ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পূর্ণিমায় পূণ্যস্নান

গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ২৬ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পূর্ণিমায় পূণ্যস্নান

গাজী মুনছুর আজিজ: স্থানীয়রা বলেন পূণ্যস্নান বা গঙ্গাস্নান। কার্তিক মাসের পূর্ণিমা রাতের পরের দিন সূর্যোদয়ের সময় সাগরের পানিতে এই স্নান করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। স্নান করতেই সুন্দরবনের দুবলার চরে আসেন অসংখ্য পূণ্যার্থী। স্নান উপলক্ষে দুবলার চরে পূর্ণিমা রাতে মেলা বসে। মেলার নাম রাসমেলা। রাসমেলাকে কেন্দ্র করে পূণ্যস্নান নয়, পূণ্যস্নানকে কেন্দ্র করেই রাসমেলা বসে। অবশ্য রাসমেলায় কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আসনে তা নয়, এ মেলা দেখতে দলবেঁধে আসেন অন্য ধর্মের লোকও। আবার কেবল দেশি নয়, আসেন অনেক বিদেশিও। সেজন্য দিন দিন এ মেলা হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম ঐতিহ্যের প্রতীক।

সনাতন ধর্মাবলম্বী না হয়েও সনাতন ঐতিহ্যের খোঁজে কয়েক বছর ধরে আমি উপস্থিত হই পূণ্যস্নানের এ উৎসবে। কমলাপুর থেকে রাতের ট্রেনে রওনা দিয়ে সকালে আসি খুলনা। সেখান থেকে লঞ্চে রওনা দিই দুবলার চরের উদ্দেশে। সবুজ সুন্দরবন দেখতে দেখতে সন্ধ্যায় এসে নামি দুবলার চর। চরটি মূলত সাগরের মাঝে জেগে ওঠা বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। বছরের বেশ কিছুটা সময় এ চরে জেলেরা বাস করেন। এর কারণ শুঁটকি উৎপাদন। কয়েক দশক ধরে চরে আনুষ্ঠানিকভাবে রাসমেলার আয়োজন করে আসছেন মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) জিয়া। অবশ্য গত বছর তিনি প্রয়াত হয়েছেন। চরে একটি ছোট্ট মন্দির আছে। অনেকটা অস্থায়ী। নাম ভগবান শ্রীশ্রী কৃষ্ণের রাসমন্দির। রাসমেলার সময় কাপড় বা রঙিন কাগজ দিয়ে মন্দিরটি সাজানো হয়। মন্দিরে পূর্ণিমা রাতে ভক্তরা আসেন, পূজা করেন, প্রসাদ দেন, মানতের টাকা দেন। রাসমেলার জন্য মন্দিরে পুরোহিতও বসেন। এছাড়া মন্দিরে যারাই পূজা করতে আসেন, তাদের সবার হাতেই পুরোহিত প্রসাদ তুলে দেন; কপালে লাগিয়ে দেন তিলক।
 


মন্দিরে থাকে বিভিন্ন দেব-দেবী, রাধা-কৃষ্ণ, বনবিবি এবং পীর গাজী কালুর মূর্তি। অন্য দেব-দেবীর সঙ্গে পীর গাজী কালুর মূর্তি রাখার কারণ হলো সুন্দরবনসংলগ্ন অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানসহ সব ধর্মের মানুষই পরম পূণ্যের পীর বা দেবতা মনে করেন গাজী কালুকে। এছাড়া এদেশে যেসব পীর, ফকির বা দেবতা আছেন, তাদের মধ্যে গাজী পীরকে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ বেশি স্মরণ করেন। একইভাবে গাজী পীরকে এ অঞ্চলের মানুষ বেশি আধ্যাত্মিক শক্তিও মনে করেন। আর সে কারণেই গাজী কালুর নামে এ অঞ্চলে মানুষ পূজা দেন, পালাগানের আসর বসান, মেলা করেন।

রাস মন্দিদের পাশেই অস্থায়ীভাবে তৈরি করা হয় মেলার আনুষ্ঠানিকতার মঞ্চ। আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় সকালে পূজার মাধ্যমে। তারপর সারা দিন চলে মেলা ও নানা আনুষ্ঠানিকতা। সন্ধ্যায় ওড়ানো হয় ফানুস। এছাড়া রাসের মঞ্চে রাতভর চলে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হলেও রাসমেলা এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে এ মেলা দেশের অন্যতম ঐতিহ্য বটে। মেলায় পোশাকের দোকান, মুড়ি-মুড়কি-মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারের দোকান, নারিকেল, সুপারি, শাকসবজিরও দোকানও বসে। এসব দোকানদার আসেন খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা থেকে। রাতে সাগরের পাড়ে পূর্ণিমার আলোয় জমে ওঠা গ্রামীণ এ মেলা সত্যিই অন্যরকম। রাতভর মেলা সরব থাকে পূণ্যার্থীদের পদচারণায়।

