ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

টাকায় মেলে এসএসসি’র রোল-রেজিস্ট্রেশন!

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৭, ১৪ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টাকায় মেলে এসএসসি’র রোল-রেজিস্ট্রেশন!

গাজীপুরের কাপাসিয়া টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি হয়েছিল মো. সজিব। তার পিতার নাম বকুল মোড়ল, মায়ের নাম শিরিয়া বেগম।  নবম শ্রেণিতে সে রেজিস্ট্রেশনও করেছিল।  যার নম্বর- ৮১৭৩৮২ এবং রোল নম্বর- ২৩৮৯৩৫।  তবে সে এসএসসি পরীক্ষা দেয়নি। নবম শ্রেণিতেই পড়ালেখা বাদ দিয়ে ব্যবসার চেষ্টা করছে।

কিন্তু চলতি বছরের এসএসসি’র প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, উত্তীর্ণদের মধ্যে সেই রোল এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর রয়েছে। নাম ‘নাসিম মাহমুদ ইমন’, পিতা নজরুল ইসলাম, মায়ের নাম নাছিমা।

বোর্ডের ফলাফল প্রকাশে ভুলের কারণে এমনটি হয়নি। নাসিম মাহমুদ ইমন নামের ওই শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েই পাশ করেছে। কিন্তু বোর্ডের রেজিস্ট্রেশন রেকর্ডে তার নাম নেই। নাম নেই স্কুলের হাজিরা খাতায়ও। পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় টাকার বিনিময়ে তাকে এই সুযোগ করে দেন স্কুলেরই শিক্ষকরা। পরীক্ষার ফরম ফিলাপে মো. সজিবের ছবি-পরিচয় বদলে দেয়া হয়। আর এ কাজে সহায়তা করেছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের একটি শাখা। যার ফলে সবার যেখানে ১০ বছর লাগে, সেখানে মাত্র দেড় মাসের বিনিয়োগে নাসিম মাহমুদ ইমন পাশ করে ফেললেন এসএসসি (ভোক)।

২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর কাপাসিয়া টেকনিক্যাল স্কুলের (৫৩০৯৫) প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান শিক্ষক মো. রেজাউল করিম স্বাক্ষর করে ইলেকট্রিক ফরম ফিলাপের কপি বোর্ডে জমা দেন। এতে মো. সজিবকে নিয়মিত ছাত্র দেখানো হয়, তার ট্রেড ছিল কম্পিউটার অ‍্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি। সেই ফরমটি বোর্ড স্বাক্ষর করে রিসিভ করে। সেই রিসিভ কপিতে দেখা গেছে, সজিবের নামের পাশে একটি স্বাক্ষরও রয়েছে। অথচ ২০১৭ সালেই স্কুল ছেড়েছে সজিব।

শুধু মো. সজিবের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে এমন হয়নি। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ৩৫ জন। এর মধ্যে পাঁচ জনের ‘ফরম ফিলাপ ইনফরমেশন’ এবং ‘রেজাল্ট ইনফরমেশন’-এর মধ্যে এমন ভয়াবহ জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফরম ফিলাপ ইনফরমেশনে ৮১৭৩৮৮ রেজিস্ট্রেশন নম্বরের ছাত্র মো. সজিব মিয়া, বাবার নাম মো. ফজলু মিয়া, মায়ের নাম মোসাম্মৎ লাইলি বেগম। কিন্তু রেজাল্ট ইনফরমেশনে নাম পাওয়া গেছে রিপন হোসেন। তার বাবার নাম শফিকুল ইসলাম, মায়ের নাম আসমা খাতুন। বদল করা হয়েছে জন্ম তারিখও। এই বদল বা রিপ্লেস হয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সহায়তায়।

 

নবম শ্রেণির ফরম ফিলাপে ইনফরমেশন শিটে একজনের নাম, রেজাল্ট ইনফরমেশন শিট ও সার্টিফিকেটে ভিন্ন নাম

 

একই রকম ভাবে মো. আলহাদুর ৮১৭৪০৩ রেজিস্ট্রেশন নম্বর কিনেছেন মো. সোলাইমান দেওয়ান, মো. সোহেল মিয়ার ৮১৭৪০৪ রেজিস্ট্রেশন নম্বর কিনেছেন মো. শাকিল আফ্রাদ। আর মো. লিটন হোসেনের ৮১৭৪০৫ রেজিস্ট্রেশন নম্বর বিক্রি হয়েছে তানভির সরকারের কাছে।

এই পাঁচজনের কেউ অষ্টম শ্রেণিতেই পড়ালেখা ছেড়েছেন, কেউ নবম শ্রেণিতে উঠে পড়ালেখা ছেড়েছেন। কিন্তু শিক্ষকরা জালিয়াতি করে তাদের নিয়মিত ছাত্র দেখিয়ে ফরম ফিলাপ করে বোর্ডে নাম জমা দিয়েছেন। এরপর চলতি বছরের পরীক্ষার কয়েকদিন আগে এসব রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও রোল নম্বর মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন অন্য ছাত্রের কাছে।

