ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ব্যাংক খাতে বেতন হ্রাস: সমঝোতার তাগিদ অর্থনীতিবিদদের

শাহ আলম খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২২, ১৬ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ব্যাংক খাতে বেতন হ্রাস: সমঝোতার তাগিদ অর্থনীতিবিদদের

ব্যাংকিং খাতে ছাঁটাই ও বেতন কর্তনসহ অন্যান্য সুবিধা কাঁটছাটের বিষয়কে মানবিকতা ও বাস্তবতার নিরিখে সমঝোতার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

করোনা সংকটে বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত উচ্চ বেতনের কর্মীদের বেতন হ্রাসের বিষয়ে ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের (বিএবি) নির্দেশনা এবং তার প্রেক্ষিতে ব্যাংককর্মীদের চাপা ক্ষোভের পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা এমন মত দিয়েছেন।

তাঁরা বলেছেন, এটা শুধু বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই নাজুক ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের নজির আছে। ফলে শেষ পর্যন্ত খরচের সীমা টেনে ধরতে সেখানে কর্মী ছাঁটাইয়ে যান অথবা উচ্চ বেতনের অনুপাতিক অংশ কমিয়ে খরচ সমন্বয় করেন। বিশেষ করে ২০০৭-৮ পরবর্তি বৈশ্বিক মহামন্দাকালে অনেক দেশের ব্যাংকিখাতে এ ধরনের অপ্রিয় পদক্ষেপ দেখা গেছে। তবে বাংলাদেশে এর নজির এবারই প্রথম শোনা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্যাংকে তা কার্যকরেরও চেষ্টা চলছে। আবার চাকরি ছাঁইয়ের কথাও শোনা যাচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকে চাকরিরত কর্মীদের ওপর ব্যাংক মালিকদের এ ধরনের আচরণের বিষয়টিকে অর্থনীতিবিদরা কীভাবে দেখছেন -জানতে চাইলে তাঁরা বলছেন, এটি গ্রহণযোগ্যও নয়। যদি করেও থাকে তা হবে অমানবিক। আবার ব্যাংক মালিকদের এ উদ্যোগে যৌক্তিকতাও ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার মত  কারণও খোঁজে পাচ্ছেন না তারা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাংকারদের ওপর গুরু দায়িত্ব এসে পড়েছে। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজও করছে। এই সময়ে বেসরকারিখাতের ব্যাংকগুলোতে ছাঁটাই হলে কিংবা একটা লেভেলে বেতন কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে তা হবে অমানবিক। এটা গ্রহণযোগ্য হবে না কারও কাছে।

সাবেক এই গভর্নর আরও বলেন, ‘ব্যাংক একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তাকে মুনাফা করতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। আমি মনে করি, পরিচালন খরচ উঠিয়ে ব্রেক ইভেন্ট পয়েন্ট থাকলেই ব্যাংক ভাল পজিশনে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘তারপরও খরচ কমানোর প্রশ্ন আসতেই পারে। কিন্তু সেটি কারও রুটি রুজির ওপর আঘাত করে নয়। বরং ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় অপচয় কমিয়ে আনার অনেক পথ খোলা আছে। পদে পদে খরচ বাঁচানো যায়। সেগুলো ব্যাংক মালিকরা ভালই জানেন। এ পরিস্থিতিতে আমার পরামর্শ হবে ব্যংক মালিকরা যেন কিছু অর্থ বাঁচাতে এরকম অপরিপক্ক সিদ্ধান্তে না যায়। আর যাওয়ার মত পরিস্থিতি যদি তৈরিই হয়, সেখানে যাতে ভাল বোঝাপড়ার বিষয় থাকে।

অন্যদিকে পলিসি রিসার্চ ইনসষ্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহি পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকিংখাত তো অর্থনীতির বাইরের কোনো অংশ নয়। করোনার ধাক্কা অন্যান্য খাতের মত ব্যাংকেও এসে পড়েছে। আগে থেকেই ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। এখন করোনার প্রকোপে এ খাতে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বিশ্বজুড়েই করোনার কারণে একটা অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে। অনেক দেশেই এ রকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ব্যাংক বাঁচাতে কর্মী ছাটাইয়ের নজির আছে। আবার ছাঁটাই না করে বেতন কমিয়ে দেয়ার অহরহ ঘটনাই আছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ব্যক্তিগত মতামত জানিয়ে বলেন, বোঝাপড়ার মধ্যে অনেক কিছুই করা সম্ভব। ব্যাংক কর্মীদের ব্যাংকের একজন অংশীদার হতে হবে। তারা ভাল সময়ে লোভনীয় বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে। এখন প্রাকৃতিক দূর্যোগের মত এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যদি তাদের রুটি-রুজির জায়গাটিকে মেরে ফেলতে না চায়, তাহলে আমি অপ্রিয় কথাই বলব।

তিনি এ বিষয়ে ব্যাংক মালিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, কোনো ব্যাংক কর্মীকে ছাঁটাই করা যাবে না। এরকম পদক্ষেপ নিয়ে দেশের অর্থনীততে বেকারত্বের বোঝা আর বাড়াবেন না। একভাবে তিনি ব্যাংককর্মীদের উদ্দেশ্যে পরামর্ম রেখে বলেন, অন্যান্যখাতে যেখানে লাখ লোক চাকরি হারিয়ে বেদনাদায়ক দিনযাপন করছে। সেখানে যদি আপনাদের চাকরি সুরক্ষিত থাকে, তাহলে দেশ, জাতি ও ব্যাংকের বৃহৎ স্বার্থে বেতনের সামান্য অংশ ভাল বোঝাপড়ার মাধ্যমে আপোষ করাই ভাল হবে। তাহলে ব্যাংকও বাঁচিবে। ব্যাংককর্মীও বাঁচবে। গ্রাহকরাও বঞ্চিত হবে না সেবা থেকে।

বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে রাইজিংবিডি ডট কমকে জানান, সেবামূলক হলেও ব্যাংকগুলোরও একটা ব্যবসায়িক মুনাফার আশা থাকে। তাদের মুনাফার অন্যতম উৎস্য হচ্ছে ঋণ বিনিয়োগ করা ও আমানত সংগ্রহ করা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিসহ সাম্প্রতিক সময়ে সার্বিক ব্যাংকিং কর্মকান্ডের খবর আমরা জানি। কিন্তু তাদেরও মুনাফার একটা চাপ থাকে। টিকে থাকার একটা প্রতিযোগিতা থাকে। বাস্তবিক অর্থে ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুব একটা ভাল নেই। এখন এই অস্বাভাবিক সময়ে এসে সেই বোধোদয় হয়তো হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, ব্যাংকে লোক নিয়োগ, ছাঁটাই কিংবা বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা কর্তনের এখতিয়ার ব্যাংক মালিকরা রাখে। একান্তই করতে হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন ও শ্রমবিধি মেনেই করতে হবে। তবে আমাদের পরামর্শ চাকরি অক্ষু্ণ্ণ রেখে ব্যয় সমন্বয়ের প্রশ্নে অন্যান্য উদ্যোগের সঙ্গে যদি বেতনের কিছু অংশ কাটছাঁট করতেই হয়, সেটা সমঝোতার মাধ্যমেই করতে হবে।

ওদিকে বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত ও উচ্চ বেতনভুক্ত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে মুঠোফোনে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা চাকরির নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।



ঢাকা/শাহ আলম খান/সাজেদ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়