ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

পাহাড়ি ঝিরি পথে রোদ মেঘের লুকোচুরি

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫১, ৮ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাহাড়ি ঝিরি পথে রোদ মেঘের লুকোচুরি

ইকরামুল হাসান শাকিল : বর্ষা এলেই মন ছুটে যায় ঝরনার কাছে। কখন যাবো, কখন যাবো? মন অস্থির হয়ে ওঠে। তাই এবারো ঝরনা দেখতে যেতে মনটা ছটফট করতে লাগলো। হঠাৎ করেই দিন তারিখ ঠিক করে ফেললাম। সঙ্গীও জুটে গেল আটজন। প্রথমে বাসে করে মীরসরাই নামলাম সকাল ৭ টায়। রাস্তায় জ্যাম থাকার কারণেই এতো দেরি। এখানেই সকালের নাস্তা সেরে লেগুনায় নয়দুয়ার চলে এলাম। তারপর গ্রামের রাস্তা ধরে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটা। যেহেতু আমি এই ট্রেইলে আগেও চারবার এসেছি তাই আমরা কোনো গাইড নেইনি। গ্রামের ভেতর দিয়ে, শিম, পুঁইশাক, ধানের জমি, ছোট-বড় গাছ পেছনে ফেলে আঁকাবাকা পথ ছেড়ে ঝিরি পথে নেমে এলাম। রোদ মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। বৃষ্টি আসবে আসবে বলে আসছে না। তাই হাঁটতে আমাদের তেমন কষ্ট হচ্ছে না।

পাথর, আলোছায়া, শামুক ভেজা ঝরনার শীতল জল ঝরা বুনোফুল ভাসিয়ে নেমে আসছে কলকল ছলছল শব্দে। ঝিরিপথে নেমেই আমরা পা ভিজিয়ে নিলাম। পানি পাথর আর শেওলাময় পথে আমরা সবুজ আর পাহাড়ের গভীরে ঢুকে যাচ্ছি। পাখি আর ওদের কিচিরমিচির বরণ করে নিলো একদল ইট পাথরের যান্ত্রিক শহুরে প্রাণ। আমাদের দলের কয়েকজন এই প্রথম কোনো পাহাড়ি পথে এসেছে। পাহাড়ের কাছে এসেছে। ঝরনার কাছে এসেছে। কখনো ঝিরি পথে, কখনো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলছি আমরা। যতই সামনে এগোই, ততই সৌন্দর্য বাড়ছিল। পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতে যখন সামনে হঠাৎ নাপিকাটাকুম জলপ্রপাত পেয়ে গেলাম, মনে হচ্ছিল এ আমি কোথায় এলাম? এটা কি সত্যি বাংলাদেশ! নাপিকাটাকুম জলপ্রপাতের ঠান্ডা পানিতে লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করে আবার রওনা দিলাম ওপরের দিকে। আরও ঝরনা দেখা তখনো বাকি।



নাপিকাটাকুমের ওপরে রয়েছে আরেকটি জলপ্রপাত, যার নাম ছোট নাপিকাটাকুম। সেখান থেকে কলকল ছলছল করে পানি আসছে, উপচে পড়ছে বড় নাপিকাটাকুমে।  সৌন্দর্য পেছনে রেখে কর্দমাক্ত পাহাড়ি পথে আবারও চলতে শুরু করলাম আমরা। আমরা হেঁটে যাচ্ছি ঝিরিপথ দিয়ে। পানির প্রবাহ আর গতি এখানে আরও বেশি। যতই সামনে এগুচ্ছি মনে হচ্ছে, সৌন্দর্যের একেকটা আধার উন্মোচিত হচ্ছে। জানি না সামনে কী আছে। সামনে আরও খানিকটা এগিয়ে  বিশাল এক ঝরনা বাঘবিয়ানির পায়ের কাছে উপস্থিত হলাম। এমন সবুজ পাহাড়, এত রহস্য লুকিয়ে রাখার বিদ্যা কোথায় শিখেছে কে জানে? সমস্ত বন্য আদিমতা নিয়ে বাঘবিয়ানির ঝরনাধারা সশব্দে আছড়ে পড়ছে মাটিতে।  সেই পানিতে কেউ ধ্যানমগ্ন হয়ে, কেউ শুয়ে, কেউ বসে, যে যেভাবে পারে নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলতে লাগল। বান্দরকুম ঝরনা দেখার এখনো বাকি। একটা সময় পৌঁছেও গেলাম সেটির কাছে। বিশাল বান্দরকুম ঝরনার পানির তীব্র স্রোতে নিজেকে সঁপে দেওয়া আর রহস্যময় পাহাড়ের সৌন্দর্যের কাছে আরেকবার বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কী-বা করার আছে আমাদের।