পূণ্যস্নানের মূল আনুষ্ঠানিকতা হলো সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাগরের প্রথম জোয়ারের পানিতে স্নান করা। সে কারণেই সূর্য ওঠার আগেই সনাতনধর্মী পূণ্যার্থীরা সাগরের পাড়ে সূর্যের দিকে মুখ করে বসেন প্রার্থনা করতে। কেউ বসেন একা একা, কেউ দুজন মিলে, আবার কেউ চারজন, ছয়জন, বারোজন বা তারও বেশি। তাদের কারও সামনে জ্বলছে আগরবাতি, কারও সামনে রাখা আছে ডাব, কারও সামনে মিষ্টি জাতীয় খাবার। যারা বেশি লোকের দলে বসেছেন, তাদের আবার একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পাঠ করাচ্ছেন, আর বসে থাকা লোকরা মন্ত্রের সঙ্গে প্রার্থনা করছেন। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যখন জোয়ার শুরু হয় এবং সে জোয়ারের পানি পূণ্যার্থীদের গায়ে এসে লাগলেই পূণ্যার্থীরা প্রার্থনা শেষ করে নামেন সাগরে স্নান করতে। অনেকে পূণ্যস্নানের সঙ্গে মানত করেন। মানত করে কেউ কেউ স্নানের সঙ্গে সঙ্গে ছাগল, মুরগি, ডাব, ফলমূলসহ বিভিন্ন খাবার সাগরে ভাসিয়ে দেন বাসনা পূরণের আশায়। স্নানে অংশ নেন নানা বয়সের নারী-পুরুষ। তাদের বিশ্বাস স্নান করলে পাপ মোচন হয়ে যায়।

পূণ্যস্নানে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এসেছেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের প্রায় ৬০ বছর বয়সী কালাচাঁদ বিশ্বাস। তার মুখে শোনা হলো ইতিহাসের পাতায় লেখা রাসমেলা ও পূণ্যস্নানের কথা। শোনা যায়, ১৯২৩ সালে হরিচাঁদ ঠাকুরের বনবাসী ভক্ত হরিভজন মেলা শুরু করেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবী শ্রীকৃষ্ণ শত বছর আগে কার্তিকের পূর্ণিমা রাতে পাপমোচন ও পূণ্যলাভের আশায় গঙ্গাস্নানের জন্য স্বপ্নে আদেশ পান। তখন থেকেই এ মেলার শুরু। আবার অনেকে মনে করেন, শ্রীকৃষ্ণ বনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসলীলা করেছিলেন কার্তিকের পূর্ণিমা রাতে। সে উপলক্ষেই এ মেলা বসে। সাগরের কোলঘেঁষা দবুলার চরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কুঙ্গা ও মরা পশুর নদী। সব সময় এ চরে লোকজন বাস করে না। তবে শীত মৌসুমে বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন এলাকার জেলেরা এখানে এসে সাময়িকভাবে বসবাস করেন এবং তারা শীত মৌসুমজুড়ে চরের আশপাশের নদী ও সাগরে মাছ ধরেন এবং শুঁটকি তৈরি করেন। বিশাল দুবলার চরটির কয়েকটি অংশ রয়েছে। যেমন আলোরকোল, মেহেরআলীর খাল, মাঝের চর, অফিসকেল্লা, নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী, শ্যালারচরসহ ইত্যাদি নামে।
 


দুবলারচরকে অনেকে জেলেপল্লী বা শুঁটকি পল্লীও বলেন। আর এ পল্লীর কার্যক্রম চলে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। মাছধরা ও শুঁটকি তৈরির কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিকতাও শুরু হয় রাসমেলার পূণ্যস্নানের মাধ্যমে। পল্লীর মাছ ও শুঁটকি ব্যবসায়ী রেদওয়ান শেখ জানান, এ চরে শীত মৌসুমে প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার লোক বসবাস করে, তারা কেউ জেলে, কেউ নৌকা ও জালের মালিক, কেউ নৌকা চালায়, কেউ শুঁটকির শ্রমিক। মাছ ধরার জন্য অনুমতি নিতে হয় বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের সদর দফতর থেকে। অনুমতি দেওয়া হয় ট্রলার বা নৌকা ও জাল হিসেবে। প্রতি ট্রলারের জন্য রাজস্ব ফি ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। আর এখানকার মাছ বা শুঁটকি বিক্রি হয় চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে।

ছবি : লেখক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ নভেম্বর ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়