ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

করোনায় আক্রান্তের লাশ দাফনে নেই সংক্রমণ ঝুঁকি

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৯, ৩১ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনায় আক্রান্তের লাশ দাফনে নেই সংক্রমণ ঝুঁকি

ফাইল ফটো

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর লাশ নিয়ম মেনে দাফনের পর সংক্রমণের ঝুঁকি নেই বলে জানিয়েছেন দেশের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত গাইড লাইনেও নিশ্চয়তার বিষয়টি উল্লেখ আছে।  এজন্য তারা কিছু নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে। তারপরও জনমনে অহেতুক আতঙ্কের কারণে করোনাভাইরাসে এবং অনুরূপ উপসর্গে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর লাশ দাফনে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে।

‘মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে- যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও একফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।’ অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দেবদাস’-এর যবনিকা টেনেছেন এই ক’টি বাক্যে। হতভাগ্য দেবদাসের মৃত্যুর পর এই হাহাকার করোনায় আক্রান্ত মৃতের স্বজনদের বুকে একইভাবে শেলের মতো বিঁধছে।

সম্প্রতি বগুড়ার শিবগঞ্জে মাসুদ রানা সর্দি-কাশি, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তার লাশ দাফনে বাধা দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মেজবাউর রহমান। খবরে প্রকাশ মৃতের প্রতি নির্দয় এ আচরণের জন্য আওয়ামী লীগের শিবগঞ্জ উপজেলা কমিটির সভাপতি আজিজুল হক তাকে শোকজও করেছেন।

জামালপুরের বকশীগঞ্জেও ঘটেছে অনুরূপ ঘটনা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ায় বৃদ্ধা খুকির লাশ দাফনেও তৈরি হয় জটিলতা। উপজেলা প্রশাসনের তৎপরতায় ১৪ ঘণ্টা পর সেই লাশ দাফন করা হয়।

এমনকি রাজধানীতেও সরকার নির্ধারিত খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানের প্রধান ফটকে করোনায় মৃতের লাশ দাফনে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ব্যানার টানানো হয়েছিল। গত ২৫ মার্চ সেখানে করোনায় আক্রান্ত রোগীর লাশ সন্দেহে দাফনে বাধা দেন স্থানীয়রা। যদিও প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তালতলা কবরস্থানের সেই ব্যানার নামিয়ে ফেলা হয়েছে। 

দেশজুড়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা অনুরূপ উপসর্গে মারা গেলে তার লাশ দাফন নিয়ে দেখা দিচ্ছে জটিলতা। এতে মৃত ব্যক্তির স্বজনদের পড়তে হচ্ছে চরম বিড়ম্বনায়। স্বজন হারানো শোক হয়ে উঠছে চাপা আতঙ্ক এবং ক্ষোভের কারণ। তারা বলছেন, এই মৃত্যু এমন এক আতঙ্ক জাগানিয়া যে মৃত্যুর পরেও কাটছে না সংশয়। প্রাপ্য শেষ সামাজিকতাটুকুও মিলছে না মৃত ব্যক্তির। তার উপর এমন বিড়ম্বনা নির্দয় এবং অমানবিক।

গুজব, অজ্ঞতা এর মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন আতঙ্ক থেকেই করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন নিয়ে জনমনে নানা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়ম মেনে করোনায় আক্রান্ত রোগীর লাশ দাফনে নেই সংক্রমণের ঝুঁকি। আশঙ্কা নেই এলাকার কোনো সুস্থ ব্যক্তির আক্রান্ত হবার।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. শওকত আরা বিথী বলেন, ‘সাধারণত কবর দেয়ার পর লাশ থেকে ভাইরাস সংক্রমণের কোনো সুযোগ থাকে না। কবরের আশেপাশের জলাশয় থাকলেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে না।’

ধর্মীয় বিষয়গুলো উল্লেখ করে ডা. বিথী বলেন, ‘আইইডিসিআর-এর প্রশিক্ষিত লোকজন লাশের গোসল করিয়ে দেবে। এরপর লাশ কাফনের কাপড়ে জড়িয়ে বিশেষভাবে প্যাকেট করবে, যেন ভেতরের কোনো ভাইরাস বাইরে সংক্রমিত না হয়। মৃতদেহ বহনকারী সেই ব্যাগ কাউকে খুলতে দেওয়া হবে না। তাছাড়া আইইডিসিআর-এর কর্মকর্তারা বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কবরের চারদিকে ভালোভাবে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে দেন। সুতরাং ভয়ের কোনো কারণই নেই।’

আইইডিসিআর-এর সাবেক এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর লাশ দাফন করা জরুরি। এর অন্যতম কারণ হলো, মানসিকভাবে সমাজের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখা। লাশ দাফন না হলে অনেকের মধ্যে আতঙ্কের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে, শুরু হবে নতুন সমস্যা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মাদ ওয়াসিম বলেন, ‘ এ ধরনের লাশের সৎকার করা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রোটোকল মেনেই কাজ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বা এই ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলার সিভিল সার্জন অথবা সরাসরি আইইডিসিআর-এ অবহিত করতে হয়। সংস্থাটি নিজেদের ব্যবস্থাপনায় লাশের গোসল থেকে শুরু করে লাশ যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে প্যাকেট করে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে। সুতরাং এ নিয়ে গুজব রটানো উচিত নয়।’

কবর দিতে বাধা দেওয়া অমানবিক। এর যৌক্তিকতা নেই জানিয়ে ডায়াবেটিস রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এজাজ বারী চৌধুরী বলেন, ‘দাফন কাজ কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে সে বিষয়ে বরং মানুষকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। ভাইরাস ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম হলো আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সময় বের হওয়া ক্ষুদ্র ড্রপলেট। এই ড্রপলেট সুস্থ মানুষের শরীরে শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে প্রবেশ করে এবং ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়। কিন্তু নির্দেশনা মেনে মৃত লাশ দাফনে সংক্রমণের সুযোগ নেই। লাশটি পরিবহন করতে হবে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় যারা যুক্ত থাকবেন তাদের প্রত্যেককে প্রতিরোধমূলক বিশেষ পোশাক (পিপিই) পরতেই হবে।’

গোয়েন্দাদের ধারণা লাশ দাফনে বাধা দেওয়ার পেছনে এলাকাভিত্তিক একটি কুচক্রী মহল সক্রিয় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, কিছু ব্যক্তি মরদেহ নিয়ে এলাকায় গুজব তৈরি করার চেষ্টা করছে। তারা কবরস্থান বা সরকারি জায়গা দীর্ঘদিন দখলে রেখেছে।

তাদের বিরুদ্ধে জোর তদন্ত চলছে জানিয়ে সোহেল রানা বলেন, জীবনের ভয় সবার আছে। ফলে লাশ দাফনের আগে ও পরে যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। অথচ অহেতুক না বুঝেই করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ দাফনে বাধা দেয়া হচ্ছে। পুলিশ প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন: মুছা মল্লিক


ঢাকা/মাকসুদ/জেডআর/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়