যারিস্টার মওদুদ আহমদ রায় নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। রায় নেতিবাচক কিছু হলে উচ্চ আদালতের আপিল এবং নির্বাচনের যোগ‌্য-অযোগ‌্য হওয়ার বিষয়ে ব‌্যাখ‌্যা দিয়েছেন। আইনগত দিকের সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টিকে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকে বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও নির্বাহী কমিটি সদস‌্যদের এবং শরিকদের মতামত নেওয়ার পরামর্শও এসেছে। এসব বিষয়ের পর ফের দলের নীতি নির্ধারকদের নিয়ে বসবেন খালেদা জিয়া।

জানতে চাইলে বিএনপির নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের একজন নেতা রাইজিংবিডিকে জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণের পরই কার্যত বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে সরকার কি করতে চাইছে। আমরাও বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করছি। ম‌্যাডামের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আরো হবে। সবার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করে সবার মতামত নিতে চাইছেন ম‌্যাডাম। সেহেতু এখনই বলা যাচ্ছে না বিএনপি কি ধরনের কর্মকৌশল নিয়ে এগোবে। অনেক ধরনের কথাই এসেছে। তবে এ নিয়ে আরো চিন্তা ভাবনার সুযোগ রয়েছে। কারণ হঠাৎ করেই কঠোর কোনো কর্মসূচিতে যাওয়া যাবে না।

‘আমরা আরো পরামর্শ নিতে চাইছি। আগামী নির্বাচন, দলের সাংগঠনিক অবস্থা, রায় পরবর্তী আইনগত কৌশল, মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মনোবল যাতে স্থির থাকে এসব সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। সেহেতু বিএনপি সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্তই এবার নেবে’, বলেন তিনি।

বৈঠক শেষে রাতেই সংবাদ সম্মেলনে এসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের বিষয়টিকে ‘সরকারি ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করেছে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি। এর বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সোচ্চার হবার আহ্বান জানান তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গোটা জাতি আজকে উদ্বিগ্ন, ক্ষুব্ধ ও ক্রদ্ধ। আমরা মনে করি, এটা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ধবংস করবার জন্যে এবং সকলের অংশগ্রহণে ইনক্লুসিভ ইলেকশন নষ্ট করার জন্য একটা গভীর ষড়যন্ত্র।’

ফখরুল আরো বলেন, ‘বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি আজকের সভা থেকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ কয়েকজন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে মিথ্যা, বানোয়াট ও রাজনৈতিক ‍উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলা দিয়ে সরকারের নিয়মনীতির বিরুদ্ধ আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ ব্যাপারে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে বিচারের নামে সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার আহবান জানাচ্ছে।’

কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে কিনা প্রশ্ন করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এটা জানাবো রায় ঘোষণা হওয়ার পরে। পুরো বিষয়টা আমরা আবার জানাবো রায় ঘোষণা হলেই।’

সূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায় নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ বা আচরণ কোন দিকে যায় তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষনে রাখছেন বিএনপি নেতারা। নির্বাচনের আগে কোনো উস্কানিতে সরকারের ফাঁদে পা না দিতে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত কোনো ধরনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ যাচ্ছে ইউনিটপ্রধানদের কাছে।

তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এবং বিএনপি নেতারা মনে করছেন, মামলার যে পরিস্থিতি তাতে বিএনপি নেত্রী নির্দ্বিধায় খালাস পাবেন। মামলাটিকে ‘অন্তঃসারশূন্য’ আখ্যা দিয়ে দলটি অভিযোগ করে আসছে, ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে মামলাটিকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘যদি ন্যায় বিচার ও সঠিক বিচার হয় তাহলে বেগম জিয়া সকল অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবেন। কিন্তু মামলার রায়ে কোনো গায়েবি নির্দেশ আসলে বিএনপি তা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবিলা করবে।’

বিএনপি নেত্রীকে শুধু হয়রানি করার জন্য জাল নথি ও ভুয়া তথ্য দিয়ে এ মামলা সাজানো হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘মামলার রায়ের পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জনবিচ্ছিন্ন এ সরকার খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে যতই কৌশল করুক না কেন, তা সফল হবে না।’

সরকার খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চায় অভিযোগ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে যে মামলার রায় দেওয়া হবে সেটি কোনো মামলাই হয় না। তার আইনজীবীরা প্রতিটি অভিযোগ খন্ডন করেছেন এবং প্রমান হয়েছে, এই মামলা কোনো মামলাই হতে পারে না। সম্পূর্ন মিথ্যার ওপর এই মামলা হয়েছে।’

‘যে ট্রাস্ট্রে খালেদা জিয়ার কোনো সম্পৃক্ততাই নেই, যে ট্রাস্ট্র গঠনে তার কোনো মন্তব্য নাই, কোনো ডকুমেন্টে স্বাক্ষর নাই, কোনো নির্দেশনা নাই। একটা জাল ফাইল-নথি হাজির করা হয়েছে। আমাদের আইনজীবীরা প্রমান করে দিয়েছেন, এই নথিটি সম্পূর্নভাবে জালিয়াতি করে ঘষামাজা করে কোনো স্বাক্ষর ছাড়াই রাষ্ট্রপতির প্যাডে নথি তৈরি করা হয়েছে’, বলেন তিনি।

মামলার রায় নিয়ে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যেনতেন রায় দেবেন? মানুষ তা মেনে নেবে না। এতো সোজা না। সঠিক বিচার হতে হবে, ন্যায় বিচার হতে হবে।’

মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ দাবি করে নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশপাশি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে জাগিয়ে তোলার আহ্বানও জানান বিএনপি মহাসচিব।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস‌্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় দেখতে নয় বরং বিচারবিভাগের বিবেক বিতারিত হয়েছে কী না- মানুষ সেটি দেখতে চায়।’

তিনি বলেন, ‘৮ তারিখের জন্য মানুষ অপেক্ষা করছে বিচারের রায়ের জন্য নয়। অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ থেকে বিবেক বিতারিত হয়ে গেছে কী না, বিবেক আছে কী নেই; সেটা দেখার জন্য।’

‘যদি প্রমানিত হয় বিচার বিভাগের বিবেক প্রতারিত হয়েছে, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের আর কোন কিছুর উপর আস্থা রাখার কোন সুযোগ থাকবে না। এরপর যা হওয়ার এদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নেবে’, বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জানুয়ারি ২০১৮/রেজা/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়