এদের মধ্যে দুয়েকজন ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পড়ালেখা করতেন। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার জন্য কারিগরি সার্টিফিকেট পাওয়ার লোভে শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। বাকী দুয়েকজনকে জোগাড় করেছেন শিক্ষকরা নিজেরাই। এ কাজে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ওইসব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছেন একটি অংশ নিজেরা রেখেছেন, টাকার একটি নির্দিষ্ট অংক গেছে কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের কম্পিউটার সেলে।

অনুসন্ধানে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া এমন কিছু রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাওয়া গেছে- যেগুলোর নবম শ্রেণিতে নিবন্ধন হয়েছিল এক নামে আর পাবলিক পরীক্ষা দিয়েছে ভিন্ন নামে। এদের নাম দশম শ্রেণিতে এসে পরীক্ষার আগে চূড়ান্ত ফরম ফিলাপের সময় রিপ্লেস হয়। এমন কিছু রেজিস্ট্রেশন নম্বর হলো- ৮১৭৩৮২, ৮১৭৩৮৮,৮১৭৪০৫ ৮১৭৪০৪, ৮১৭৪০৩, প্রতিষ্ঠান কোড- ৫৩০৯৫, পাশের সাল ২০১৯ ইং।

২০১৯ সালের এসএসসি’র (ভোক ও দাখিল) ক্ষেত্রে এমন আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সাথে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের যোগসাজশের কথা জানা গেছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু খোদ রাজধানী ঢাকার। কিছু দিনাজপুর, টাঙ্গাইল এবং গাজীপুর জেলার।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. মোরাদ হোসেন মোল্ল্যা রাইজিংবিডিকে বলেন, এমন কোনো ধরনের ঘটনা আমাদের বোর্ডে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। আর এমন ঘটনা ঘটার কোনো সুযোগ নেই, কারণ নবম শ্রেণিতে ফরম ফিলাপের সব রেকর্ড আমাদের কাছে থাকে, সে ভিত্তিতে চূড়ান্ত ফরম ফিলআপ করা হয়। সুতরাং এমন ঘটার কোনো অবকাশ নেই।

 

ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ষষ্ঠ সেমিস্টারের একই রেজিস্ট্রেশন কার্ড দুজনের নামে

 

এটি বোর্ডের কোনো কর্মকর্তার সহায়তায় গোপনীয় শাখা থেকে করার প্রমাণও রয়েছে। এক্ষেত্রে বোর্ড কি কোনো ব্যবস্থা নেবে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, কোনো অভিযোগ বা প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জালিয়াতি হয়েছে ডিপ্লোমা কোর্সেও :

২০১৮ সালের ডিপ্লোমাতেও একই ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত শিক্ষাক্রমগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই কোর্সের মেয়াদ ৪ বছর এবং ৮ সেমিস্টারে বিভক্ত। কিন্তু অনুসন্ধানে এমন চিত্র পাওয়া গেছে, ষষ্ঠ সেমিস্টারে ভর্তি দেখিয়ে অনেককে মাত্র এক বছরে এই কোর্সে পাশ করানো হয়েছে।

এই কোর্সে ২০১৬ সালে গাজীপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে (প্রতিষ্ঠান কোড ৫৩০৮২) ভর্তি হয়েছিল বরকত হোসেন। তার বাবার নাম সোহরাব হোসেন, মায়ের নাম সুরাইয়া বেগম। ওই বছর প্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রিক ফরম ফিলআপে তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ০০০০৬২৬৬০০, রোল নম্বর- ৭৬১৮২৯। সেশন ২০১৩-১৪। তার পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার সুযোগটাও বিক্রি করেছে এই অসাধু চক্র। ২০১৮ সালে সেই একই রোল এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বরের বিপরীতে মো. খোকন মিয়া’র নাম ফরম ফিলআপে এসেছে। এক্ষেত্রেও নামগুলো রিপ্লেস করেছে বোর্ডের কমপিউটার সেল।

একই ভাবে ২০১৫ সালে ভর্তির পর মো. মোবারক হোসেনের (রোল নং ৮৫৭৯২৫) নাম ২০১৭ সালেও ফরম ফিলআপে ঠিক ছিল। সেশন ২০১৪-১৫। কিন্তু ২০১৮ সালে এসে সেই একই নম্বর বিক্রি করা হয়েছে মো. আকাশ মিয়ার কাছে। তার বাবার নাম মো. আনোয়ার হোসেন, মায়ের নাম রাশেদা বেগম।

সার্বিক বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন রাইজিংবিডিকে বলেন, প্রশাসনের কোনো স্তরেই দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। যে-ই অপরাধ করুক অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।



ঢাকা/হাসান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়