ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

উচ্চ আদালতে আলোচিত যত রায়

মেহেদী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪৮, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উচ্চ আদালতে আলোচিত যত রায়

মেহেদী হাসান ডালিম : আলোচিত বিভিন্ন মামলার রায় ও আদেশের কারণে বছরজুড়েই মানুষের দৃষ্টি ছিল সুপ্রিম কোর্টের দিকে। বিদায়ী বছরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অনেক আলোচিত রায় এসেছে।

 

রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বৈধ ঘোষণা, ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা, দুই মন্ত্রীকে জরিমানা, নিজামী-মীর কাসেমের ফাঁসি বহাল, বুশরা হত্যা মামলায় সবাইকে খালাস, মুফতি হান্নানের ফাঁসি বহালের রায় ও আদেশগুলো ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

 

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বৈধ ঘোষণা : সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্তির বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২৮ বছর আগে দায়ের করা রিট সরাসরি খারিজ করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বৈধ বলে রায় দেন হাইকোর্ট।

 

বিদায়ী বছরের ২৮ মার্চ বিচারপতি নাইমা হায়দারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। ওই বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল।

 

আদালত আদেশে বলেন, আবেদনকারীদের আবেদনের অধিকার নেই।

 

রিট আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জগলুল হায়দার আফ্রিক ও সুব্রত চৌধুরী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। এছাড়া আদালতে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার পক্ষে শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী বিচারপতি টিএইচ খান, এবিএম নুরুল ইসলাম।

 

জামায়াত প্রধানের ফাঁসি বহাল : বিদায়ী বছরের ৫ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এর ফলে নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করতে আইনগত সব বাধা  কেটে যায়।

 

১০ মে রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জামায়াতের আমির নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

 

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা : সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ, বাতিল ও সংবিধানপরিপন্থী বলে রায় দেন হাইকোর্ট।

 

বিদায়ী বছরের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষণা করেন।

 

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরও বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে।

 

আদালত রায়ে আরও বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে সাংসদরা ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো  সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে সাংসদদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে সাংসদদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে।

 

রায়ে আরও বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

 

দুই মন্ত্রীকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড : প্রধান বিচারপতি ও বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আদালত অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে দোষীসাব্যস্ত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। দুই মন্ত্রীকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন আদালত।

 

নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে দুই মন্ত্রীর আবেদন খারিজ করে দিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আট বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২৭ মার্চ এই আদেশ দেন। ক্ষমতাসীন দলের দুই মন্ত্রীকে জরিমানার রায় ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি।

 

বুশরা হত্যা মামলায় সব আসামি খালাস : বিদায়ী বছরে ১৬ বছর আগে খুন হওয়া সিটি কলেজছাত্রী রুশদানিয়া বুশরা ইসলাম হত্যা মামলায় সব আসামিকে খালাস দেন আপিল বিভাগ।

 

সব আসামির খালাসের রায় নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়।

 

পরে অবশ্য এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, মামলার তদন্তে দুর্বলতার কারণেই ২০০০ সালের ১ জুলাই রামপুরার পশ্চিম হাজীপাড়ায় পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলামের মেয়ে সিটি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্রী রুশদানিয়া বুশরা ইসলাম  কোনো এক সময়ে খুন হন। বুশরার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়, তাকে ধর্ষণের পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

 

বিজিএমইএ ভবন ভাঙতে হাইকোর্টের রায় বহাল : বিদায়ী বছরের ২ মে জলাধার আইন লঙ্ঘন করে রাজধানীর হাতিরঝিলে নির্মিত তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) বহুতল ভবন ভাঙতে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

 

বিজিএমইএর করা লিভ টু আপিল খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।

 

এর আগে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিজিএমই ভবন ৯০ দিনের মধ্যে অপসারণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

 

মীর কাসেমের রিভিউ খারিজ, মৃত্যুদণ্ড বহাল : মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ে  জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

 

বিদায়ী বছরের ৩০ আগস্ট প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এই রায় দেন।

 

এর ফলে জামায়াতের অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত প্রভাবশালী এই নেতার ফাঁসি কার্যকর করতে সব আইনগত বাধা কেটে যায়।

 

অবশেষে ৩ সেপ্টেম্বর মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

 

স্কুল-কলেজের সভাপতি হতে পারবে না এমপিরা : বিদায়ী বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিংবডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা ২০০৯-এর ৫ ধারাকে বাতিল করেন হাইকোর্ট। এর ফলে এ বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা ইচ্ছা পোষণ করে স্কুল-কলেজের গভর্নিংবডির সভাপতি হতে পারবেন না। পরে আপিল বিভাগও হাইকোর্টের এই রায় বহাল রাখেন।

 

মুফতি হান্নানসহ ৩ জঙ্গির ফাঁসি বহাল : ঘটনাবহুল ২০১৬ সালেই প্রাক্তন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা ও তিনজন মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষস্থানীয় নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও হুজির সিলেট অঞ্চলের সংগঠক শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। 

 

এছাড়া বিদায়ী বছরে নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা, গাইবান্ধার সাঁওতালদের ওপর হামলা, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংবিধান ও আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রিট, রুল ও ডিরেকশনে সরগরম ছিল উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ ডিসেম্বর ২০১৬/মেহেদী/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়