ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মাইনাস টু, এরপর কে?

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৫, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাইনাস টু, এরপর কে?

দলের সাংগঠনিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা আওয়ামী লীগ তার উন্নয়নের ভিশনগুলো বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনগুলোতে এমন নেতৃত্ব উঠিয়ে আনতে চাইছে, যারা সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে। যার ধারাবাহিকতায় ঢাকার পর বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেও নতুন নেতৃত্ব এনেছে দলটি।

দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সিটি করপোরেশনে দলটির এই নেতৃত্বের পরিবর্তন যেমন প্রশংসা পাচ্ছে, তেমনি পরপর দুজন মেয়র দলীয় মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়ায় নেতাকর্মীদের কৌতুহল- এরপর মাইনাস হচ্ছেন কে? অন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতেও দলের সিদ্ধান্ত কী হতে পারে, সেটি নিয়ে এখনই আলোচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে মিলিয়ে কেউ কেউ হিসাব-নিকাশ করছে ওইসব সিটিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা কতটুকু?

প্রথমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সাঈদ খোকনের পরিবর্তে ক্লিন ইমেজ ও তার সাবেক সংসদীয় আসনে তুমুল জনপ্রিয় শেখ ফজলে নূর তাপসের ওপর আস্থা রেখে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। বিপুল ভোটে জিতে সেই আস্থার প্রতিদানও দেন তিনি। সর্বশেষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও চমক দিয়েছে দলটি। বর্তমান মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দিনকে হটিয়ে দল আস্থা রেখেছে রেজাউল করিম চৌধুরীর উপর।

দলের দায়িত্বশীল নেতারা দুই সিটি করপোরেশনের এই পরিবর্তনকে ধারাবাহিকতা বললেও সূত্রগুলো বলছে, পরপর দুজন প্রভাবশালী মেয়র দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার পেছনে যেমন ব্যর্থতা আছে, তেমনি আছে সংগঠন ও দলে বিভেদ তৈরি করার অভিযোগ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন নগরবাসীর জনপ্রিয়তার প্যারামিটারে আছেন একেবারে তলানীতে। তার বেফাঁস কথাবার্তা আর কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগ সরকারকে বারবার বিব্রত করেছে। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ এটি।

সাঈদ খোকন তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলে মনে করেন নগরবাসী। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ট্রলের শিকারও হয়েছেন তিনি। গতবছর ছেলে ধরা আতঙ্ক আর মহামারি ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে অপ্রত্যাশিত কিছু বক্তব্য আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলদেরও বেশ বিব্রত করেছে।

দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার পাশাপাশি মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ ভালো চোখে দেখেনি দলের দায়িত্বশীলরা। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর আজিমপুরের পার্ল হারবাল কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন আওয়ামী লীগের কর্মী সমাবেশের পাশে পাল্টা কর্মসূচি দেন সাঈদ খোকন। ওই সমাবেশের সামনে ট্রাকে করে সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলার ঘটনায় তাকেই দোষারোপ করা হয়। ওইসময় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ও মেয়র খোকনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দলীয়ভাবে ব্যাপক সমালোচিত হয়। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে বিভেদের রাজনীতিসহ এমন আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে। আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্ক তাকে দলীয় মনোনয়নের দৌড়ের ট্রাক থেকে ছিটকে দেয়।

সাঈদ খোকনের মনোনয়ন না পাওয়ার দেড় মাসের মাথায় দলীয় আস্থা হারান আরেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। যিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে আছেন। নাছিরের মনোনয়ন না পাওয়া নিয়েই এখন চায়ের কাপে ঝড়। নেতাকর্মী থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন- কেন মনোনয়ন পেলেন না নাছির উদ্দিন?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাঈদ খোকনের মতো নাগরিক স্বার্থ সংরক্ষেণে ব্যর্থ নাছিরও জড়িয়ে পড়েছিলেন দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদ আর সংঘর্ষের রাজনীতিতে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে বিভক্তি আর অন্তর্কোন্দলের জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। নগর পিতা হিসেবে এবং স্থানীয় রাজনীতিতে তার কর্মকাণ্ডে বিব্রত দলের হাইকমান্ডও।

চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত এমন নেতাকর্মীরা বলছেন, ২০১৫ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো একজন দক্ষ রাজনীতিবিদকে বাদ দিয়ে যে প্রত্যাশা নিয়ে নাছিরকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছিল, সেই প্রত্যাশার পালে হাওয়া লাগাতে পারেননি তিনি। সেখানে জলাবদ্ধতা নিরসনকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেন সেখানকার জনগণ।

নাছিরের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া হলেও কার্যত তিনি এই কাজে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করেন নগরবাসী। এছাড়া সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের নামে ফুটপাতে অপরিকল্পিত স্থাপনা, সিটি করপোরেশনে বিভিন্ন পদে নিয়োগের অনিয়ম নাছিরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তার মেয়াদে সিটি করপোরেশনের সড়কগুলোর সংষ্কার কাজও ঠিকমতো করতে পারেননি তিনি।

নেতাকর্মীদের পর্যবেক্ষণ, সাঈদ খোকনের মতোই একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সমালোচিত হয়েছেন নাছিরও। দল ও দলের বাইরে দায়িত্ব পালনের জায়গায় তাদের এই কর্মকাণ্ড দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে তাদের অবস্থান নষ্ট করে দিয়েছে। যে কারণে মেয়াদের পুরো পাঁচ বছরেই ‘অতিরিক্ত সচিব’ পদমর্যাদায় মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন চট্টগ্রামের সিটি মেয়র নাছির উদ্দিন। অথচ কম গুরুত্বপূর্ণ সিটির মেয়রদেরকেও প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, মেয়রের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন নাছির। যেটা ভালো চোখে দেখেনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনের সাংসদদের সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তিনি। দলীয় কোন্দলের জেরে গত পাঁচ বছরে নগরে নিজেদের মধ্যে খুন হয়েছে অন্তত পাঁচ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। সংগঠনে এই কোন্দল জিইয়ে রাখার জন্য নাছিরকেই দায়ী করা হয়। প্রবীণ নেতাদের মূল্যায়ন না করার পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিতে তার প্রতিপক্ষ সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের কোনঠাসা করে রাখেন তিনি।

সর্বশেষ গত বছরের অক্টোবরে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সভায় মহিউদ্দিন-পত্নী হাসিনা মহিউদ্দিনকে মঞ্চ থেকে অশোভনভাবে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দেন তিনি। এই কর্মকাণ্ড তাকে বেশ বিতর্কিত করে তোলে। বলা হচ্ছে, রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ভুলটি নাছির উদ্দিন সেদিনই করে ফেলেন।

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের চোখ এখন ভিশন ২০২১, ২০৪১, ২১০০-এ। এজন্য দলকে শক্তিশালী করতে এবং উন্নয়ন পরিক্রমাগুলো বাস্তবায়নে বিতর্কিত ও অযোগ্যদের মাইনাস করা হবে। দল এবং সরকারেও এই অভিযানগুলো চলবে। মন্ত্রীসভায় বড় রদবদল বা অন্য সিটি করপোরেশনেও বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কপাল পুড়তে পারে এই মানদণ্ডে। ওইসব সিটি করপোরেশনেও আসতে পারে নতুন নেতৃত্ব।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘নেতৃত্ব পরিবর্তন একটা স্বাভাবিক ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এখানে অনেক সমীকরণ থাকে। নির্বাচনমুখী রাজনীতিতে জনগণের কাছে নেতার গ্রহণযোগ্যতা, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, জয়ের সম্ভবনা-এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থী ঠিক করতে হয়। একই সঙ্গে দেখা হচ্ছে আওয়ামী লীগের আগামীর উন্নয়ন ভিশন বাস্তবায়নে কোন নেতৃত্বের সক্ষমতা কেমন। এসব বিবেচনায় কেউ এগিয়ে যান, কেউ পিছিয়ে যান।’


ঢাকা/পারভেজ/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়