ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রাজস্বে যত অস্বস্তি

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাজস্বে যত অস্বস্তি

এম এ রহমান মাসুম : রেকর্ড করদাতা সংগ্রহ, নতুন মূল‌্য সংযোজন কর আইন কার্যকর, স্বর্ণ নীতিমালা বাস্তবায়ন, কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দার অব্যাহত অভিযানসহ বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল বছর জুড়ে। তবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ধরনের ঘাটতি ও অস্বস্তি নিয়ে ২০১৯ সাল শেষ করতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

এনবিআরের চেয়ারম‌্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দাবি করেছেন, ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হয়েছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এতকিছু করার পরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব না আসা দুঃখজনক। তবে বছর শেষে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা সক্ষম হব।

৪৭ লাখ করদাতার নতুন মাইলফলক:

তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০১৩ সালে অ্যানালগ পদ্ধতির পরিবর্তে অনলাইনে ইলেট্রনিক কর শনাক্তকরণ নম্বর (ই-টিআইএন) চালু করে এনবিআর। ৩১ ধরনের সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বর্তমানে ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা ৪৭ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। যদিও ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা ২২ লাখের কাছাকাছি। অর্থাৎ ই-টিআইএনধারীর মধ্যে অর্ধেকও তাদের আয়কর বিবরণী জমা দেননি।এনবিআর চেয়ারম্যান আশা প্রকাশ করেছেন, চলতি অর্থবছরে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২২ থেকে ২৪ লাখ হতে পারে।

রাজস্বে বড় ধরনের ঘাটতিতে অস্বস্তি:

প্রায় ১৬.২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছিল। যা মোট জিডিপির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। যেখানে মোট কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অথচ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই থেকে অক্টোবর) প্রবৃদ্ধি মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। এ সময় রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম। সবচেয়ে বেশি আয়করে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। প্রায় একই চিত্র নভেম্বর মাসের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে এনবিআর।

২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে পাঁচ মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২৩ হাজার ৭৬৮ টাকা। চলতি অর্থবছর থেকে নতুন ভ্যাট আইন চালু হয়েছে। প্রত্যাশা ছিল- ভ্যাট আদায়ে বেশ গতি আসবে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, যা ভ্যাট আদায় বাড়াতে পারেনি।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘রাজস্ব আয় বাড়াতে আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট- তিন বিভাগকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে অটোমেশন কার্যক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আদায় প্রক্রিয়া আরো জোরদার করা হবে।

রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণই প্রকৃত চ‌্যালেঞ্জ:

২০১৯-২০ অর্থবছরে এনবিআর বড় ধরনের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে। লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ভ্যাট আদায় করার কথা ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। যা চলতি ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৩. ১৪ শতাংশ বেশি। এর পরেই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে আয়কর ও অন্যান্য প্রত্যক্ষ করে। আয়কর ও অন্যান্য প্রত্যক্ষ করে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৮৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা। যা গত অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ১৯.৬২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে, আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে রাজস্ব ধরা হয়েছে ৯২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এনবিআরের জন্য তার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এনবিআরের বর্তমান কাঠামোতে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অসম্ভব। তবে এনবিআর চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, চ্যালেঞ্জ হলেও অসম্ভব নয়।

বড় ধরনের ঘাটতি ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরও। ওই বছরে সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ‌্যমাত্রা ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৩ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। ঘাটতি ৫৬ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। ঘাটতি ছিল ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরেও। সংশোধিত ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।

যদিও এর আগে ২০১৪-২০১৫, ২০১৫-২০১৬ এবং ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল সংস্থাটি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ হাজার ৭৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর।

ভ্যাট নিবন্ধন সোয়া লাখ ছাড়িয়ে:

চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়িত হয়েছে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২। ২৬ বছর পর সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক নতুন ভ্যাট আইন চালু হয়। আইন পাসের সাত বছর পর তা কার্যকর হচ্ছে। সনাতন পদ্ধতিতে ভ্যাট নিবন্ধন আর রিটার্ন দাখিলের ভোগান্তি পোহাতে হতো ব্যবসায়ীদের। অনলাইনে রিটার্ন দাখিল প্রথম অবস্থায় কম হলেও গত মাস থেকে বাড়ছে। তবে যেসব করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন না, তাদের রিটার্ন স্ক্যান করে ভ্যাট অফিস থেকে অনলাইনে নেয়া হচ্ছে। গত মাসে প্রায় সোয়া ১ লাখের বেশি রিটার্ন দাখিল হয়েছে। করদাতারা বলছেন, রিটার্ন দাখিল সহজ করা হলে সবাই অনলাইনমুখী হবেন।

স্বর্ণের স্বর্ণালী যুগ:

