ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

৭ মার্চের স্মৃতিবিজড়িত ‘কল-রেডী’ কি হারিয়ে যাবে?

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৭ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
৭ মার্চের স্মৃতিবিজড়িত ‘কল-রেডী’ কি হারিয়ে যাবে?

‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’

১৯৭১-এর অগ্নিঝরা সেই মার্চের ৭ তারিখে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীপ্তকণ্ঠের কাঁপিয়ে দেওয়া সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তির যুদ্ধে।  কালের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর মহাকাব্যিক ৭ মার্চের সেই ভাষণকে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।  কিন্তু জাতির জনকের সেই ভাষণ যে শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিলো সর্বত্র, সেই ‘কলরেডী’ আজও স্বীকৃতির অপেক্ষায়!

‘কলরেডী’র সেই দিনের মাইক, স্ট্যান্ড আজও আছে প্রতিষ্ঠানটির সংরক্ষণে।  কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সেগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ এতোদিনেও নেওয়া হয়নি।  অবহেলা-অযত্নে নষ্ট হওয়ার পথে সেই অমূল্য স্মৃতিগুলো।  তাই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি হারিয়েই যাবে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ কাঁপানো সেই শব্দযন্ত্রগুলো?

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশেও কল-রেডির মাইকে বক্তব্য দিয়েছেন নেতারা।  আর ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণতো এখন আরেকটি ইতিহাস।  ৪৯ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর সেই আওয়াজ উজ্জীবিত করেছিল সাত কোটি স্বাধীনতাকামী মানুষকে।  যে কণ্ঠ কোটি মানুষের কানে পৌঁছে গিয়েছিল ‘কলরেডী’ মাইকের মাধ্যমে সেইসব মাইক এখনও পড়ে আছে অযন্ত্র-অবহেলায়।  এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে ৭ মার্চে ব্যবহৃত অনেক শব্দযন্ত্র।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণের শব্দযন্ত্রগুলোর কী অবস্থা জানতে চাইলে ‘কলরেডী’র মহাব্যবস্থাপক বিশ্বনাথ ঘোষ রাইজিংবিডিকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সেদিনের অগ্নিঝরা বক্তব্যের সাক্ষী মাইক স্ট্যান্ডগুলো বহু কষ্টে সংরক্ষণ করেছি।  জনসভা শেষ হতে না হতে খবর আসে কলরেডীর দোকানে আগুন দিয়েছে পানিস্তানি সমর্থকরা।  তবে আফসোস এতোদিনেও এগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি! দেওয়া হয়নি কোনো স্বীকৃতও!

বিশ্বনাথ ঘোষ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের প্রজন্ম পর্যন্ত এ পেশায় আছি।  পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় থাকবে কি না সন্দেহ আছে।  তাদের এই পেশায় থাকার আগ্রহও নেই।  তাই এগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি।  সামনে মুজিববর্ষ।  আমার মনে হয় এটিই মোক্ষম সময় এগুলো সংরক্ষণ করার। 
 


বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ব্যবহৃত সেই যন্ত্রপাতিগুলো সংরক্ষণ করা উচিত বলে মনে করেন ৭ মার্চের ভাষণের প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য বর্তমান আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য।  রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কী না আমি জানি না।  তবে সংরক্ষণ করা উচিত।

১৯৪৮ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে যখন আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে।  ওই বছর বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার মঠবাড়িয়া গ্রামের দুই ভাই হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ‘আরজু লাইট হাউস’ নামে একটি আলোকসজ্জার দোকান চালু করেন।  আলোকসজ্জার পাশাপাশি গ্রামোফোনও ভাড়া দেওয়া হতো।  সভা-সমাবেশ ও বিয়ে-শাদিতে গ্রামোফোন ভাড়া নিত লোকজন।  এভাবে অল্প দিনেই দোকানটি পরিচিত হয়ে ওঠে।  আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা মাইক ভাড়া নিতে শুরু করেন আরজু লাইট হাউস থেকে।  চাহিদা বাড়তে থাকে দিনে দিনে।  তাই তাইওয়ান, জাপান, চীন থেকে আনা হয় মাইক।  তবে মাইকের মূলঅংশ মানে ইউনিট বেশি আনা হতো বাইরে থেকে।  এরপর নিজের দোকানের কারিগর দিয়ে হরিপদ ঘোষ তৈরি করতেন বাকি অংশ।  বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে সভা-সমাবেশ বাড়তে থাকে এবং সামাজিক আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রয়োজনেও মাইকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।  তাই মাইক সার্ভিসের সঙ্গে মিল রেখে ‘কলরেডী’ নামটিই ঠিক করেন করা হয়।  প্রয়োজনে কল করলেই যেন মাইক রেডি থাকে।  অর্থাৎ কল করলেই রেডী-কলরেডী।

