বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দুর্নীতি বন্ধে দুদকের সুপারিশ
এম এ রহমান : সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস, অনুদান ও উন্নয়ন তহবিলের নামে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসব চলতে থাকে। এতে শিক্ষার্থীরা আর্থিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। অভিভাবকরাও হন চরম আর্থিক ক্ষতির শিকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও হয় ব্যাপক দুর্নীতি।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পেশ করা বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে দুর্নীতির বেশকিছু উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বড় অংশই উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আশায় বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। কয়েক মাসব্যাপী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার নামে কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস, অনুদান, উন্নয়ন তহবিলের নামে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির মহোৎসব চলতে থাকে। শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এতে তারা আর্থিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
অন্যদিকে, অভিভাবকরাও আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির শিকার হন। যা তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক এবং আত্মিকভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এ জাতীয় কর্মকাণ্ড সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টির অন্যতম অন্তরায়। তাই দুদক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছে।
এ সংক্রান্ত দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের সুপাশিরগুলোর মধ্যে রয়েছে-
চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়গুলোর বিদ্যমান ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সরকারি-বেসরকারি সকল সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি সম্পন্ন করতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ সমন্বিত একক পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।
এজন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটি সমন্বিত ভর্তি নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে।
অন্যদিকে, দুদকের অনুসন্ধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও দুর্নীতির ব্যাপক তথ্য মিলেছে। অনুসন্ধানের আলোকে দুর্নীতির উৎস হিসেবে চিহ্নিত উৎসের বিষয়ে দুদক বলছে-
বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শিক্ষার মানদণ্ডে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দুর্নীতির সংবাদ বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এছাড়া, দুদকও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে প্রায় মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করছে। দুদকের অনুসন্ধানে নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ লেনদেনের তথ্য মিলেছে। তাই শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের ভাবমূর্তি ম্লান করে দিচ্ছে।
এ থেকে পরিত্রাণে দুদকের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মুঞ্জরি কমিশনের মাধ্যমে সকল সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
সর্বোচ্চ মেধাবী এবং যোগ্য প্রার্থীরাই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ পান, সেজন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আরো স্বচ্ছতা আনা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে একটি সমন্বিত ভর্তি নিয়োগ-নীতিমালা প্রণয়নপূর্বক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যেতে পারে বলেও দুদক মনে করে।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবার মাহমুদ রাইজিংবিডিকে বলেন, বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় মহামান্য রাষ্ট্রপতিও দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদককে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি অনুসরণ করতে বলেছেন। শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য করণীয় সবকিছু করতে হবে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পেতে হলে স্বাস্থ্য এবং মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
এর আগে ২০১৭ সালে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস বন্ধে বিষয়ভিত্তিক বেশকিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিল দুদক।
কমিশনের প্রতিবেদনে দুর্নীতির উৎস, দুদকের আইনি ম্যান্ডেট এবং এসকল দুর্নীতি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করে দুদকের বিশেষ টিমের সদস্যরা। ওই প্রতিবেদনে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট/গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন প্রকারে দুর্নীতির উৎস এবং তা বন্ধের জন্য ৩৯টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিল দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম।
যার মধ্যে বড় একটি বিষয় পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস। যেখানে দুদকের বক্তব্য ছিল, কতিপয় ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তা প্রশ্নফাঁসের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ সরকারি প্রেস (বিজি প্রেস), ট্রেজারি এবং পরীক্ষাকেন্দ্রের কোনো অসাধু কর্মকর্তারা ও কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্রের যোগসাজশ রয়েছে।
এছাড়া, কোচিং এবং নোট-গাইড বাণিজ্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) দুর্নীতি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের দুর্নীতি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনিয়ম চিহ্নিত করে ৩৯টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিল সংস্থাটি।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ জুন ২০১৯/এম এ রহমান/রফিক
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন