ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অহিংস আন্দোলনে কতটা সফল বুয়েট?

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৮, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অহিংস আন্দোলনে কতটা সফল বুয়েট?

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বুয়েট শিক্ষাথীরা সফল হয়েছে তাদের সব ধরনের দাবি আদায়ে। বুয়েটে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে। ছাত্রত্ব বাতিল হয়েছে দোষীদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ দুই মাস আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু ভাঙচুর করেনি। সহিংসতায় জড়ায়নি। মৌখিকভাবেও কোনো অপব্যবহার করেনি। বুয়েটের এই আন্দোলন শিক্ষাঙ্গণের জন্য একটি উদাহরণ। সব ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে সুসম্পর্ক ও বন্ধনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। তবেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তৈরি হবে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ।

গত ৬ অক্টোবর আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নির্মম নির্যাতন করে হত্যার পর আন্দোলনে নামেন   শিক্ষার্থীরা। প্রথমে শিক্ষার্থীরা সাতটি দাবি রেখেছিলেন। তারপরে আরো তিনটি যুক্ত হয়, তবে কয়েক দিন পরে তারা পাঁচটি দাবি বাতিল করেন। শেষ পর্যন্ত তিনটি দাবিতে লড়াই হয়েছে। তাদের অহিংস এ আন্দোলনে শরিক হয় সাবেক শিক্ষার্থীরাও। যোগ দেন শিক্ষকরাও। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে প্ল্যাকার্ড ধারণ করে স্লোগান দেন তারা।

প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র অন্তরা মাধুরী তিথি বলেন, মূলত আমরা একটি নিরাপদ ক্যাম্পাসের জন্য এবং দেশের শীর্ষ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াই করেছি। শুরুতে বুয়েট প্রশাসন আমাদের আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। উপাচার্য আবরারের জানাজায় অংশ নেননি। এরপরে আমাদের প্রতিবাদ তীব্র হয়েছে।

তিনি বলেন, শুরুতে প্রশাসন হত্যার তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আবরার খুনিদের বহিষ্কারসহ আমাদের দাবি পূরণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তবে শিক্ষার্থীরা কারো উপরে আক্রমণ করেনি বা কোনো আপত্তিজনক মন্তব্য করেনি। ১১ অক্টোবর উপাচার্যের সাথে আমাদের বৈঠক হয়েছিল যেখানে তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে আমাদের দাবি পূরণ হবে। আমরা তার কথা শ্রদ্ধার সাথে মেনে নিয়েছি। তিনি উদ্যোগ নিতে দেরি করেছেন। তবে এখন আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ তিনি হত্যাকারীদের বহিষ্কার করেছেন, র‍্যাগিংয়ের সাথে জড়িতদের শাস্তি দিয়েছেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছেন এবং র‍্যাগিংয়ের শাস্তির বিষয়ে লিখিত আইন করেছেন। 

র‍্যাগিং, রাজনীতি, শাস্তি: 

গত ২ ডিসেম্বর জারি করা নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, বুয়েটে কেউ সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি করলে সর্বোচ্চ সাজা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরতরে বহিষ্কার। এতে বলা হয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে জড়িত থাকলে, রাজনৈতিক পদে থাকলে, রাজনীতি করতে কাউকে উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করলে অপরাধ সাপেক্ষে শাস্তি সতর্কতা, জরিমানা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেকোনো মেয়াদে বহিষ্কার।

বিজ্ঞপ্তিতে র‍্যাগিংয়ের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে কয়েক ধাপে। কোনো ছাত্রের মৃত্যুর শাস্তি বুয়েট থেকে বহিষ্কার ও থানায় মামলা দায়ের। কোনো ছাত্র গুরুতর শারীরিক ক্ষতি বা মানসিক ভারসাম্যহীনতার শিকার হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরতরে বহিষ্কার করা হবে।

মৌখিক বা শারীরিক লাঞ্ছনা এবং সাময়িক মানসিক ক্ষতিসহ এ-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি হচ্ছে সতর্কতা, জরিমানা, হল থেকে চিরতরে বহিষ্কার বা একাডেমিক কার্যক্রম থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিরত রাখা। এ ধরনের অপরাধীকে শিক্ষাজীবনে ফিরতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক করে দেওয়া মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাউন্সেলিং করতে হবে।

উপাচার্যের অবহেলা:

বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম মাসুদ বলেছেন, এটি একটি উত্তম লক্ষণ যে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আরও দেরি না করে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে আসতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় উপাচার্য অবহেলা আমরা লক্ষ্য করেছি। ক্যাম্পাসের সুরক্ষায় আমরা যেকোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনে আমরা উপাচার্যের অবহেলামূলক আচরণ দেখা গেছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার কারণেই আবরারের হত্যাকারীরা উত্সাহিত হয়েছিল।

‘আমরা উপাচার্যের পদত্যাগও চেয়েছিলাম। আমাদের প্রতিটি উদ্যোগ ছিল বুয়েটের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। আমরা কেউই উপাচার্য হওয়ার বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে আগ্রহী নই। আমরা শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করছি করবো।’ যোগ করেন অধ্যাপক মাসুদ।

দাবি মেটানো সাধ্যমত চেষ্টা:

বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, তারা শিক্ষার্থীদের দাবি মেটাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

তিনি বলেন, আমরা একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই। এটা সত্য যে, উদ্যোগগুলো দেরিতেই আসছে। এগুলো আরো আগে আসা উচিত ছিল। আমরা শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। আমরা আবরারের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করবো। এছাড়া র্যা গিংয়ে জড়িতদের সবার শাস্তিসহ সব দাবিই মেনে নিয়েছি। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তায় আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি।

শিক্ষাবিদদের মত:

বুয়েটের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর আবদুল মতিন পাটোয়ারী বলেছেন, আমি প্রথমে শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ জানাবো, কারণ তারা তাদের দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছিল। আমাদের বর্তমান সংস্কৃতির ইতিহাসে এটি বিরল।

তিনি বলেন, আমার আমলে ছাত্রদের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। যখনই কোনো অনিয়ম দেখেছি সেটিকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করেছি। সর্বোপরি এই প্রতিবাদে আমি খুব সন্তুষ্ট। আমি মনে করি উপাচার্য বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন এবং বুয়েটের উপকারের জন্য এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমি মনে করি এটি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হতে পারে। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ দুই মাস ধরে আন্দোলন করেছে। তবে কোনো ভাঙচুর বা সহিংসতায় জড়ায়নি। এবং এটাই হওয়া উচিত। তদন্তের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে প্রশাসনের কিছু সময় লাগলেও তারা শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছে। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে সুসম্পর্ক সব সময় বজায় থাকুক। কারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক দূরত্ব থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় শান্তিপূর্ণভাবে চলতে পারে না। এজন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে সুসম্পর্কের বিষয়টি বজায় থাকে সেটিই গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, বুয়েট প্রশাসন সহিংস রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে। তবে সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে জরুরি।

তিনি বলেন, বুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবি আদায় করতে পারার বড় একটি কারণ সরকারের সহযোগিতা। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব উর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে সহযোগিতা ছিল। এটা প্রমাণ করে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক চর্চা চায়। কোনো সহিংসতা পছন্দ করে না।

 

ঢাকা/ইয়ামিন/সাইফ/নাসিম

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়