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮ চূড়ান্ত রূপ নেয় এ বছর। ৫ লাখ টাকা ফি দিয়ে আবেদনপত্র সংগ্রহ এবং ১ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে ব্যবসা শুরুর শর্তে অনুমোদিত পরিবেশকের মাধ্যমে সরাসরি স্বর্ণ আমদানির সুযোগ থাকছে ওই নীতিমালায়। রপ্তানিতে বন্ড সুবিধাসহ বিশেষ প্রণোদনা কিংবা ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণসহ আটটি অনুচ্ছেদ, ৫৮টি উপ-অনুচ্ছেদ আছে ওই নীতিমালায়। এরই মধ্যে স্বর্ণ আমদানির ডিলারশিপ লাইসেন্স পেয়েছে একটি ব্যাংকসহ ১৮ প্রতিষ্ঠান। প্রত্যেককে সাময়িকভাবে দুই বছরের জন্য এই লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধ সোনা বৈধ করতে এ বছর প্রথমবারের মতো আয়েজিত হয় স্বর্ণমেলা। দেশের আট বিভাগে আয়োজিত মেলায় অবৈধ ১৭৫ কোটি টাকার সোনা, রুপা এবং ডায়মন্ড বৈধ হয়। যদিও পরবর্তীতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার সোনাসহ অন্যান্য অলংকার বৈধ হয় বলে জানা গেছে।

ভিআইপিদের হিসাব জব্দ ও তলবে লুকোচুরি: ক্যাসিনো কাণ্ডের পর সন্দেহভাজন ভিআইপিদের আয় ও ব্যাংক হিসাব যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ চোখে পড়েছে বছরের শেষভাগে। যদিও এনবিআর বরাবরই দাবি করেছে, এটা তাদের রুটিন ওয়ার্ক। অন্তত ৫০ জনের বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের তথ্য যাচাইকালে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া। হিসাব জব্দ কিংবা তলবের প্রক্রিয়ার মধ্যের যাদের নাম সামনে এসেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, যুবলীগের অব্যাহতিপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস‌্যগণ, তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান লেক ভিউ প্রোপার্টিজ ও রাও কনস্ট্রাকশন, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সেলিম প্রধান, জি কে শামীম, খালেদসহ তাদের পরিবার, যুবলীগের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, তার স্ত্রী সানজিদা রহমান ও তাদের দুটি প্রতিষ্ঠান টি-টোয়েন্টিফোর গেমিং কোম্পানি লিমিটেড ও টি-টোয়েন্টিফোর ল ফার্ম লিমিটেড, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা আবু কাউসার, তার স্ত্রী পারভীন লুনা, মেয়ে নুজহাত নাদিয়া নিলা ও তাদের প্রতিষ্ঠান ফাইন পাওয়ার সলিউশন লিমিটেড, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক কে এম মাসুদুর রহমান, তার স্ত্রী লুতফুন নাহার লুনা, বাবা আবুল খায়ের খান, মা রাজিয়া খান ও তাদের প্রতিষ্ঠান সেবা গ্রিন লাইন লিমিটেড, যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, তার স্ত্রী সুমি রহমান ও তার প্রতিষ্ঠান মা ফিলিং স্টেশন, আরেফিন এন্টারপ্রাইজ ও কাউন্সিলর পাগলা মিজান এবং তারেকুজ্জামান রাজিব ও তাদের পরিবার।

ক্যাসিনো সামগ্রী ও পেঁয়াজ আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার:

ক্যাসিনো অভিযানের পরপরই এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর অবৈধ ক্যাসিনো সামগ্রীর আমদানির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। অনুসন্ধান শুরু হয় পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি রহস্য উন্মোচনের ক্ষেত্রেও।  উভয়  ঘটনার পিছনে শত শত কোটি টাকার অর্থ পাচারের তথ্য উদঘাটিত করতে সক্ষম হয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। সংস্থাটির অনুসন্ধানে  আমদানিকৃত পেঁয়াজের ক্রয়মূল্য কম দেখিয়ে বা আন্ডারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে বলে বেরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে, মিথ্যা ঘোষণায় বিভিন্ন কৌশলে ক্যাসিনো সরঞ্জাম আমদানিতে কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে। কখনো আন্ডারইনভয়েসিং আবার কখনো ওভারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে আমদানিকারকরা জড়িয়েছেন মানিলন্ডারিংয়ের মতো গুরুতর অপরাধের সাথে। যে কারণে শুল্ক গোয়েন্দা মামলা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

আয়কর মেলায় রেকর্ড আদায়:

প্রতি বছরের মতো চলতি বছরেও আয়কর মেলা থেকে রেকর্ড রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়েছে এনবিআর। সাত দিনব‌্যাপী কর মেলায় রেকর্ড ২ হাজার ৬১৩ কোটি ৪৬ লাখ ৮৫ হাজার ৬৬৭ টাকা কর আদায় হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা বেশি। দশমবারের মতো আয়োজিত আয়কর মেলা থেকে সেবা গ্রহণ করেছেন রেকর্ড ১৮ লাখ ৬৩ হাজার ৩৮৬ জন করদাতা। আর রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৬ লাখ ৫৫হাজার ৯৫ এবং নতুন ই-টিআইন নিবন্ধন নিয়েছেন ৩২ হাজার ৯৬১ জন করদাতা।

 

ঢাকা/এম এ রহমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়