ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘ঋণ রিকভারিতেই যতো সুখ’

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫২, ২ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ঋণ রিকভারিতেই যতো সুখ’

এম এ রহমান মাসুম: বেসিক ব্যাংকের তিন শাখা থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনই (দুদক) পার করেছে প্রায় সাত বছর।

অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাতে ৫৬ মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৫ সালে মামলা দায়ের করার পরও পেরিয়ে গেছে প্রায় চার বছর। অগ্রগতি ওই পর্যন্তই। এরপর প্রতিষ্ঠানটির প্রাক্তন চেয়ারম‌্যান আলোচিত আবদুল হাই বাচ্চু পাঁচ দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করলেও মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়নি।

তবে ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত আত্মসাতকৃত অর্থের ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা বেসিক ব‌্যাংকে জমা হওয়াকে দুদকের সাফল্য দাবি করছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যানসহ উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা। তাদের মতানুসারে দুদকের কঠোর হওয়ার কারণেই লোপাটের অর্থ ফিরে পাচ্ছে ব্যাংক। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে আত্মসাতকৃত অর্থ রিকভারি করা বা করার উদ‌্যোগ নেওয়া দুদকের কাজ নয়। দুদকের প্রধান কাজ প্রকৃত অপরাধী সনাক্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা।

বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের বারংবার প্রশ্নে দুদক চেয়ারম‌্যান ইকবাল মাহমুদকে বিব্রত হতেও দেখা গেছে। সর্বশেষ ১৩ মে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদন দিয়ে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসার পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ অনেকটা বিরক্তির সুরে বলেন, ‘এই কথাটা গত দুই বছর ধরে শুনে আসছি। বেসিক ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক… আর ব্যাংক নেই বাংলাদেশে? টাকা কোথায় গেল, তা যদি আমি কোর্টে না বলতে পারি তাহলে তো কোনো কেইসই না। আমাদের উদ্দেশ্য হল, এই টাকা কোথায় গেল, তা প্রমাণ করা।’

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটি ব্যাপকভাবে আলোচিত ঘটনা। তারপরও তদন্ত শেষ করতে দুদকের এত সময় কেন প্রয়োজন হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। এটা হতে পারে তাদের সামর্থ্যের ঘাটতি, আরেক হতে পারে সদিচ্ছার ঘাটতি।  দুদকের যে আইনি কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য, সেটা যদি যথাযথভাবে প্রয়োগ করে, তাহলে এ ধরনের কেলেঙ্কারি দ্রুতই নিষ্পত্তি করা সম্ভব।’

দ্রুত যে নিষ্পত্তি সম্ভব তা দুদকেরই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল- গ্রাহকগণ ব্যাংকে যেসব রেকর্ডপত্র দাখিল করেছেন তার বেশীর ভাগই জাল। ব্যাংক কর্মকর্তারা রেকর্ডপত্র যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে নাই। কথিত ঋণ গ্রহীতাগণ এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, তারা প্রধান কার্যালয়কে ম্যানেজ করে বিনা প্রশ্নে তাদের আবেদনগুলো মঞ্জুর করিয়েছে। বেশীরভাগ ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাগণ তাদের ঋণ নীতি ও অন্যান্য সার্কুলার লঙ্ঘন করেছে। এমনকি ব্যাংক কর্মকর্তাগণ মঞ্জুরীপত্রের শর্তাবলীও পরিপালন করেননি। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ঋণ গ্রহীতাগণ গৃহীত ঋণের সদ্ব্যবহার করেননি।

এর আগে হাইকোর্ট থেকে কয়েক দফায় এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চেয়ে নির্দেশনা দিলেও নেই কোনো অগ্রগতি। মামলাগুলোর তদন্ত শেষ না হওয়ায় ১০ তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেছিল হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ৩০ মে তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতে উপস্থিত হলে ক্ষোভ, উষ্মা ও হতাশা প্রকাশ করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুদকের কৌশলপত্র-২০১৯ নিয়ে ‘সুশীল সমাজের’ প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ জানিয়েছিলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের ৫৬টি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ব্যাংকার, ব্যবসায়ী যারা আসামি তারাও দ্রুত মামলার চার্জশিট চান। আমরা চেষ্টা করছি। ব্যাংকের টাকাটা কিন্তু জনগণের। জনগণের টাকা ব্যাংকে ফিরে আসুক, এটা কিন্ত জনগণ চায়।”

২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণের অভিযোগ ওঠার পর অনুসন্ধানে নামে দুদক। ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া, জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দানসহ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বিধি বহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে।

প্রায় চার বছর অনুসন্ধান শেষে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনে টানা ৫৬টি মামলা হয়। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় এসব মামলায় আসামি করা হয় ১২০ জনকে। এর মধ্যে ঋণ গ্রহীতা-৮২, ব্যাংকার-২৭ ও ভূমি জরীপকারী-১১। অনিয়মের মাধ্যমে ২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান শাখায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, শান্তিনগর শাখায় ৩৮৭ কোটি টাকা, প্রধান শাখায় প্রায় ২৪৮ কোটি টাকা এবং দিলকুশা শাখায় ১৩০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। অভিযোগের বাকি অংশের অনুসন্ধান এখনো চলমান। এছাড়া বেসিক ব্যাংক সংক্রান্ত বিষয়ে পৃথক চারটি মামলা করে দুদক।

ব্যাংকার ও ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই একাধিক মামলায় আসামি হয়েছেন। এর মধ্যে ব্যাংকের প্রাক্তন এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে ৪৮টি মামলায়। ডিএমডি ফজলুস সোবহান ৪৭টি, কনক কুমার পুরকায়স্থ ২৩টি, মো. সেলিম আটটি, বরখাস্ত হওয়া ডিএমডি এ মোনায়েম খান ৩৫টি মামলার আসামি। তবে কোনো মামলায় ব্যাংকের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি করা হয়নি। এ বিষয়ে দুদকের বক্তব্য ছিল, তারা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আব্দুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা পাননি। কিন্তু ২০১৬ সালে সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ করা নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে অনিয়মিত ঋণ মঞ্জুর, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল।

এর মধ্যে আব্দুল হাই বাচ্চুকে পঞ্চম দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদে নিজের ভুল স্বীকার করে দাবি করে বেসিক ব‌্যাংকের এক সময়ের প্রতাপশালী চেয়ারম‌্যান আবদুল হাই বাচ্চু বলেছিলেন, ‘আমি যা করেছি সরল মনে করেছি। অনেকক্ষেত্রে ভুল করেছি। তবে সকল দায় আমার নয়। কারণ, বোর্ডের অনুমোদনের বাইরে আমি কিছু করিনি।’

দায়েরকৃত মামলাগুলোর তদন্তের দায়িত্ব পালন করছেন দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের তদন্ত টিম।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জুলাই ২০১৯/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়