ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই

(কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালী আলোয়: ৭ম পর্ব)

ইকরামুল হাসান শাকিল: মনে পড়ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতা:

‘অনেকদিন থেকেই

আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।

কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।

যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না।

আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,

সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।

কে না জানে পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশি।

পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।

তবু আমি নদীর

বদলে পাহাড়ই কিনতাম।’

রাত ১০.৩০ মিনিট। দা কিপা আমাদের ডেকে ওঠালেন। যদিও কথা ছিলো রাত ১২ টার সময় আমরা ঘুম থেকে উঠে সামিটের জন্য প্রস্তুতি নেবো। দা কিপা ভেবেছিলেন আমাদের ওঠার সময় হয়েছে। তাই তিনি আমাদের ডেকে উঠিয়েছেন। এমনিতেই আমার ঘুম হয়নি। নানান ভাবনা জাগিয়ে রেখেছে আমাকে। দা কিপা আমাদের তাবুতে এসে চা দিয়ে গেলেন। তাবুর জিপার খুলে দেখি আবহাওয়া খুব ভালো। আকাশ তারায় ভরে গেছে। বাইরে খুব শীত। ঠান্ডা বাতাসও বইছে। আমরা স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে বসেই চা পান করছি। চায়ের স্বাদ এতই ভয়ঙ্কর যে গলা দিয়ে নামছেই না। পেটের ভেতরের সবকিছু বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবুও গিলতে হচ্ছে। কাপের নিচে একটু রাখলেই নূর ভাই তাবুর ভেতর থেকে মুহিত ভাইকে ডেকে বলেন- শাকিল একটুও খাচ্ছে না। আর মুহিত ভাই তার তাবুর ভেতর থেকেই আমাকে সবটুকু খেতে আদেশ করেন। আমিও জীবনের শেষ খাবার মনে করে তখন খেতে বাধ্য হই।

সবাই প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছি। রাত ১২.৩০ মিনিটে তাবুর বাইরে সবাই বের হলাম। হেটলাইট, আইচ বুট, হারনেস পরে নিলাম। রাতের তাপমাত্রা মাইনাস বিশ ডিগ্রি। তাই গরম থাকার জন্য কয়েক স্তরের পোশাক পরতে হয়। তবু শীতের কারণে দাঁড়িয়ে থাকাই কষ্টকর। ঠান্ডা বাতাসও অনেক বেশি। দা কিপা ও কিলি পেম্বা আমাদের আরোহণের জিনিসগুলো ভালোভাবে দেখে নিচ্ছেন। ঠিক রাত ১টার সময় আমরা সামিটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চারদিকে অন্ধকার। প্রথমেই হাইক্যাম্প থেকে বরফের ঢাল বেয়ে নিচে নামলাম। চারপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র সামনের জনের পায়ের স্টেপ দেখে এগিয়ে চলছি। একটি লেকের কিনার দিয়ে এগিয়ে চলছি। লেকের পানি জমে বরফ হয়ে আছে। সেই বরফের উপর দিয়েই হেঁটে চলছি। নেই পতা ঝড়া শব্দ, কোনো পাখি কিংবা ঝিঁঝিঁর শব্দ। শুধু আমাদের পায়ে বরফের কচকচ শব্দ হচ্ছে।



কিলি পেম্বা সবার সামনে তারপর মুহিত ভাই, বিপ্লব ভাই, আমি, শামীম ভাই, নূর ভাই ও সবার শেষে দা কিপা শেরপা। এই একই তালে এগিয়ে চলছি অমোঘ এক অনিশ্চয়তার দিকে। এখনো ক্র্যাম্পন লাগাইনি। তাই মাঝে মাঝে পা পিছলে যাচ্ছিলো।

ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর আমাদের চড়াই শুরু হয়। অন্ধকার থাকায় পাশের ভয়ঙ্কর খাদ কিংবা বরফের ফাটল দেখতে পারছি না। দেখতে না পাওয়াটাও ভালো। এর কারণ পাহাড়ের একদম পাড় ঘেঁষে হাঁটার সময় ভয়ের বিষয় থাকে না।

