ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সম্রাটের বর্ণিল সাম্রাজ্য বিবর্ণ!

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সম্রাটের বর্ণিল সাম্রাজ্য বিবর্ণ!

নেতা-কর্মীদের কাছে ‘মুকুটহীন সম্রাট’ তিনি। কর্মীদের বিপদে-আপদে তো বটেই, এর বাইরেও সবার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়ান তিনি। বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও একটি বিষয়ে নেতা-কর্মীদের অভিন্ন মত- তিনি একজন দক্ষ সংগঠক। আর দলের ক্রান্তিকালের একজন পরীক্ষিত কর্মী। প্রশ্ন উঠছে, এত এত ইতিবাচক বিশেষণ যার নামের সঙ্গে সেই যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট কেন এখন কোণঠাসা? তার বর্ণিল সাম্রাজ্যই বা কেন বিবর্ণ প্রায়?

মূলত ঢাকায় অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান এবং এর সঙ্গে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরীর নাম ওঠার পর থেকেই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। দুর্নীতির দায়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া এবং নাম উল্লেখ না করে যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে নিয়ে গণভবনে দলের এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষোভ প্রকাশ করার পর পুরো চিত্র বদলে যায়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকায় অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে সরকারের সর্বাত্মক অভিযানের পর সম্রাটের নাম চলে আসে সামনে। এখন তার গ্রেপ্তার নিয়েও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য আসছে।    

তবে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের দিক থেকে এই বিষয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতা-কর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে শক্তিশালী সহযোগী এই সংগঠনের অন্যতম সংগঠক ইসমাইল চৌধুরীর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তারা বলছেন, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ থাকতে পারে, ক্যাসিনোর সঙ্গে সম্রাট জড়িত নন। তবে দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।

সম্রাটের ঘনিষ্ঠজনের একজন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদুর রহমান। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘পত্রিকায় এসেছে, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়ের করা ১৭টি মামলার একটিতেও ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরীর কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পায়নি প্রশাসন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজপথের পরীক্ষিত সৈনিক ইমাইল চৌধুরী। ইনশাআল্লাহ ষড়যন্ত্রকারীরা পরাজিত হবে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘যুবলীগের যেকোনো স্তরের নেতা-কর্মীর কাছে সম্রাট ভাই সম্পর্কে জানতে চাইবেন, দেখবেন তারা বিষয়টি কিভাবে দেখেন। সংগঠনের ওনার যে জনপ্রিয়তা সেটি কিন্তু একদিনে হয়নি। উনি সংগঠনের জন্য যা করেছেন, দলের দুঃসময়ে যেভাবে বুক চিতিয়ে দিয়েছে খুব কম নেতাই সেটি করতে পেরেছেন।’

‘বিএনপি সরকারের শাসনামলে দলের দুঃসময়ে তিনি মায়ের গহনা বিক্রি করে পার্টি অফিসে নঙ্গরখানা খুলেছেন। দলের দুর্দিনে ঢাকার রাজপথের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের খবর নিয়েছেন। যেই মানুষটি প্রিয়নেত্রীর রাজপথের নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন, তাকে নিয়ে কেন এত ষড়যন্ত্র? আমার প্রশ্ন? দলের নেতা-কর্মীদের খোঁজ খবর রাখেন না, তাদের নিয়ে কোন কথা নেই। আলোচনা নেই।’

নেতা-কর্মী শূন্য সম্রাটের অফিস

রাজধানীর কাকরাইলে ভুঁইয়া ম্যানশনে ইসমাইল চৌধুরীর অফিস। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি এখানে নেতা-কর্মীদের ভিড় ছিল। অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর দিনেই গ্রেপ্তার হন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া। তখন থেকেই সংগঠনের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরীর নামও সামনে চলে আসে। এরপর দুদিন কাকরাইলের ওই ভবনের সামনে শত শত নেতা-কর্মী নিয়ে অবস্থান নেন সম্রাট। দুদিন পর সেখান থেকে তিনি আছেন, না কোথাও গেছেন- তা জানা নেই নেতা-কর্মীদের। এখন পর্যন্ত সম্রাটের সঙ্গে কারো যোগাযোগ নেই।

