ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

রেলের ৮০০ একর জমি দখল করে দুই হাজার বাড়ি!

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫০, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রেলের ৮০০ একর জমি দখল করে দুই হাজার বাড়ি!

সারা দেশেই রেলওয়ের সম্পত্তি বেদখল হওয়ার খবর পাওয়া যায়। কিন্তু নিজ দপ্তরের কর্তা ব্যক্তিদের অপকৌশলে বেহাত হওয়ার ঘটনা খুব বেশি চোখে পড়ে না।

কিন্তু নীলফামারি জেলার সৈয়দপুরে শুধু বেহাত বললে কম বলা হয়। সেখানে চলছে সরকারি জমি দখল করে রীতিমতো সুউচ্চ ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা।

সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্রায় আটশ একর জমি দখল করে নির্মাণ হয়েছে দুই হাজারের বেশি দুই তলা থেকে চার তলা পাকা বাড়ি।

১৯৬৯ সালে স্টেশনের ২৬ একর জমিতে ছিল রেলওয়ে শপিং সেন্টার। বাকি জমিতে ছিল না কোনো স্থাপনা। শপিং সেন্টারটি দেখা-শোনা করতো রেলওয়ে ষ্টেশনের একটি কমিটি। দখলকারীরা এক সময় ওই শপিং সেন্টারও ভেঙ্গে ফেলে নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করে। হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি এক টাকাও।

দখলদারদের তালিকায় আছে স্থানীয় প্রশাসন, চেয়ারম্যান, রেলওয়ের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার। বারবার অভিযোগ করলেও হয়নি পুনরুদ্ধার।

এমনকি দুই দফায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করেও বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি। সর্বশেষ দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি টিমের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।

অনুসন্ধানকালে অভিযোগের সত্যতা পেলেও দখলদারিদের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরাসরি কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

সম্প্রতি কমিশনের ওই টিম অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করে। সেখানে টিমের সুপারিশে বাংলাদেশ রেলওয়ে, সৈয়দপুর পৌরসভা, ভূমি অফিস ও স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্ব অবহেলাকে দায়ী করা হয়। একই সাথে একটি যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন বিষয়টি আরো অধিকতর তদন্ত করার জন্য টিম সুপারিশ করেছে।

অনুসন্ধানকালে সৈয়দপুর রেলওয়ে কার্যালয়ের নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, দুই হাজার চারশ ৯৯টি রেলওয়ে কোয়ার্টারের দখলদার পাওয়া যায়। এর মধ্যে নয়শজন বৈধ দখলদার, দুইশ ৬৯ জন অবৈধ দখলদার, একহাজার তিনশ ৩০ জন বহিরাগত দখলদার হিসেবে ভোগ দখল করে আসছে।

সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন ও তার আশে পাশের এলাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ের সাতশ ৯৮ দশমিক ৯৯ একর জমি রয়েছে। এখানে ১৯৭০ সালে প্রায় ১১০ একর জমির উপর দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা অবস্থিত। ১৯৬৯ সালে রেলওয়ে কর্মচারীদের সুযোগ সবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে সৈয়দপুর শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে ২৫ দশমিক ৫০ একর নিজস্ব ভূমির উপর রেলওয়ে শপিং সেন্টার স্থাপিত হয়। যা রেলওয়ে স্টেশন কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হত।

তবে সরকারি এক আদেশের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালের ৩০ নভেম্বর সৈয়দপুর স্টেশন কমিটির পরিবর্তে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও সৈয়দপুর পৌরসভার মধ্যে ৬০ ও ৪০ শতাংশ ভাগে রাজস্ব বন্টনের ভিত্তিতে রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা দিয়ে একটি চুক্তিপত্র হয়। মূলত এরপর দখলের রাজত্ব তৈরি হয়।

২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল স্থানীয় সাংবাদিক মোতালেব হোসেনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গণশুনানি আয়োজন করেছিল দুদক। তার অভিযোগে বলেছিলেন- সৈয়দপুর রেলওয়ের মূল্যবান বাসা, কলোনি, ফাঁকা জায়গা একের পর এক দখল করে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। আর এ কাজে সহযোগিতায় নেমেছেন রেলওয়ের তৌহিদুল ইসলাম ও পৌর কর্তৃপক্ষের একটি সিন্ডিকেট। তারা গোপন আতাঁত করে হাতিয়ে নিচ্ছেন শত শত কোটি টাকা। অথচ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকার এক টাকাও পাচ্ছে না।

অবৈধ দখলদাররা এতই বেপরোয়া যে রেলওয়ের বহুবর্ষী জীবিত গাছ কেটে ফেলছে। স্থানীয় সকল প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে পুলিশের কাছে মামলা দিলেও তা গ্রহণ করা হয় না। তাই আমার আবেদন দেশের সম্পত্তি রক্ষা ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গণশুনানির মাধ্যমে মুখোমুখি করা প্রয়োজন।

এরই ধারাবাহিকতায় দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল।

২০১৮ সালে দুদকের দিনাজপুর কার্যালয় থেকে অভিযোগটি অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধান পর্যায়ে দিনাজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. বেনজীর আহম্মদ দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে টিম গঠন করে অনুসন্ধান করার জন্য সুপারিশ করেছিল।

মোত্তালেব হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, গণশুনানিতে লিখিত অভিযোগ করার পর দুদক অনুসন্ধান শুরু করলেও আজ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি দখল। বরং স্থানীয় একটি বাহিনীর নেতৃত্বে চলছে সরকারি জমি বিক্রি ও দখলের প্রতিযোগিতা। দুদকও আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এ বিষয়ে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলওয়ার বখতের কাছে জানতে চাইলে তিনি বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন।

যদিও দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, 'যারা মাদকের ব্যবসা করছেন, সন্ত্রাস করছেন, যারা সরকারি সম্পত্তি বেদখল করছেন, অবৈধ সম্পদের মালিক হচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছি এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। শুধু মেট্রোপলিটন কেন্দ্রিক নয়, আমরা চাই, মাঠ পর্যায়ে ব্যবস্থা নিতে।’


ঢাকা/এম এ রহমান/জেনিস

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়