ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

গ্রামে বাড়ছে করোনার ঝুঁকি

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৪, ৫ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গ্রামে বাড়ছে করোনার ঝুঁকি

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সারা দেশে জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গণপরিবহন চলাচল বন্ধ। লোক চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর শহরের মানুষ গ্রামে ছুটে গেছেন পঙ্গপালের মতো। গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি তেমন একটা মানছেন না। তারা অবাধে হাট-বাজারে যাচ্ছেন, অনেকে মিলে আড্ডা দিচ্ছেন। ফলে গ্রামে বাড়ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি।

রাজধানীসহ ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা গ্রামে ফিরেছেন। তারা গণপরিবহনে গাদাগাদি করে ভ্রমণ করেছেন। গ্রামে গিয়েও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন না। স্বাস্থ্যবিধিও মানছেন না তারা। জীবিকার তাগিদে অনেককে বের হতে হচ্ছে কাজের খোঁজে। এতে তারা যেমন নিজেদের করোনার ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন, তেমনই ঝুঁকি তৈরি করছেন অন্যদের জন্য।

এ ভাইরাসটি যদি একবার কোনো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অবস্থা হবে ভয়াবহ। কারণ, করোনাভাইরাসের ব্যাপারে অনেকেই ভালোভাবে জানেন না, খুব বেশি সচেতনও নন। কোথাও কোথাও মাইকিং করে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করা হলেও তাতে পাত্তা দিচ্ছেন না অনেক গ্রামবাসী।

ফলে ক্রমেই গ্রামে ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সিলেট থেকে রাইজিংবিডির নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল্লাহ আল নোমান জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমণ রোধে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর শহর থেকে চাকরিজীবী ও শ্রমজীবীদের অনেকেই ফিরেছেন গ্রামে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীরাও গ্রামে ফিরেছেন। প্রতিদিন সরব হয়ে উঠছে গ্রামের হাট-বাজার, খেলার মাঠ। বাড়ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি।

সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মণ্ডল বলেছেন, সামাজিক দূরত্ব তৈরিতে ব্যর্থ হলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভয়াবহ হতে পারে। এখনো সময় আছে, বাঁচতে হলে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। গ্রামের মানুষগুলোর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

বরগুনা প্রতিনিধি রুদ্র রুহান জানান, করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঠেকাতে সরকারে কঠোর পদক্ষেপ কাজে আসছে না গ্রামে।  গ্রামবাসীদের অধিকাংশই স্বাভাবিক জীবনযাপন অব্যাহত রেখেছেন। সামাজিক দূরত্বের চেয়ে সামাজিক সম্পর্ক রক্ষাই এখানে মুখ্য।

প্রতিটি গ্রামেই মুদি দোকানগুলোতে চলছে আড্ডা। হাট- বাজারগুলোতেও চলছে বিকিকিনি। প্রতিবেশীদের ঘরেও অবাধ যাতায়াত অব্যাহত আছে।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক অথবা জীবানুনাশক ব্যবহারের প্রবণতা একেবারেই কম। গ্রামের সচেতন পরিবারের সংখ্যা নিতান্তই কম। এর মধ্যে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে কর্মরতরা ছুটির সুবাদে বাড়িতে এসে রীতিমতো ঈদের আমেজে আছেন। সবার কুশলাদি জানতে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে।

বরগুনার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ জেলে। নদী তীরবর্তী বেরিবাঁধ সংলগ্ন এসব জেলে পরিবারে কার্যত কোনো প্রভাবই পড়েনি করোনার। দল বেঁধে মাছ শিকার অব্যাহত রেখেছেন তারা। মাছের আড়তে বেচাকেনা চলছে হরদম।

এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার পদ্ধতিও অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। গণজমায়েত করে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব।

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মাইকিং করা হচ্ছে। জনসচেতনতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতার উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে নৌবাহিনী নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।

কক্সবাজার প্রতিনিধি সুজাউদ্দীন রুবেল জানিয়েছেন, কক্সবাজারে সরকারি নির্দেশনা না মেনে কিশোর-যুবকরা রাস্তায় বের হচ্ছেন। আড্ডা দিচ্ছেন চায়ের দোকানে বা রাস্তার ধারে। ব্যবসায়ী ও হকাররা দোকানপাট খুলছেন। চলছে ছোট ছোট যানবাহন।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, অনেকেই নিয়ম মানছেন না। আমরা তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। ভাইরাসের ভয়াবহতা যদি তারা অনুধাবন না করেন। এর মাশুল সবাইকে গুনতে হবে।

রাজশাহী থেকে রাইজিংবিডির নিজস্ব প্রতিবেদক তানজিমুল হক জানিয়েছেন, রাজশাহী শহরে জনসমাগম বন্ধ এবং যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে লোকজনের সচেতনতার অভাব আছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর ও বাগমারা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে এ অবস্থা চলছে। এ ঘটনায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কের মধ্যে আছেন।

এ ব্যাপারে স্থানীয় দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান বলেন, আমরা সাধারণ মানুষকে বাড়িতে অবস্থান করার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছি। এরপরেও যদি কেউ বিনাপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে আসেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশানকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হবে।

রাইজিংবিডির গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি বাদল সাহা জানান, কোনোভাবেই সরকারি নির্দেশনা মানছে না সাধারণ মানুষ। গ্রামের পাড়ায-মহল্লায় প্রত্যেকটি হাট-বাজারে আগের মতোই রয়েছে লোকসমাগম। চায়ের দোকানগুলো চলছে আড্ডা। এদিকে, শ্রমিকরা কাজের খোঁজে ঘর থেকে বের হচ্ছেন। পেটের দায়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। অভাবের কারণে সরকারি নির্দেশনা মানতে পারছেন না তারা।

গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন, মানুষকে সচেতন করতে জেলার বিভিন্ন স্থানে সরকারিভাবে মাইকিং করার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে আড্ডা দেওয়ার কারণে বেশ কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল মুহিত বলেন, এভাবে জনসমাগম অবশ্যই স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী যেখানে বলা হচ্ছে সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে, সেখানে জনবহুল কোনো কিছু খোলা রাখা অবশ্যই উচিত হবে না। তাছাড়া, যেহেতু সবাই গ্রামে চলে গেছে এখন সেসব জায়গায় স্থানীয় প্রশাসনক সদা তৎপর থাকতে হবে। অন্যথায়, এ ভাইরাস একবার গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে চরম হুমকির মুখে পড়বে পুরো দেশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনা প্রতিরোধে একমাত্র উপায় দূরত্ব বজায় রেখে নিজে সচেতন থাকা। যেহেতু, সরকারি ছুটি ঘোষণা করায় সবাই গ্রামে চলে গেছে তাই সেসব এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন।


ঢাকা/ইয়ামিন/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়