ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

হামলার নেপথ্যে কারা?

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৫, ১৯ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হামলার নেপথ্যে কারা?

রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ভয়ংকর হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাই। জঙ্গিরা যেন রক্তের হলি খেলায় মেতে উঠেছিল সেদিন। তাদের হামলায় দুই পুলিশ সদস্য, ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ নিহত হন ২২ জন। ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় এরকম একটি হামলা হবে তা কারও কল্পনাতেও ছিল না।

সে দিনের সেই ভয়ংকর হামলার চিত্র ফুটে ওঠে পুলিশের দেয়া চার্জশিটে। সেই চার্জশিটের আলোকে ঘটনার বিশদ রাইজিংবিডি পাঠকদের জন্য তুলে ধরছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মামুন খান। ধারাবাহিক বর্ণনার আজ দ্বিতীয় পর্ব।

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে দু:সাহসিক হামলা চালানোর নেপথ্যে ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জামাতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) প্রভাবশালী চক্র। যারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। আর সরাসরি হামলায় অংশ নেয় আত্মঘাতি জঙ্গি সদস্যরা।

জেএমবি’র একটি অতি উগ্র গ্রুপ যা নব্য জেএমবি নামে পরিচিতি লাভ করে হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করে। এ সংগঠনটি ১৯৯৮ সালে মূলত শায়খ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। ২০০৪ সালের দিকে জেএমবিতে সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই, আব্দুল আউয়াল, আতাউর রহমান সানিসহ অন্যান্য নেতা আলোচিত ছিল। রাজশাহীর বাগমারা এলাকায় সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে সর্বহারা নিধনযজ্ঞ শুরু হলে দেশব্যাপি আলোচনার ঝড় ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকার জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জেএমবির নেতৃত্ব আরো মরিয়া হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা করে তারা।

হলি আর্টিজান মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছে, সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই, আব্দুল আউয়াল, আতাউর রহমান সানিসহ অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। তখন সাইদুর রহমান জেএমবির আমির হিসেবে দায়িত্ব নেন। ২০১০ সালে সাইদুর রহমানও গ্রেপ্তার হন। এরপর ডাক্তার নজরুল অঘোষিত নেতা হিসেবে সংগঠনের মূল দায়িত্ব পালন করতে থাকে।

এ সময় জেএমবির দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে মামুন ওরফে রিপন, সরোয়ার জাহান, ডাক্তার নজরুল, মামুনুর রশিদ রিপন, অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে অঞ্চল ভিত্তিক উদ্বুদ্ধকরণ মিটিং ও সদস্য সংগ্রহের কাজ করতে থাকে। বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন এলাকায় এ সময় জেএমবির নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ওই সময় জেলখানার ভেতরে থাকা সাইদুর রহমান, সালাউদ্দিন সালেহীন গ্রুপ এবং জেলের বাইরে থাকা ডা. নজরুল ইসলাম, সরোয়ার জাহানের গ্রুপ পরস্পর যোগাযোগ স্থাপন করে জেএমবির নেতৃত্বের মেরুকরণ করার চেষ্টা করে।

২০১৩ সালের শেষের দিকে নেতৃত্বের কোন্দলে সরোয়ার জাহানের নির্দেশে ডা. নজরুলকে দিনাজপুরে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালে সরোয়ার জাহানের নির্দেশে অ্যাডভোকেট ফারুকের নেতৃত্বে জেএমবির একটি দল ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান থেকে আসামি সালাউদ্দিন সালেহীন, হাফেজ মাহমুদ ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানকে ছিনিয়ে নিয়ে জেএমবিকে আরো শক্তিশালী করতে সচেষ্ট হয়।

কিন্তু জেএমবির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর ও পরবর্তীতে নির্বাচিত আমির মাওলানা সাইদুর রহমান গ্রেপ্তারের পর জেএমবির নেতৃত্বের কোন্দল চরমে ওঠে। এ সময় সংগঠনটি আর্থিক ও সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। পুরনো সদস্যদের অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আবার অনেকে অন্য দলে যোগ দিয়ে জিহাদি কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অপেক্ষায় থাকে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ সালে সরোয়ার জাহান ও রিপনের মাধ্যমে জেএমবির সদস্যরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি নতুন সংগঠন তৈরির প্রচেষ্টা শুরু করে। ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে তারা উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাজক, পুরোহিত, মাজারের খাদেম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করতে শুরু করে।

২০১৫ সালের মে মাসের দিকে তামিম আহমেদ চৌধুরীর আহবানে সাড়া দিয়ে জেএমবির একাংশের নেতৃত্বদানকারী সরোয়ার জাহান, মামুনুর রশীদ রিপন ও অন্যান্যরা তামিম চৌধুরীর সাথে একত্রিত হয়ে আইএসের ভাবধারায় জিহাদ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে সরোয়ারের মাধ্যমে তামিম চৌধুরী আইএস এর বিভিন্ন অডিও-ভিডিও  যশোর, বগুড়া, গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থানে বিলি করে।