আকাশে মেঘ নেই। এত সুন্দর আকাশ আগে কখনো দেখিনি। আকাশ ভরা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। শ্বেতশুভ্র পুতপবিত্র বরফের পাহাড়গুলো তাদের রূপ রাতের অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে। কোনো শিল্পীর তুলি পারবে না এই সৌন্দর্য ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে। কোনো ভাষাতেও প্রকাশ করা সম্ভব না। ক্লান্ত রাতটাও পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে। আর আমরা ছোট-বড় পাথরের বোল্ডারের উপরে দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলছি। পাথরগুলো খুব নড়বড়ে ছিলো। ভূমিকম্পের কারণে রাস্তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই রাতের সেই অন্ধকারেই খুবই সতর্কতার সাথে সামনে এগিয়ে চলতে হচ্ছে। এই পাথুরে ও বরফের খাড়া ঢাল বেয়ে প্রায় ১৬০০ ফুট উঠে একটি ৯০ ডিগ্রি খাড়া দেয়ালের নিচে এসে কিছু সময় বিশ্রাম নেই। তারপর এখানেই আমরা ক্র্যাম্পন পড়ি।  দিনের বেলায় হাঁটার চেয়ে রাতে হাঁটার গতি বেশি থাকে এবং ক্লান্তিও কম লাগে। সেই কারণে আমরা খুব দ্রুত কেয়াজো-রির কোলে পৌঁছে যাই। কোলে উঠে আসার আগেই সেই দেয়াল ফিক্সড রোপের মাধ্যমে জোমারের সাহায্যে উপরে উঠে আসি।

কোলে ওঠার পর কিছুটা অন্ধকার কেটে দিনের আলো দেখা দিচ্ছে। ভোরের প্রথম আলোয় চারপাশ এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। দূরে পুব আকাশে পর্বতের আড়াল থেকে সূর্য তার আগমনি বার্তা দিচ্ছে। আকাশটাও লাল হয়ে উঠেছে। উঁচু উঁচু পর্বতের চূড়ায় সূর্যের আলো পড়েছে। তাই চূড়াগুলোও লাল হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে নাটকের মঞ্চে নির্দিষ্ট স্থানে আলো ফেলা হচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে একে একে সবাই উপরে উঠে এলো। কিলি পেম্বা ব্যাগ থেকে একটি দড়ি বের করলো। সেই দড়িতে আমরা সাতজন গ্রুপ রোপিং করে প্রায় ৪৫ ডিগ্রী খাড়া ঢাল বেয়ে উঠছি। বরফের দেয়াল। কোথাও শক্ত বরফ যেখানে ক্র্যাম্পনও ভালোভাবে আটকানো যাচ্ছে না। আবার কোথাও নরম তুষার। আইস বুট বরফের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগলো আমাদের এই বরফের ঢাল বেয়ে উঠতে। তারপর আবার পাথরের দেয়াল ও বড় বোল্ডার।



সাড়ে ছ’টার সময় আমরা এই পাথরের দেয়ালের কাছে এলাম। এখান থেকেই সামিট পর্যন্ত ফিক্সড রোপ লাগানো আছে। এখান থেকেই আমাদের সামিট পর্যন্ত জুমারিং করে উপরে উঠতে হবে। আমাদের কোমরে লাগানো হার্নেস দড়ির সাথে জুমার ও ক্যারাবিনার দিয়ে আটকে নিলাম।

আইস বুটের নিচে ক্র্যাম্পন থাকায় পাথরে পা রাখা যাচ্ছে না। বারবার পা পিছলে যাচ্ছে। আমাদের শরীরে এমনিতেই কোনো শক্তি নেই। এই পাথরের দেয়াল বেয়ে উঠতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে এবং ঝুঁকি নিতে হয়েছে। অনেক কষ্টের ও পরিশ্রমের পরে কিলি পেম্বা, মুহিত ভাই, বিপ্লব ভাই, আমি, শামীম ভাই, নূর ভাই ও সবার শেষে দা কিপা একে একে উপরে উঠে আসি। এখানে বসে একটু বিশ্রাম নিলাম। ফ্লাক্সে আনা গরম পানি ও চকলেট খেলাম। আকাশে মেঘে নেই। এখনো আবহাওয়া অনেক ভালো। রোদও চলে এসেছে। এখান থেকে সামিট দেখা যাচ্ছে। আমাদের থেকে সামিট প্রায় ১৫০০ ফুট উপরে। কিন্তু পথ অনেক কঠিন। কোথাও ৮০/৮৫ ডিগ্রী আবার কোথাও ৬০ ডিগ্রী খাড়া ঢাল। কঠিন বরফের স্তর তো আছেই।

এই পথে এবং একই দড়িতে আরোহণ করে আমাদের আগে আরো তিনটি দল সামিট করেছে। তাই দড়িটি পুরোনো হয়ে গেছে। আইস পিটনগুলোও নড়বড়ে হয়ে গেছে। সেই দড়িতে আমরা সাতজন ঝুলে আছি। কী এক মৃত্যুময় আনন্দে মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে উপরের দিকে জুমারিং করছি। জুমারিং করার সময় দড়ি নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। তখন ভয়ে গা শিউরে ওঠে। মনে হয় এই বুঝি দড়ি ছিড়ে নিচে পরে যাচ্ছি। কোনোভাবে এখান থেকে পড়ে গেলে হাজার ফুট নিচের পাথরের বোল্ডার স্বাগত জানাবে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিতে।
(চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়