ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান: তৃতীয় পর্ব

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ১৭ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান: তৃতীয় পর্ব

শিহাব শাহরিয়ার : পরদিন সকালে সূর্যের আলো ফুটে উঠেছে পাহাড়ি শহর থিম্পুর গায়ে। আমরা তৈরি হয়ে হোটেলে পাশেই একটি রেস্টুরেন্টে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লাম। দেখলাম শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা একটি নদী- ওয়াংচু। ভুটানিজরা তাদের ভাষায় নদীকে ‘চু’ বলে। আমরা থিম্পুতে দু’দিন থাকবো সেজন্য ওয়েংডি আমাদেরকে সেভাবেই ঘুরিয়ে দেখাবেন।

আমরা গাড়িতে উঠলাম।সে আমাদের নিয়ে চলল, দর্শনীয় স্থানগুলো দেখানোর জন্য। প্রথমেই নামালো থিম্পুর স্মৃতি সৌধের কাছে, সকালের রোদে অনেক পর্যটক ও স্থানীয় লোকজন সৌধের আশেপাশে ঘুরছে, ছবি তুলছে, আমরাও কিছুক্ষণ তাই-ই করলাম। তারপর Budhdhah Point এর দিকে, যেখানে চারশ বছরের পুরনো Tample রয়েছে। গাড়ি  আঁকাবাঁকা পথ ধরে উপরের দিকে উঠছে। প্রায় তিরিশ মিনিট পর আমরা ভুটানের সবচেয়ে বড় বুদ্ধ-ভাস্কর্যের কাছে এলাম। হলুদ ব্রঞ্জের বিশাল ভাস্কর্য এটি। পুরো জায়গা পাকা এবং পরিচ্ছন্ন। বুদ্ধের ছবি তোলা নিষেধ। সেদিন সেখানে চলছিল বৌদ্ধদের একটি বাৎসরিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। হাজার হাজার অনুরাগী-ভক্ত ও আয়োজকদের পদচারণায় মুখর হয়ে আছে এলাকা। আমরা কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে, ছবি তুলে পাশের একটি পাহাড়ে উঠলাম। সবুজ গাছপালায় শোভিত পাহাড়ের চূড়া থেকে তাকালাম নিচের থিম্পু শহরের দিকে। এ এক মন ভরে যাওয়ার মতো দৃশ্য। আমরা কিছু সময় সেখানে বসে, হেঁটে ছবি তুলে চলে এলাম গাড়ির কাছে। এরপর ওয়েংডি আমাদের নিয়ে গেল নিচে শহরের দিকে।

দুপুরের খাবার খেয়ে আমার ওয়াংচু নদীর কাছে গেলাম। তার আগে একটি বাজারের কাছে আমরা থামলাম। ওয়েংডি জানাল, এই বাজারে কৃষকরা সরাসরি তাদের শাকসবজি, ফল-মূল, তরি-তরকারি, মাছ-মাংস ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে সপ্তাহে ছয়দিন উপস্থিত হয়। আমরা কিছু ফল কিনলাম- যেমন ফরমালিনবিহীন টাটকা আপেল, কলা, পেঁপে এইসব। খেতে বেশ লাগল। এরপর নদীর কাছে গেলাম একটি পার্কের ভিতর দিয়ে। নদীর তলায় ছোট-বড়, সাদা-কালো পাথর আর পাথর, তার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলের পাহাড়ি নদী। খরস্রোতা নদীর একটানা বয়ে যাওয়া জলের শব্দ আমাদের ভিতরে জাগাল অন্যরকম শিহরণ। নদীর পাড় থেকে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।
 