নামকরণের বিষয়ে হরিপদ ঘোষের ছেলে ‘কলরেডী’র মহাব্যবস্থাপক বিশ্বনাথ ঘোষ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মূলত কল করলেই যাতে তাৎক্ষণিকভাবে সেবা দিতে পারি এমন ভাবনা থেকে নামকরণ কলরেডী।’

কল-রেডী মাইকে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও বক্তব্য দিয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অনেকে।  এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিদেশের নেতাদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি কল-রেডি মাইক্রোফোনে ভাষণ দিয়েছেন।

‘কলরেডী’কে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

পাকিস্তানি শোষণ বঞ্চনা আর ৭০’এর নির্বাচনে জয়ের পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বাংলার মানুষ তখন অগ্নিগর্ভ।  এরই মধ্যে চলে এলো ১৯৭১ এর অগ্নিঝরা মার্চ মাস।  ৭ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সাত কোটি মানুষের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  দেশবাসী-বিশ্ববাসী তাকিয়ে কী বলতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু।  ঘুম হারাম তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর।  বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন, তার এ বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে হবে আনাচে-কানাচে।  কল-রেডীর মালিক হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ধানমণ্ডির বাসায় ডেকে পাঠালেন বঙ্গবন্ধু।  নির্দেশ দিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে মাইকের ব্যবস্থা করতে।
 


জনসভা যাতে সফল না হয় সেজন্য প্রতিবন্ধকতা, হুমকি-ধমকি ছিল।  জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই তাদের নিষেধ করলেন।  কিন্তু হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষের রক্তেও তখন শোষকদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন।  বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মাইক সরবরাহের কাজে নেমে পড়ে কল-রেডী।  তখন রেসকোর্সে মাইক লাগানো সোজা ছিল না।  কারণ শাসকগোষ্ঠীর সতর্ক চোখ ছিল রেসকোর্স ময়দানে।

সেদিনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে হরিপদ ঘোষের চার ছেলের একজন বিশ্বনাথ ঘোষ রাইজিংবিডিকে বলেন, রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে মাইক লাগাতে গিয়েছিলেন আব্বা ও কাকা।  মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন তারা।  পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কিছু বাড়তি মাইক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মজুদ রাখা হয় যেন সমাবেশের দিন তাৎক্ষণিকভাবে লাগানো যায়।  তিন দিন ধরে ৩০ জন কর্মী নিয়ে বাঁশ, খুঁটি গাথার কাজ করেন তারা।  বঙ্গবন্ধুর ভাষণকালে যেন কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি না হয়, সে জন্য নিজে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিয়েছিলেন হরিপদ ঘোষ।  অতিরিক্ত তিনটি মাইক্রোফোন সঙ্গে রেখেছিলেন দয়াল ঘোষ।  পরের দিন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলো।  ঐতিহাসিক ৭ মার্চ কল-রেডির মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তবে জনসভা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘কলরেডী’র দোকানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।

এতো বছরেও কেন উপেক্ষিত কলরেডী?

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে কল-রেডীর যে মাইকগুলো ছিল, সেগুলো অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছে।  ওই দিন জনসভায় ব্যবহৃত মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডটি আজও সংরক্ষিত আছে ‘কল-রেডী’র কাছে। সেদিন যেসব অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করা হয়েছিল তার মধ্যে বেশ কয়েকটি অ্যামপ্লিফায়ার এখনও আছে।  আছে চারটি মাইক্রোফোন।

যে প্রতিষ্ঠানটি ইতিহাসের অংশ, জীবন্ত সাক্ষি; সেই প্রতিষ্ঠানটিকে এখনও স্বীকৃতি না দেওয়া এবং সেই দিনের ব্যবহৃত শব্দযন্ত্রগুলো কেন সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়া হচ্ছে সেই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে উঠেছে।  বিশেষ করে মুজিব বর্ষে এ দাবি আরও জোরালোভাবে উঠে আসছে।  বাঙালির প্রধান প্রধান আন্দোলন-সংগ্রামের সভা-সমাবেশে ছিল এই কল-রেডী মাইক কোম্পানি। কেবল বাণিজ্যিক নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে বাকিতেও সেবা দিয়েছে কল-রেডী।  বিশেষ করে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে কল-রেডী বিনাপয়সায় সেবা দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশীদার হয়েছিল।  বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য কল-রেডী মাইক সার্ভিস অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে, এটা ইতিহাসের দায় এবং প্রাপ্য ঐতিহাসিক মর্যাদা দেওয়ার দায়ও কি জাতির নয়?

**

 

ঢাকা/পারভেজ/এসএম

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়