সোমবার কাকরাইলের ভুঁইয়া ম্যানশনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সামনেও কেউ দাঁড়াচ্ছে না। যেখানে নেতা-কর্মীদের ভিড় লেগে থাকত সেখানে এখন কেউ নেই। দু-একজন নেতার সন্ধান মিললেও তারা কেউ-ই সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের কেউ নন। এমন দুজন নেতা জানান, এক সময় তারাও সেখানে আড্ডা দিতেন, গল্প করতেন। কিন্তু এখানে এখন নেতা-কর্মী কম আসেন। ‘ভাই (সম্রাট) থাকতেন তো তাই সবাই আসত। এখন ভাই নাই তাই কেউ আসে না’, বলছিলেন সংগঠনের ওই দুই নেতা।   

সম্রাট কোথায়

সম্রাটকে গ্রেপ্তরের বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন সংবাদ আসছে। কয়েকদিন ধরেই তিনি গোয়েন্দাজালে আটকে আছেন বলে  বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না- সে বিষয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। আবার তাকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি- সরাসরি এমন কথাও কেউ বলছেন না। এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধুম্রজালের।

সম্রাট আটক হয়েছেন কি না সেটি নিশ্চিত হতে গত দুদিন ডিএমপি ও ডিবি কার্যালয়ে মিডিয়াকর্মীদের ভিড় ছিল। কিন্তু তারা কেউই এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি।

এ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘খুব শিগগিরই দেখবেন তার (সম্রাট) সম্পর্কে আপনারা অনেক কিছুই বলছেন, সে সম্রাটই হোক আর যে-ই হোক, অপরাধ করলে আইনের আওতায় আনা হবে।’

রাজনীতিতে যেভাবে মুকুটহীন সম্রাট

জানা গেছে, রাজধানীর মতিঝিলে ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে ইসমাইল চৌধুরী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পরে যুবলীগের রাজনীতিতে আসেন। বড় পদ না থাকা স্বত্ত্বেও সহকর্মীদের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি সুনাম হিসেবে সংগঠনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন তিনি। ২০০১ সালে দলের ক্রান্তিকালে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে সামনে থেকে রাজপথে নেতৃত্ব দেন। ওই সময়ে সংগঠনের সভাপতি ছিলেন জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মির্জা আজম। সম্রাটের সাংগঠনিক দক্ষতা ও সাহসিকতার প্রশংসা করতেন তারা।  বিএনপি সরকারের শেষ সময়ে  আন্দোলনে সম্রাটের ভূমিকা এখনো নেতা-কর্মীদের চোঁখে ভাসে। এক-এগারোর সরকারের শাসনামলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হওয়ার পর হাউজ বিল্ডিং থেকে প্রথম মিছিলটি বের করে ইসমাইল চৌধুরী। সে সময় বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে সেটির প্রচারও পায়। হেফাজত ইসলামীর আন্দোলনের সময়ে আওয়ামী লীগ অফিসে যখন হামলা হয়েছিল, তখন নেতা-কর্মীদের নিয়ে সেটি প্রতিরোধ করেছিলেন সম্রাট। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সম্রাটের সাম্রাজ্য আরো বিস্তৃত হতে থাকে। বিএনপির পতনের পর ঢাকার দুই প্রভাবশালী নেতা সাদেক হোসেন খোকা ও মির্জা আব্বাসের শূন্যস্থান পূরণ করেন সম্রাট।

বিবর্ণ সময়

দ্রুতই ঢাকার প্রভাবশালী যুব নেতা হিসেবে আবির্ভুত হন ইসমাইল চৌধুরী। ধীরে ধীরে চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজির সঙ্গে তার নামও উঠে আসতে শুরু করে। অভিযোগ উঠেছে, ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। যদিও তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তবে ক্যাসিনো ব্যবসাসহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শুদ্ধি অভিযানের পর থেকেই বিবর্ণ সময় কাটাচ্ছেন সম্রাট।

অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগ পরিচয় দেয়া জিকে শামীম, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের লোকমান হোসেন।


ঢাকা/পারভেজ/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়