ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কুষ্টিয়ায় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি লুটের কারিগর ২ ঊর্ধ্বতন

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৮, ১২ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কুষ্টিয়ায় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি লুটের কারিগর ২ ঊর্ধ্বতন

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বরাদ্দকৃত প্রায় ১৫ কোটি টাকা লুটপাটের সঙ্গে জড়িতরা সনাক্ত হয়েছে।

হাসপাতালের জন্য ক্রয়কৃত একটি অ‌্যানেস্থেশিয়া মেশিনে অন্তত ৫০ লাখ টাকা লুটপাটের প্রমাণ মিলেছে। মেশিনের বাজার মূল্য যেখানে ১৪ থেকে ১৭ লাখ টাকা, সেখানে ভিন্ন ব্রান্ডের দোহাই দিয়ে ওই সিন্ডিকেট ক্রয় মূল্য দেখিয়েছে প্রায় ৭২ লাখ টাকা।

এছাড়া পালস অক্সিমিটারের মেশিনে অন্তত ২৩ লাখ ও ডায়াথারমি মেশিনে সাত লাখ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। এভাবে আরো ‍লুটপাট হয়েছে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও ওষুধ ক্রয়ে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব তদন্তেই এর প্রমাণ মিলেছে।

এই লুটপাটের প্রধান কারিগর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার এক ডাক্তার ও কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান কিংবা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে তৈরি করা তদন্ত রিপোর্টে তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে।

যদিও বেশ আগেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। তাদের তদন্ত কমিটি মূলত কুষ্টিয়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার মো. আব্দুল মোমেন ও কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাক্তার আবু সালেহ মোহাম্মদ মুসা কবিরকে দায়ী করে।

একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে সরকারি চাকরির বিধিমালা ২০১৮ এর ৩ (খ) ও ৩ (ঘ) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের সই করা চিঠি ও তদন্ত রিপোর্টের কপির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি তদন্তের ওই রিপোর্ট দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। যার একটি অনুলিপি রাইজিংবিডির কাছে রয়েছে।

‘অভিযোগনামা’ শীর্ষক পৃথক চিঠিতে তাদেরকে কারণ দর্শাতেও বলা হয়েছিল বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে দুদক পরিচালক ও অনুসন্ধান টিমের তদারককারী কর্মকর্তা কাজী শফিকুল আলমের কাছে জানতে চাইলে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।

রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যের দুর্নীতি নিয়ে দুদকের একটি টিম কাজ করছে। ইতোমধ্যে ফরিদপুর ও সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি হাসপাতালের দুর্নীতির নিয়ে বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে। তবে এ বিষয়টি এখনো যেহেতু অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে, তাই কোনো বক্তব্য দেয়া সম্ভব নয়।’

তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, দুদকের অনুসন্ধানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের বাইরেও আরো বেশ কয়েকজন চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগিরই এ বিষয়ে মামলার প্রক্রিয়া যাচ্ছে সংস্থাটির অনুসন্ধান টিম। সংস্থাটির উপ-পরিচালক শাসছুল আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ওই হাসাপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ভয়াবহ অনিয়মের অভিযোগ উঠলে ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল তদন্তের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

যার স্মারক নং ৪৫.১৫৫.১৪৪.০০.০০২.২০১৫-২১২। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব রজিয়া খাতুনের নেতৃত্বে ওই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাখালী উপ-পরিচালক ডাক্তার কে এম তারিক ও সহকারী পরিচালক ডাক্তার এবিএম মশিউল আলম।

কমিটির সদস্যরা ওই বছরের ২৩ মে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। সেসময় ক্রয়কৃত এমএসআর সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি যাচাই করতে স্টোরও পরিদর্শন করে। ক্রয়কৃত ওষুধ রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে কি না তাও যাচাই করে দেখে ওই কমিটি।

২০১৮ অর্থবছরে এইচ পি এন এস পি এর অধীন হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট (এইচ এস এম) অপারেশন প্লানে আরপিএফ খাতে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ হতে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তিতে ক্রয়কৃত এম এস আর সামগ্রী ও যন্ত্রপাতিসমূহ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন শীর্ষক রিপোর্ট ২০১৯ সালের জুলাই মাসে দাখিল করা হয়।

ওই তদন্ত রিপোর্ট সূত্র বলছে, রেজিস্টার ক্রয়কৃত যন্ত্রপাতির লিপিবদ্ধ করা হলেও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়নি। পরিদর্শনকালে দৈব চয়ন ভিত্তিতে বিভিন্ন আইটেম পরীক্ষা করা হয়।

