ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

আহলান সাহলান মাহে রমজান

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩০, ৬ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আহলান সাহলান মাহে রমজান

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন : আহলান, সাহলান মাহে রমজান। মহান আল্লাহর মোমিন বান্দাগণের জন্য বছর ঘুরে আবার এলো পবিত্র রমজানুল মুবারক।  পবিত্র  রমজানের চাঁদ দেখা গেছে। মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে প্রথম রোজা।

মহান আল্লাহ কর্তৃক এ মাসে প্রথম দিন থেকে শেষ দিন অবধি সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় আহার-পাপাচার ইত্যাদি থেকে বিরত থেকে মহান আল্লাহর-ই সন্তুষ্টি কামনায় রোযা পালনের বিধান বর্ণিত হয়েছে।

যেমন ইরশাদ হয়েছে- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে! যেমনি (তোমাদের) পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমাদের পরহেযগারী অর্জিত হয়।’

উল্লেখ্য যে, ইসলামের বিধানে সর্বপ্রথম শুধুমাত্র আশুরার রোযা ফরয ছিলো। অর্থাৎ বছরে একটি। তারপর প্রতি মাসে তিনটি রোযা ফরয হলো প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ। অতঃপর বর্ণিত আয়াতে করিমা দ্বারা রমজান মাসের রোজা ফরয করা হয়েছে। আর আগের ওই রোজাগুলোর ফরয হওয়া রহিত হয়ে গেছে। উল্লেখ্য যে, রোজা দ্বিতীয় হিজরীর ১০ শাবান ফরয করা হয়েছে।

পবিত্র রমজা‌নের প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যমন্ডিত। বিশেষত এ মাসেই অবতীর্ণ করা হয় পবিত্র কোরআনুল করিম। আর এই কোরআনুল করিম এবং হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় এ মাসের ব্যপক মযার্দা বর্ণনা করা হয়েছে।

যেমন- হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (র.) থেকে বর্ণিত রহমতে আলামিয়ান হাবীবে রহমান হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মর্যাদাপূর্ণ বাণী হচ্ছে ‘আমার উম্মতকে রমযান মাসের পাঁচটি এমন জিনিস দান করা হয়েছে যেগুলো আমার পূর্বে অন্য কোন নবী পাননি।’

১. যখন রমজানুল মুবারকের প্রথম রাত আসে, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন। আর যার প্রতি আল্লাহ রহমতের দৃষ্টি দেন তাকে কখনো আযাব দেবেন না।

২. সন্ধ্যায় তাদের মুখের দুর্গন্ধ (যা ক্ষুধার কারণে সৃষ্টি হয়) আল্লাহ তা’আলার নিকট মেশকের চেয়েও বেশি সুগন্ধি হয়।

৩. ফেরেশতাগণ প্রত্যেক দিনে ও রাতে তার জন্য মাগফিরাতের দোআ করতে থাকেন।

৪. আল্লাহ তা’আলা জান্নাতকে নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ ফরমান, ‘আমার নেক বান্দাদের জন্য সুসজ্জিত হয়ে যাও। শিগগিরই তারা দুনিয়ার কষ্টের বিনিময়ে আমার ঘর ও দয়ার মধ্যে শান্তি পাবে।’

৫. যখন রমজান মাসের সর্বশেষ রাত আসে তখন আল্লাহ তাআলা সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

উপস্থিতদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল এটা কি ‘লাইলাতুল ক্বদর?’ ইরশাদ হলো, ‘না’। তোমরা কি দেখনি যে, শ্রমিকগণ যখন নিজের কাজ সম্পন্ন করে নেয়, তখন তাদেরকে পারিশ্রমিক দেয়া হয়? (আত্তারগীর ওয়াত্তারহীব, খন্ড-২য়, পৃ-৫৬, হাদীস-৭)।

আলোচ্য হাদীসটি দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, রোজাদার ব্যক্তির ওপর মহান আল্লাহর রয়েছে অগণিত দয়া। ক্ষমাপ্রাপ্তি অপূর্ব এ সময়ের সঠিক ব্যবহার করা আমাদের প্রত্যেক মুসলমান নর-নরীর উচিত। প্রতিটি মুহূর্তে এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা আবশ্যক যেন, বান্দার প্রতি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ) এর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এ মাস আসার সাথে সাথেই আল্লাহর ইবাদতে বেশি মাত্রায় মগ্ন হয়ে যেতেন। যেমনিভাবে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বর্ণনা করেন- ‘যখন রমজান আসতো, তখনই আমার মাথার মুকুট, মিরাজের দুলহা হযরত মুহাম্মদ (সা.) মহামহিম আল্লাহর ইবাদতের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও তৎপর হয়ে যেতেন। আর গোটা মাসেই নিজের বিছানা মোবারকের ওপর তাশরীফ আনতেন না।’ (দুররে মানসুর, খন্ড-১ম, পৃ-৪৪৯)।

বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ ‘তফসীরে নঈমী এর দ্বিতীয় খণ্ডে পবিত্র এ মাসের অনেক গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখ যোগ্য কয়েকটি হলো,