একই বছরের অক্টেবর মাসে তারা সদস্য সংগ্রহ শুরু করে। এরপর সদস্যদের মিরপুরের কয়েকটি ভাড়া বাসায় রেখে ৩০/৪০ দিন ট্রেনিং করানো হয়। ট্রেনিংয়ে জঙ্গিবাদে উদ্ধুদ্ধ করণসহ জিহাদী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের নিমিত্তে কোরআনের আয়াত ও হাদিসের অপব্যাখা করে বয়ান করা হতো।

হলি আর্টিজানে হামলায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী মীর সামেহ্ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল মিরপুরের বউবাজারের ১৫৯ মধ্য পাইকপাড়ার বাসায় ট্রেনিং নিয়েছিল। এরপর তামিম-সরোয়ার দেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা নিয়ে জেএমবির একাংশ নব্য জেএমবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যার চূড়ান্ত রূপ হলো হলি আর্টিজানে হামলা।

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবি তামিম আহমেদের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে জিহাদ করতে সংকল্পবদ্ধ হয়। তারা হলি আর্টিজানের হামলা ছাড়াও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহে হামলাসহ বিভিন্ন স্থানে টার্গেটেড হত্যা, বোমা/গ্রেনেড হামলাসহ নাশকতামূলক কর্মকান্ড ঘটিয়ে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশেরর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে।

এরই ধারাবাহিকতায় তামিম চৌধুরী, সরোয়ার জাহান, নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, শরিফুল ইসলাম খালেদ, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদ, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, রায়হানুল কবির রায়হান, আসলাম হোসেন র‌্যাশ ও অন্যান্য সদস্য নব্য জেএবির কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। তামিম ও সরোয়ারের নেতৃত্বে ২০১৫ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র, মসজিদের ইমাম, সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের যুবক, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া ছেলে এবং সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত ঢাকার তরুণ ছাত্রদের সংগঠনের সদস্য হিসেবে রিক্রুট করে।

তামিম চৌধুরী তার নিজস্ব লবিং ও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশের ভিতর ও বাইরের বিভিন্ন উৎস হতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে। এর ফলে অল্প সময়ে নব্য জেএমবি আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সংগঠনের মিডিয়া বিভাগ, অর্থ বিভাগ, আইটি বিভাগ নামে কয়েকটি পৃথক বিভাগ চালু হলে সংগঠনের গতিশীলতা আরো বেড়ে যায়। তারা বিদেশী সমমনা সংগঠনের অডিও-ভিডিও এর বাংলা অনুবাদ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে। তাদের সকল প্রচারণাই ধর্মের বিকৃত ব্যাখা সম্বলিত কিন্তু সন্ত্রাসবাদ বিস্তারে সহায়ক।

নব্য জেএমবির হাইকমান্ড রিক্রুটেড সদস্যদের প্রাথমিকভাবে চার সপ্তাহব্যাপী আবাসিক প্রশিক্ষণ (ইনডোর ট্রেনিং) প্রদান করে। তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে স্মল সেল টেরোরিজম কনসেপ্টের আলোকে সংগোপনে কার্যক্রম পরিচালনার শিক্ষা দেয়। প্রধানত আইইডি, গ্রেনেড, চাপাতি এবং ক্ষুদ্রাস্ত্রের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে ৫-৭ জন সাহসী ও বেপরোয়া সদস্যের সমন্বয়ে দল প্রস্তুত করে লক্ষ্যস্থলে হামলার সিদ্ধান্ত নেয়।

এরা বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ছোট ছোট হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের হাত পাকায়। তারা প্রধানত ১. বিদেশী পর্যটক (বিশেষত: সাদা চামড়ার লোক), ২. পুলিশ, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ৩. মন্দিরের পুরোহিত/সেবায়েত ৪. নাস্তিক  (লেখক) ৫. গার্মেন্টস বায়ার ৬. খ্রিস্টান পাদ্রী ও তাদের উপাসনালয়কে কৌশলগত শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে হত্যাযজ্ঞ চালানোয় ব্যাপৃত থাকে।

এরই ধারাবাহিকতায় তামিম আহমেদ চৌধুরীর সার্বিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা সংঘটিত হয়। তাকে এ কাজে সার্বিক সহায়তা প্রদান করে সরোয়ার জাহান মানিক, নুরুল ইসলাম মারজান, আসলাম হোসেন র‌্যাশ, বাশারুজ্জামান চকলেট, মেজর (অব.) জাহিদ, তানভীর কাদেরী, হামলাকারী পাঁচজনসহ অন্যরা।



ঢাকা/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়