থিম্পুতে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। একটি মন্দিরের বয়স প্রায় চারশ বছর বলে আমাদের গাইড কাম চালক জানাল। পরদিন সকালে আমরা গাড়িতে উঠলাম, ও নিয়ে চলল Changangktta এর দিকে। এখানেই এই পুরনো মন্দিরটি। অনেক উপরে। গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম। সমতলের মানুষ আমরা, হঠাৎ করেই পায়ে হেঁটে এতোটা উপরে ওঠা আমাদের জন্য কষ্ট তো বটেই। তবু কষ্ট করে ধীরে ধীরে উঠলাম। মন্দিরটির চতুর্দিকে ঘণ্টি দেয়া, যা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে একের পর এক ভক্তরা। ভিতরে রয়েছে বুদ্ধ মূর্তি, সেখানে প্রসাদ দেয়া ও প্রার্থনা চলছে। আমি বৌদ্ধদের মন্দিরের প্রার্থনা যজ্ঞ বাংলাদেশে ও শ্রীলঙ্কায় দেখেছি। কিন্তু আমার স্ত্রী-পুত্ররা তা দেখেনি। ফলে ওদের আগ্রহের কারণে আমিও আরেকবার দেখলাম। মন্দির থেকে বেরিয়ে পাশে দাঁড়াতেই নিচে  দেখতে পেলাম থিম্পুর মূল শহর। রোদের আলোয় পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় একই পের্টানের বাড়ি-ঘর, বসতি দেখে দারুণ অনুভূতি হলো। সেখান থেকে আমরা নেমে রাজার বাড়ির দিকে গেলাম। পাহাড়ের পাদদেশে ওয়াংচু নদী ও সবুজ শস্য খেতের পাশে ওদের ঐতিহ্যিক স্থাপনায় গড়ে তোলা প্রাসাদসম বাড়ির কাছ দিয়ে গেলাম। নিরাপত্তার তেমন কঠোর ব্যুহ নেই। ওদের রাজা জনগণের খুব কাছাকাছি থাকেন। এই দু’দিনেই বুঝে গেলাম এরা অত্যন্ত সহজ-সরল ও আন্তরিক। আর পরিবেশ, অসাধারণ। কোলাহল নেই, শহরের রাস্তায় গাড়ির হর্ণ বাজে না বল্লেই চলে, নিয়ম মাফিক চলছে চলাচল, কেউই একটা ময়লা পর্যন্ত ফেলে না রাস্তা-ঘাটে, প্রয়োজন ছাড়া ওরা কথাও বলে না। চুরি-রাহাজানি-ছিনতাই ইত্যাদির বালাই নেই। তাই ভাবলাম, হিমালয়ের প্রান্তের একটি অন্ধগলির দেশ, এই আচরণে ও সততার কারণে উন্নত রাষ্টের দিকে এগোচ্ছে ভুটান।

পরদিন থিম্পুকে বিদায় জানিয়ে আমরা ছুটে চললাম, ভুটানের আরেক উল্লেখযোগ্য শহর পুনাখার দিকে। পথেই পড়ল, দোচালাপাস। জায়গাটি নির্জন এবং সুন্দর। এখানে ২০০৩ সালে যুদ্ধে নিহত ভুটানিজ সৈন্যদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। আমাদের গাড়ি থামল, স্মৃতি সৌধের পাশেই। আরো অনেকগুলো গাড়ি দেখলাম। গাড়ি থেকে নেমে সৌধের দিকে গেলাম। রাস্তা থেকে একটু ওপেরে । সবাই ছবি তুলছে, আমরাও। তখন বেলা এগারোটা হবে। দেখলাম মেঘেরা এসে আমাদের ছুঁয়ে দিচ্ছে। সৌধ থেকে নেমে রাস্তার পাশে বৃক্ষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাদা মেঘগুলো ক্রমশ আমাদের ভেদ করে চলে যাচ্ছে। শরীর শীতল হচ্ছে। এতো নির্মল, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ আর পাবো কি? তাই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে থাকলাম। জীবনের এই এক অনাবিল রস পান করা যেন। তারপর গেলাম পাশের বাগান শোভিত একটি রেস্টুরেন্টে। অত্যন্ত আধুনিক মানের একটি রেস্টুরেন্ট। এখানে দেখা হলো বেশ কয়েকটি বাঙালি পরিবারের সঙ্গে। চা-কফি আর হালকা নাস্তা সেরে আমরা আবারো পুনাখার পথে নামলাম। যেতে যেতে সেই একই দৃশ্য। পাহাড়, নানা প্রজাতির বৃক্ষ, লতা-গুল্ম, ফুল-পাখি, ঝরনা-নদীর কলতান। সাপের মতো সরু পাকা পথ বেয়ে যাচ্ছি ভুটানের প্রশাসনিক শহর পুনাখার দিকে। কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পেলাম রোদে ঝলমল করছে পুনাখা।
 