খৈয়াছড়ার পথে এখন বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল হয়েছে। এর মধ্যে পুরনো হলো ঝরনা হোটেল। আগে এখানেই খেয়েছি। এবারো এখানেই খেতে বসেছি। হোটেলটি আগের থেকে অনেক পরিপাটি হয়েছে। এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে আবার খৈয়াছড়ার পথে হাঁটতে শুরু করলাম। পথে দেখা হচ্ছে অনেক ট্রেকারের সঙ্গে। তারা নেমে আসছে। রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক পিচ্ছিল আর কাঁদা। এর মধ্যেই কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চলছি। আমরা সবাই যেহেতু তরুণ তাই খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। কাঁদাপথ, ঝিড়িপথ হেঁটে আমরা এসে পৌঁছলাম খৈয়াছড়ায়। এখানে এসে ঝরনার শীতলতা ও পানির শব্দ আমাদের মন ভরিয়ে দিলো। আমাদের দলে সবচেয়ে বেশি বয়স সুমন ভাই ও মুনের। তারা কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।  তাই তাদের দুজনকে রেখে আমি, হুমায়ুন ও মামুন উপরের ধাপগুলো দেখতে উপরে উঠে গেলাম।



যেভাবে যাবেন: যারা ঢাকা থেকে আসবেন, তারা পথিমধ্যে মীরসরাই নেমে গেলে ভালো। ঢাকা হতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যেসব বাস ছাড়ে সেই বাসেই আসা যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৪৮০ টাকা নন এসি। মীরসরাই নেমে সকালের নাস্তা করে সিএনজি করে নদুয়ারহাট চলে আসবেন। ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা। ভ্রমণের সুবিধার জন্য সাথে গাইড নেয়া ভালো। গাইডের জন্য মৌসুম ভেদে ৩০০-৫০০ টাকা লাগতে পারে। নদুয়ার হাটে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এজন্য মীরসরাই আসতে হবে। একদিনের মধ্যেই ঘুরে আসা যায়, থাকার দরকার হয় না। থাকার জন্য সীতাকুন্ডে নিম্নমানের হোটেল পাওয়া যায়। ভালো হোটেলের জন্য শহরের দিকে আসতে হবে।

সঙ্গে যা নিতে হবে: যেহেতু পাহাড়ি রাস্তা, সেহেতু ভালো গ্রীপওয়ালা বেল্টের স্যান্ডেল উত্তম। কারণ ঝিরিপথে হাঁটবেন; কাঁদা, পানি দিয়ে হাটতে হবে। কিছু ব্যান্ডেজ আর ডেটল জাতীয় এন্টিসেপটিক নিতে পারেন। যেহেতু ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা, তাই যাওয়ার আগে স্থানীয় ডাক্তারের সাথে কথা বলা উচিত। আর সাথে কিছু হালকা শুকনা নাস্তা আর খাবার পানি এবং শুকনা কাপড়। যেহেতু এখন বৃষ্টি হচ্ছে তাই ছাতা অথবা রেইন কোট নিতে ভুলবেন না।



সতর্কতা: ঝরনায় গিয়ে অনেকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। ফলে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। তাই ঝরনার পানিতে বেশি লাফালাফি করবেন না। ঝরনার একদম পাড়ে দাঁড়াবেন না। কারণ ঝরনা পিচ্ছিল হয়। ঝিরিপথে হাঁটার সময় সতর্কতার সাথে হাঁটবেন। আরেকটি কথা না বলে পারছি না, প্রকৃতির প্রতি যাদের সচেতনতার অভাব আছে তার প্রকৃতির কাছে যাবেন না। কারণ এতে সুন্দর প্রকৃতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এখন এক শ্রেণীর ট্রেকার তৈরি হয়েছে যারা শুধু ট্রেকিংই করে। তাদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা নাই। যে যেভাবে পারছে পাহাড় ও ঝরনা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এবার ট্রেকিং করতে গিয়ে আমি খুবই অবাক হয়েছি। ঝরনার পানিতে বা ঝিরিতে পানির বোতল, পলিপ্যাক, চিপস, চকলেট এমনকি খাবারের প্যাকেটও দেখেছি। ফলে ঝরনার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে এবং প্রকৃতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যাদের মধ্যে এই বোধটুকু নেই তারা প্লিজ পাহাড় ও ঝরনায় যাবেন না।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়