পরিদর্শনে অ‌্যানেস্থেসিয়া মেশিনটি কাগজপত্রে ইউকে (ইউনাইটেড কিংডম) লেখা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সেটি ইউএসএ (ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা) অ্যাসেম্বল দেখতে পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ যন্ত্রপাতি অনেকটা গাদাগাদি করে সংরক্ষণ করা হচ্ছে বিধায় যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মেডিক্যাল সার্জিক্যাল সাপ্লাই খাতে মোট চারবার দুই কিস্তিতে অর্থ ছাড় করা হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ১ আগস্ট দুই কোটি টাকা ও চার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। একইভাবে ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর মেডিক‌্যাল অ‌্যান্ড সার্জিক্যাল সাপ্লাই খাতে তিন কোটি টাকা এবং যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম খাতে চার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। ব্যয় মঞ্জুরী ও প্রশাসনিক অনুমোদনে প্রায় একই পরিমাণ অর্থ প্রদান মতামত দেওয়া হয়।

আরো জানা যায়, ডেনমার্কের তৈরি একটি অ‌্যানেস্থেশিয়া মেশিনের বাজার মূল্য ১৭ লাখ ১৮ হাজার ২১৫ টাকা ও জার্মানির তৈরি মেশিনের বাজার মূল্য ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৮১৬ টাকা। অথচ মেশিনটির ক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে ৭১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বিশাল অংকের সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি মনে করে।

এছাড়া ইউকে-তে (ইউনাইটেড কিংডম) তৈরি পালস অক্সিমিটার মেশিনের মূল্য দেখানো হয়েছে ২৫ লাখ টাকা, যেখানে কোরিয়ার তৈরি একই মেশিনের বাজার মূল্য ৪৬ হাজার ৭২৬ টাকা থেকে এক লাখ ৩৯ হাজার ৪০ টাকা। কোরিয়ার তৈরি ডায়াথারমি মেশিনের ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ১১ লাখ ১০ হাজার টাকা। ওই মেশিনটির বর্তমান বাজার মূল্য চার লাখ ৭৭ হাজার ৮২৫ টাকা পায় তদন্ত কমিটি।

এছাড়া তদন্ত কমিটির পরিদর্শনে এমএস আর খাতে বরাদ্দকৃত সাত কোটি নিরানব্বই লাখ টাকার মধ্যে প্রাপ্যতা অনুসারে প্রায় দেড় কোটি টাকা ইউডিসিএল বহির্ভূত ওষুধ ক্রয় করা হয়েছে। বিষয়টি বিধিসম্মত হয়নি বলে মনে করে তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এমএসআর ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিভাজন অনুযায়ী ওষুধ সামগ্রী ক্রয় করা হয়নি, ক্রয়কৃত আইসিইউ বেড এখনো ব্যবহারের জন্য স্থাপন করা হয়নি।

অথচ এসব মেশিন দ্রুততার সঙ্গে স্থাপন করা জরুরি ছিল। বাজার দর যাচাইকালে অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ক্রয় মূল্য বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে ক্রয় করা হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি মনে করে।

সর্বশেষ ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের স্বাক্ষরে এক চিঠিতে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার মো. আব্দুল মোমেন ও কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাক্তার আবু সালেহ মোহাম্মদ মুসা কবিরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

পৃথক পৃথক পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, “২০১৮-১৯ অর্থবছরে হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট অপারেশনের আরপি এখাতে বরাদ্দকৃত অর্থ হতে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের অনুকূলে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তিতে প্রীত ১৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দ্বারা ক্রয় করা এম এস আর সামগ্রী ও ভারী যন্ত্রপাতি সমূহের অনিয়মের সাথে জড়িত ছিলেন যা তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।

‘আপনার উল্লেখিত কার্যকলাপ সরাসরি সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা পরিপন্থী এবং সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ২০১৮ এর ৩ (খ) ও ৩ (ঘ) বিধি মোতাবেক যথাক্রমে অসাধারণ দুর্নীতি হিসেবে গণ্য।”

বৃহত্তর কুষ্টিয়ার সাধারণ মানুষের চিকিৎসা কথা বিবেচনায় নিয়ে ১৯৬২ সালে হাসপাতালটির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে ১০০ শয্যা নিয়ে হাসপাতাল চালু হয়। ২০০০ সালে ১৫০ শয্যায় এবং ২০০৭ সালে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল।

 

ঢাকা/এম এ রহমান/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়