পুনাখায় দু’টি নদী প্রবাহিত হচ্ছে- একটি পুরুষ নদী ও একটি নারী নদী। এই দুই নদীর সঙ্গমস্থল পেরিয়ে আমরা গেলাম শহরের এক প্রান্তে, যেখানে ঝুলন্ত সেতু পার হয়ে যেতে হয় ১ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি মন্দিরে। মন্দিরটির নাম Khamsuwile মন্দির। পুনাখার এটি দর্শনীয় স্থান। বিদেশিরা দেখতে যান আর দেশীয় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা প্রার্থনা করতে আসেন। এমনকি রাজা স্বয়ং এখানে ওঠেন পায়ে হেঁটে বিশেষ দিনগুলোতে। আমরা সাহস করে  হাঁটতে শুরু করলাম। সেই পাথর, বালি আর খরস্রোতা জলের নদী পার হয়ে, ধান খেতের আল পথ পেরিয়ে উঠতে থাকলাম মন্দিরের চূড়ায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি সবাই কিন্তু সিঁড়িপথ আর কমে না। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেল টিপটিপ বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোটা মাথায় নিয়েই অবশেষে উঠলাম মন্দিরের দ্বারে। সাদা চামড়ার বিদেশি পর্যটকদেরও দেখলাম মন্দির পরিদর্শন করে বের হতে। আমরা সবাই এক এক করে ঢুকলাম। ছোট ও চাপা সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরের ছাদে গেলাম, তখন বৃষ্টি সরে  গেছে। ছাদে ওঠার পর সে এক নান্দনিক দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। মনে হলো সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য ছাড়িয়ে আরো কোনো সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়ালাম। তাকালাম নদীর দিকে, তাকালাম পাহাড়ের দিকে, তাকালাম পাহাড় আর নদীর মধ্যবর্তী বিস্তৃীর্ণ সবুজ ধানক্ষেতের দিকে। এই ভালোলাগার কোনো সংজ্ঞা নেই। মনে হলো পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় এইসব দৃশ্যের শরীর বেয়ে। আহা! সেখান থেকে নামতে নামতে মন্দিরের সবটা দেখা হলো, খুবই পরিচ্ছন্ন মন্দিরটি। মন্দিরটির লনও পরিপাটি করে সাজানো।

মন্দির থেকে নেমে গেলাম সানসেশন ব্রিজ দেখতে। সে আর এক সুন্দর জায়গা। ঝুলন্ত স্টীলের এই ব্রিজের নিচে নদী, জল, বালি, পাথর আর কাশফুল, উপরে নীলাকাশ, সাদা-কালো মেঘ। মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ দাশের কথা। প্রকৃতির বর্ণনা তারা তাদের কবিতায় যেভাবে তুলে এনেছেন, এই নদী তীরে দাঁড়িয়ে তা স্পষ্ট হলো আবারো আমার মনে। ব্রিজটি সবাই মিলে পার হলাম। ওপারে গ্রাম আর সবুজ নির্জন শস্যাঞ্চল। সেখান থেকে গেলাম ভুটান সরকারের প্রশাসনিক ভবনের কাছে।
 


নদীর তীরে অসাধারণ কাঠামোয় গড়ে তুলেছে তারা এই ভবন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলে আমরা এই ভবন ঘুরে দেখার সুযোগ পেলাম না। ভবনের পাশেই কাঠের ব্রিজ। ব্রিজ দিয়ে নদীর ওপর পাড়ে গেলাম। তুললাম কয়েকটি ছবি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ফিরে গেলাম হোটেলে। হোটেলে গিয়ে লিখলাম পুনাখাকে ভালবেসে একটি কবিতা:

‘মন ওড়ে বাতাসে

পুনাখার সাসপেনশন ব্রিজ

আমাকে দোলালো সন্ধ্যার আলোয়

সাদা সাদা ফুল, পাথর, বালি আর জল

এসব তলার দৃশ্য-শরীর

উপরে ওড়ে

বাতাস, মেঘ, মাটি আর সুড়কি পথ

এমন মেঘের মন

আমি কি পাবো কোনোদিন?

আমাদের এক হাত

পুরুষ নদীর দিকে

অন্য হাত

নারী নদীর সঙ্গম-স্থলে

এ আমাদের যৌথ জীবন

আমরা উঠে যাই পুনাখা ও পারোর

বনজ গন্ধের দিকে

কোথায় ঘুম, কোথায় চোখ

থিম্পুর আচরণ পাহাড়ি মেয়েটির মুখের মতো

এখানে শুধুই ওড়াউড়ি

এখানে শুধুই অভিমানী মেঘের মন

এখানে শুধুই ঘোড়ার খুরের মতো

পাহাড় বেয়ে গাড়ির ওঠা-নামা

আমরা পাহাড়ের মন বোঝে বোঝে

অবশেষে খোঁজে পাই আয়নার জানালা।’

॥ চলবে ॥




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়