ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হাসপাতালের ফার্নিচারেই দেড় কোটি টাকার ঘাপলা!

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৪, ১৯ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাসপাতালের ফার্নিচারেই দেড় কোটি টাকার ঘাপলা!

ছবি: ইন্টারনেট

সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ তিন প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র ও খেলার সামগ্রী ক্রয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার ঘাপলা বেরিয়ে এসেছে।

প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি), মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) ও সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক তদন্তে কোনো ঘাপলা হয়নি   বলে মতামত দেয়া হয়েছিল। দুর্নীতিবাজদের বাঁচাতে গণপূর্ত থেকে এমন দায়সাড়া প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল বলে দুদক অনুসন্ধান টিমের প্রাথমিক ধারণা।

এসব বিষয় মাথায় রেখে তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ড. এস এম হেলাল উদ্দিন, মো. এমদাদুল হক, বদরুল হাসান ও মো. মাহফুজ আলমকে রোববার দিনব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদকের উপপরিচালক মো. শামছুল আলমের নেতৃত্বে অনুসন্ধান টিম।

তবে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া যায়নি তাদের কোনো সদত্তোর। বরং অধিকাংশ সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে অসামাঞ্জস্য উত্তর দিয়েছে। একই সঙ্গে সরেজমিনে অনুসন্ধান না করেই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল বলে পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছে গণপূর্তের প্রকৌশলীরা।

এ বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক মো. সামছুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন।

বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন ও দুদক সূত্রে আরো জানা যায়, ওই তিন প্রতিষ্ঠানে মেসার্স বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চার কোটি ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭২০ টাকার খেলার সামগ্রী ও আসবাবপত্র সরবরাহের দায়িত্ব পায়। যেখানে ম্যাটসে দুই কোটি ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮১০ টাকার এবং আইএইচটিতে দুই কোটি ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯১০ টাকার আসবাবপত্র ও খেলার সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। ট্যাক্স ও ভ্যাট বাদ দিলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি নিট বিল নেয় তিন কোটি ৭৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬০ টাকা। যার মধ্যে নয়ছয় মিলেছে প্রায় দেড় কোটি টাকা।

দুদক জানায়, গত ডিসেম্বরে গণপূর্তের কাঠের কারখানা উপ-বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাহফুজ আলমের নেতৃত্বে একটি টিম আসবাবপত্র ও খেলার সামগ্রীর ক্রয়ের একটি তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে জমা দেয়। প্রতিবেদন জমা দিলেও ফার্ণিচার ও খেলার সামগ্রী ক্রয়ে কোনো নয়ছয় হয়নি বলে ঠিকাদার ও সরবরাহকৃত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মত দেয়। ওই তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে দুদক অনুসন্ধান টিমের সন্দেহ হয়। এরপরই সংস্থাটি বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনকে এ বিষয়ে পৃথক আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দরপত্র, ক্রয়কৃত আসবাবপত্র ও খেলার সামগ্রী যাচাই করার জন্য অনুরোধ করা হয়।

দুদকের অনুরোধে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের কার্যপরিদর্শক আজিমুদ্দীন রায়হানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপরই তদন্তে পণ্যসামগ্রী ক্রয় ও সরবরাহে বড় ধরনের ফারাক ধরা পড়ে। প্রাথমিক পর্যরবেক্ষণে প্রায় দেড় কোটি টাকার ব্যবধান বেরিয়ে এসেছে বনশিল্প করপোরেশনের তদন্তে। তদন্ত রিপোর্ট গত ১৫ জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।

অনুসন্ধানের স্বার্থে এর আগেও ২০১৯ সালের ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানগুলোর মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) অধ্যক্ষ ডা. তওহীদুর রহমান ও স্টোর কিপার মামুন-অর-রশীদ, সাতক্ষীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শেখ আকছেদুর রহমান, ডা. মো. আব্দুল লতিফ, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. শেখ তৈয়েবুর রহমান, ডা. মো. মেহেদী হাসান ও ঢাকার নিমিউ অ্যান্ড টিসির সহকারী প্রকৌশলী এএইচএম আব্দুল কুদ্দুসের বক্তব্য নেয় দুদক।

সাতক্ষীরা হাসপাতালসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চমূল্যে যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও খেলার সামগ্রী ক্রয়ে সাড়ে ২২ কোটি টাকার পুকুর চুরির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এর আগে পণ্যসামগ্রী ক্রয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষজ্ঞ টিমের সমন্বয়ে তদন্ত প্রতিবেদন সংগ্রহের পাশাপাশি ও দুদক টিম গত সেপ্টম্বরে সরেজমিন অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধান টিমের অপর সদস্য হলেন- উপ-সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান ও ফেরদৌস রহমান।

অভিযোগের বিষয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরা কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি) ও মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) নামে দুটি প্রতিষ্ঠানে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার ফুটবলের সরকারি ক্রয়মূল্য ছিল পাঁচ হাজার টাকা। এক থেকে দেড় হাজার টাকার স্টেথোস্কোপ ও বিপি (ব্লাড প্রেসার মাপার) মেশিনের দাম ধরা হয়েছে ৯ হাজার টাকা। একটি ক্রিকেট ব্যাটের ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। এভাবেই সরকারিভাবে উচ্চমূল্যে প্রায় সাড়ে ২২ কোটি টাকার খেলার সামগ্রী, বইপত্র, আসবাবপত্র ও স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমানসহ হাফ ডজনের বেশি সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য উচ্চমূল্যে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা যায়, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কালিগঞ্জের নলতা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি) ও মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) নামক দুটি প্রতিষ্ঠানে এসব সামগ্রী ক্রয়ের জন্য গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়। এর মাধ্যমে ঢাকার উত্তরার মেসার্স বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শাহিনুর রহমান, শ্যামলীর নলতা শরিফ সার্জিক্যালের স্বত্বাধিকারী তরিকুল ইসলাম ও পুরানা পল্টনের মেসার্স ইউনিভার্সাল ট্রেড করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী আসাদুর রহমান দায়িত্ব পান। যেখানে মূল্যায়ন কমিটিতে ছিলেন ম্যাটস ও আইএইচটির তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান, কমিটির সদস্য ডা. আকছেদুর রহমান, ডা. আব্দুল লতিফ, শেখ আব্দুল আলিম, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রহমান, আরএমও কালিগঞ্জ ডা. শেখ তৈয়েবুর রহমান ও দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মেহেদি হাসান।


ঢাকা/এম এ রহমান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়