ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কলেজে ভর্তি না হয়েও পাস করা যায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং!

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২০ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কলেজে ভর্তি না হয়েও পাস করা যায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং!

বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা বাড়ছে।  দেশের কর্মবাজারেও চাহিদা বাড়ছে কারিগরিভাবে প্রশিক্ষিত জনবলের।  যে কারণে গত কয়েক বছরে কারিগরি খাতে শিক্ষার্থীর হার বেড়েছে।  হতাশার বিষয়, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জালিয়াতির সংখ্যা।

কারিগরি শিক্ষাখাতের অধীনে পরিচালিত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থী বাড়ার হার পর্যালোচনায় এ ধরনের বেশকিছু জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।  জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি পলিটেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান এবং বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

খোঁজ নিয়ে গত শিক্ষাবর্ষে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডিপ্লোমা ইন হেলথ ট্রেডের বেশকিছু শিক্ষার্থীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা ভালো ফল করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, অথচ তারা এসব ট্রেডের শুরুতে ভর্তিই হননি।  এমনকি ছেলে শিক্ষার্থীর নাম বদলে মেয়ের নাম দেয়ারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে পাস করেছেন মেহেদী হাসান।  বাবার নাম মো. মিজানুর রহমান, মায়ের নাম মোসাম্মদ বিথী খাতুন।  মেহেদী হাসানের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ছিল ৮৩৮৭৪৩।  কিন্তু কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে সংরক্ষিত ডেটাবেজ থেকে জানা গেছে, এই রেজিস্ট্রেশন নাম্বারে এই ট্রেডে যে ভর্তি হয়েছিলেন তার নাম মো. ইলিয়াস হোসেন।  পিতা ও মাতার নামও ভিন্ন।  একইভাবে দেশ পলিটেকনিক কলেজ থেকে ৮২৮০১১ রেজিস্ট্রেশন নাম্বারে পাস করেছেন আশিকুর রহমান।  বোর্ডের তথ্য বলছে, এই রেজিস্ট্রেশন নাম্বারে দেশ পলিটেকনিকে ভর্তি হয়েছিলেন মো. মাহবুবুল আলম নামে এক শিক্ষার্থী।

ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডিপ্লোমা ইন হেলথ ট্রেডে রেজিস্ট্রেশনের আগে ও পরে রিপ্লেস করা নামের সারণী

২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে নর্দান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হয়েছিলেন প্রত্যয় বড়ুয়া বাবু (৮২৭৯১১)।  কিন্তু সেই রেজিস্ট্রেশনে পাস দেখানো হয়েছে আবদুল মালেক সরকারকে।  পারক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে একই সেশনে ভর্তি হন জাকারিয়া (৮২৪২৭২)।  কিন্তু পাস দেখানো হয় সুজনচন্দ্র দাসকে।

ডিপ্লোমা ইন হেলথ ট্রেডে গাজীপুর মেডিকেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন মেহেদী হাসান জয় (৮৯৩৩৯৪)।  কিন্তু চূড়ান্ত ফলে শিক্ষার্থীর লিঙ্গ পরিবর্তন করে একই রেজিস্ট্রেশনে একজন মেয়ে শিক্ষার্থী পাস করেছে দেখানো হয়েছে।  শিক্ষার্থীর নাম মুক্তা আক্তার।  একইভাবে মনোয়ারা মেডিকেল টেকনোলজি কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের শিক্ষার্থী তন্নী আক্তারের (৮৯৩১৮২) রেজিস্ট্রেশনে পাস দেখানো হয়েছে মনিরা আক্তার মলিকে। একই প্রতিষ্ঠানের ফারিয়া আক্তারের ক্ষেত্রে (৮৯৩১৯৪) পাস দেখানো হয়েছে বিথি আক্তারকে।

জানা গেছে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে ৩য়, ৪র্থ, ৫ম বা ৬ষ্ঠ পর্বে গিয়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পরিবর্তে রেজিস্ট্রেশন ও রোল নাম্বার ঠিক রেখে অন্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এই বিষয়টিকে বলা হয় ‘রিপ্লেস’।  খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিপ্লেস বোর্ডে বিশাল এক ধরনের বাণিজ্যের নাম।  সেমিস্টারের মাঝপথেই মূলত টাকার বিনিময়ে রিপ্লেস করা হয়।  আবার এমনও দেখা গেছে, কোনো কারণে রিপ্লেস করা না গেলে, পরীক্ষার পর সংশোধনের আবেদন উপস্থাপন করে রিপ্লেস সম্পন্ন করে একটি চক্র।

জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাস করানোর ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক নাম্বার বাড়িয়ে পাস দেখানো হয়।  এক্ষেত্রে নাম্বার বাড়িয়ে দেয়া হয় ফলাফল নথিভুত্ত করার সময়।  সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ বিষয়ে নাম্বার বাড়িয়ে পাশ করানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ডিপ্লোমা পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে পাশ করানো শিক্ষার্থীদের রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বরসহ বিষয় কোড

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই চক্রের পুরো কনট‌্যাক্ট থাকে নাম রিপ্লেস করা থেকে শুরু করে পাস করানো পর্যন্ত।  পুরো প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে টাকা নেয় দালাল চক্র।  দালাল চক্রের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে রয়েছেন কারিগরি বোর্ডের এইচএসসি ডিসেপ্লিনের বিএম ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে থাকা প্রোগ্রামার ওমর ফারুক।  তিনি মাস্টাররোল ভিত্তিতে বোর্ডে থাকলেও তার প্রতাপ স্থায়ী কর্মকর্তাদের চেয়েও বেশি বলে জানা গেছে।  অভিযোগ রয়েছে, ওমর ফারুক বোর্ডের কম্পিউটার সেলের এক কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠজন।  মূলত ওমর ফারুকই বিভিন্ন কারিগরি প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন।  এরপর তিনি কাজের খোঁজ নিয়ে যান কম্পিউটার সেলে।  সেল থেকেই হয় যাবতীয় কর্ম সাধন।

এ প্রসঙ্গে ওমর ফারুকের কাছে জানতে চাইলে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।  কথোপকথনের এক পর্যায়ে প্রমাণ হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার এ ব‌্যাপারে যোগাযোগের প্রমাণ দেখালে তিনি এড়িয়ে যান।  এরপর একাধিকবার এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি সংক্ষেপে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই’।

কম্পিউটার সেলের কর্মকর্তাদের মধ্যে অভিযোগের তীর সরাসরি প্রধান সিস্টেম এনালিস্ট প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামসুল আলমের বিরুদ্ধে।  এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে ডিপ্লোমা উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শাহিন কাউসার এবং তার দপ্তরের কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধেও।  মোহাম্মদ শামসুল আলমের বিরুদ্ধে বর্তমানে কিছু অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত চলছে।  গত বছরের ১৪ অক্টোবর রাইজিংবিডি ডটকম-এ প্রকাশিত ‘টাকায় মেলে এসএসসি’র রোল-রেজিস্ট্রেশন!’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এই তদন্ত কমিটি গঠন হয়।  কমিটি এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ শামসুল আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।  এসবের কিছুতেই আমি জড়িত নই।’ 

ডিপ্লোমা পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে পাশ করানো শিক্ষার্থীদের রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বরসহ বিষয় কোড

অন‌্যদিকে বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাইজিংবিডিকে বলেন, শামসুল আলম বোর্ডের কম্পিউটার সেলের প্রধান সিস্টেম এনালিস্ট।  তার জানার বাইরে শুধু অসাধু কাজ নয়, ভালো কাজ হওয়াও সম্ভব নয়। তারা সুষ্ঠু তদন্তের জন্য শামসুল আলমকে দায়িত্বের বাইরে রেখে তদন্ত পরিচালনার দাবি জানান।  তাদের যুক্তি- যেহেতু তিনি বোর্ডে প্রভাব খাটান, তাকে স্বপদে রেখে বা কমিটিতে রেখে তদন্ত করলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে না।

সামগ্রিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সচিব মো. মাহাবুবুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, এ ধরনের অপতৎপরতায় কেউ জড়িত থাকলে অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বর্তমানে পরিচালিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ হচ্ছে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহাবুবুর রহমান বলেন, সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একটু সময় লাগছে।  আশা করি শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন জমা হবে।

** টাকায় মেলে এসএসসি’র রোল-রেজিস্ট্রেশন!


ঢাকা/হাসান/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়