ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভাড়ায় স্বামী

মাকসুদুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৩, ২৫ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাড়ায় স্বামী

ছবি প্রতীকী

কমলাপুর রেলক্রসিং। পিঠা, রুটি বিক্রি করেন হালিমা খাতুন (ছদ্মনাম)। এ দিয়ে চলে না সংসার। অভাবের তাড়নায় পুঁজি ভেঙে নিঃস্ব হয়েছেন। এ অবস্থা থেকে ভালোভাবে চলার জন্য ব্যবসা করতে তিনি একটি সমিতি থেকে তিন হাজার টাকা ঋণ নিতে যান। সেখানে কাগজপত্র ঠিক করতে প্রয়োজন হয় স্বামীর।

রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপচারিতায় হালিমা বলেন, ‘সমিতির নিয়ম মানতে আমি এক রিকশাচালককে স্বামী হিসেবে পরিচয় দেয়ার জন্য ভাড়া করি। ভাড়া হিসেবে পাঁচশ টাকা দিতে হবে। এই শর্তে ওই রিকশাচালক নিজের ছবি দেন এবং আমার সঙ্গে স্বামী হিসেবে সমিতিতে গেলে সহজেই ঋণটি পাই। তবে তিনি কিন্তু আমার স্বামী না।’

এক মাস আগে এনজিওর ঋণ পেতে একজন স্বামী ভাড়া করেছিলেন বাসাবোর রোজিয়া বেগম। নন্দীপাড়ার মধ্যবয়সী এক ব্যক্তিকে তিনি স্বামী হিসেবে নিয়ে ঋণের টাকা আনতে যান। মাত্র ৫০০ টাকাতেই তার সঙ্গে স্বামী পরিচয়ে এনজিও অফিসে গিয়ে ছবি তুলে ঋণ পেতে সহায়তা করেছেন আজগর নামে ভাড়ায় খাটা ওই স্বামী।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, স্বামী পরিচয়ে একই ব্যক্তি একাধিক ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়া খাটছেন। ৫ থেকে ৬ নারীর স্বামীর পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছিল যাত্রাবাড়ির নওয়াব মিয়া। পরে এ অভিযোগে তদন্তে নিশ্চিত হয়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী ওয়াজেদ মিয়া বলেন, ‘আমি ওই থানায় থাকাকালীন এরকম বেশকিছু অভিযোগ পাই। তদন্তে নওয়াবের প্রতারণা পাওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।’

ভাড়ায় স্বামী- এটি অনেকেই পেশা হিসেবেও বেছে নিয়েছেন বলেও জানান কাজী ওয়াজেদ মিয়া।

এক যুগের বেশি সময় ঢাকায় এসে ফার্মগেটে হকারের ব্যবসা শুরু করেন তারা মিয়া। ঘটনাচক্রে পরিচয় হয় এক নারীর সঙ্গে। পরে সখ্য এবং পরবর্তীতে স্বামী পরিচয়ে বসবাস। ভাড়ায় স্বামী বাণিজ্য শুরু করেন তারা। তেজগাঁও, কাঠালবাগান, কারওয়ানবাজার, বাংলামোটরে পাঁচ নারীর ভাড়াটে স্বামী হন তিনি। মাসে ভাড়া পান ২৫ হাজার টাকা। কোনো মাসে বেশিও হয়।

রাইজিংবিডির প্রশ্নে তারা মিয়া বলেন, ‘স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে রায়েরবাজার ভাড়া থাকেন। হকার পেশা ছেড়ে দিয়ে ভাড়ায় স্বামী খাটার কাজ করছি। তবে একবার পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে দেড় মাস জেলে ছিলাম।’

এছাড়া পাসপোর্ট তৈরি এবং সংসার চালাতে অনেক নারী ভাড়ায় স্বামী কিনছেন। একশ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকায় পর্যন্ত স্বামী কেনাবেচা হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের নারীদের কাছে স্বামী কেনা এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় দাঁড়িয়েছে।

আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের দালাল জামাল। নারীদের স্বামী ভাড়া দেয়াই তার প্রধান কাজ। পাসপোর্ট করতে কোনো নারী একা গেলে অনেক সময় তাকে স্বামী সঙ্গে রাখার কথা বলা হয়। সেক্ষেত্রে নারী পাসপোর্ট প্রত্যাশীকে সময় ব্যয় করে আরেক দিন আসতে বলে। অনেকে ফিরেও যান। ফিরে যাওয়ার সময় তাদের প্রস্তাব দেন, টাকা-পয়সা খরচ করে আবার আসবেন। তার চেয়ে মাত্র একশ টাকা খরচ করুন আমি একজন লোক দিচ্ছি উনি আপনার সঙ্গে যাবেন, মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য উনাকে স্বামী পরিচয় দেবেন। এভাবে জামাল নিজে বা ভাড়া করা পুরুষ স্বামী বানিয়ে দিব্যি বাণিজ্য করে যাচ্ছেন।

জামাল বলেন, ‘একজন নারী যদি উপকৃত হয় তাহলে এটি দোষের কি?। তার যেমন উপকার হয়, তেমনি আমারও কিছু উর্পাজন হয়। আমরাতো আর অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক করি না।’

সরেজমিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে জানা গেছে, স্বামী হিসেবে ভাড়ায় খেটে নিজের সংসার চালাচ্ছেন অনেকেই। দিনে ১০০ টাকা থেকে মাসে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকায় ভাড়ায় স্বামী ম্যানেজ করছেন নারীরা। এনজিওসহ বেশকিছু মাল্টিপারপাস কোম্পানি থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নেওয়ার শর্ত হিসেবে স্বামীর পরিচয় ও তার ছবি ব্যবহার করতে হয়। এ কারণে স্বামী ভাড়া করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভাড়া খাটার আবার শর্ত রয়েছে। সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন স্বামী পরিচয়ে বাসায় অবস্থান করতে হবে। বাজার করে দিতে হবে। আশপাশের লোকদের সন্দেহ এড়াতে এসব শর্ত দেওয়া হয়। আবার যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে স্বামীর ভাড়া সবচেয়ে বেশি লাগে। এ কারণে তারাই বেশি ভাড়ায় স্বামী কিনছেন। অনেক নারীর ব্যবসা পরিচালনা বা সম্প্রসারণের কারণে কখনো কখনো ক্ষুদ্র ঋণের প্রয়োজন হয়। কিন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এনজিওগুলো বা নগরীতে সুদের ব্যবসা করে এমন সংস্থাগুলো ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দুই জনের ছবি ও নাম ব্যবহার করে। দুজনকেই ঋণের দায়বদ্ধ করে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একজন পরিচালক বলেন, ‘আমাদের কাছেও এরকম তথ্য আছে। নারীরা ভাড়ায় স্বামী এনে পাসপোর্ট করছেন। তবে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’

এটি প্রতারণার শামিল উল্লেখ করে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি মিডিয়া সোহেল রানা শুক্রবার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে অবশ্যই প্রতারণার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’


ঢাকা/মাকসুদ/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়