১. কা’বা শরীফ মুসলামানেদের তার নিকট ডেকে রহমত প্রদান করে, কিন্তু এটা (মাহে রমজান) এসে রহমত বন্টন করে। এ বিষয়টা এমন যেন সেটা (কা’বা) একটা কূপ, আর এটা (রমজান শরীফ) হচ্ছে সমুদ্র। অথবা ওটা (অর্থাৎ কাবা) হচ্ছে সমুদ্র আর এটা (অর্থাৎ রমযান) হচ্ছে বৃষ্টি।

২. প্রতি মাসে বিশেষ বিশেষ কিছু দিন-তারিখ রয়েছে। আর তারিখগুলোর মধ্যেও বিশেষ মুহূর্তে ইবাদত-বন্দেগী সম্পন্ন করা হয়। যেমন- ঈদুল আজহার কয়েকটা (বিশেষ) তারিখ হজ, মহররমের দশম দিন উত্তম। কিন্তু রমযান মাসে প্রতিদিনে ও প্রতিটি মুহূর্তে ইবাদত হয়। রোজা ইবাদত, ইফতার ইবাদত, ইফতারের পর তারাবির জন্য অপেক্ষা করা ইবাদত, তারাবিহ পড়ে সাহরির জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে ঘুমানো ইবাদত, তারপর সাহরি খাওয়াও ইবাদত।

মোট কথা, প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলার শান ও মহা বদান্যতাই নজরে পড়ে।

৩. ‘রমজান’ হচ্ছে একটা ‘ভাট্টি’। ভাট্টি হল অপরিষ্কার লোহাকে পরিষ্কার এবং পরিষ্কার লোহাকে মেশিনের যন্ত্রাংশে পরিণত করে দামী করে দেয়, আর স্বর্ণকে অলংকারে পরিণত করে ব্যবহারের উপযুক্ত করে দেয়, তেমনিভাবে রমজান মাস গুনাহগারদের পবিত্র করে এবং নেককার লোকদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেয়।

৪. রমজানে নফলের সাওয়াব ফরজের সমান এবং ফরজের সাওয়াব সত্তর গুণ বেশি পাওয়া যায়।

৫. কিছু সংখ্যক আলিম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে মৃত্যুবরণ করে, তাকে কবরে প্রশ্ন করা হয় না’।

৬. এ মাসে শবে ক্বদর রয়েছে। কোরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আমি সেটাকে ক্বদর রাত্রিতে অবতরণ করেছি’। পারা-৩০, সূরা-কদর, আয়াত-১)।

৭. রমজান মাসে শয়তানকে বন্দি করা হয়, দোজখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়, জান্নাতকে সুসজ্জিত করা হয় এবং দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। এ কারণে, এসব দিন সৎকর্ম অধিক ও গুনাহ কমে যায়। যে সব লোক গুনাহ করেও নেয়, তারা ‘নফসে আম্মারা কিংবা নিজেদের সাথী শয়তান’ (সঙ্গে অবস্থানকারী শয়তান) পথভ্রষ্ট করার কারণে করে থাকে।

৮. রমজানে পানাহারের হিসাব হয় না।

৯. কিয়ামতে রমজান ও কোরআন রোজাদারের জন্য সুপারিশ করবে। রমজান বলবে, ‘হে আমার মালিক! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত রেখেছিলাম।’ আর কোরআন আরজ করবে, ‘হে মহান রব! আমি তাকে তিলাওয়াত ও তারাবির মধ্যে ঘুমাতে দেইনি।

১০. হযরত মুহাম্মদ (সা.) রমজানুল মোবারকে প্রত্যেক কয়েদীকে মুক্ত করে দিতেন এবং প্রত্যেক ভিখারীকে দান করতেন। মহা মহিম প্রতিপালকও রমজান মাসে দোজখীদের মুক্তি দেন। সুতরাং রমজানে প্রত্যেক মুসলমান নর-নরীর উচিত নেক কাজ করা এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা।

১১. কোরআনুল করিমে শুধু ‘রমজান’ শরীফের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেটার ফজিলতসমূহই বর্ণিত হয়েছে। অন্য কোন মাসের নাম ও ফজিলত সুস্পষ্টভাবে নেই। মাসগুলোর মধ্যে কোরআন শরীফে শুধু রমজান মাসের নাম নেয়া হয়েছে, নারীদের মধ্যে শুধু বিবি মরিয়ম এর নাম এসেছে, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত যায়েদ ইবনে হারিসা এর নাম নেয়া হয়েছে, যার কারণে এই তিন জনের মহত্ব জানা যায়।

১২. রমজান শরিফে ইফতার ও সাহরির সময় দোয়া কবুল হয়। এ মর্যাদা অন্য কোন মাসে নেই। (তাফসীরে নঈমী, খন্ড-২য়, পৃ-২০৮)

মহান আল্লাহ সবাইকে রমজানের তাৎপর্য অনুধাবন করে সঠিক আমল করার তৌফিক দিন। আমিন।

 

 

রাই‌জিং‌বি‌ডি/ঢাকা/৬ মে ২০১৯/নঈমুদ্দীন/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়