ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চুনিয়ার পূর্ণিমার রাত অন্তরে পশেছে || শেষ কিস্তি

মাহমুদ নোমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ২২ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চুনিয়ার পূর্ণিমার রাত অন্তরে পশেছে || শেষ কিস্তি

মাহমুদ নোমান : ৭ নভেম্বরের সূর্য তখন ডুববে, জনিক নকরেকের মাটির ঘরের দাওয়ার সামনেই বাঁশের বেত দিয়ে তিন-চার হাত উঁচু করে একটা দেবতার অবয়ব তৈরি করলো। এর সামনে খামাল জনিক নকরেক বসে মন্ত্র পাঠ করছে দাঁতহীন চোয়ালে, অনর্গল পাঠ করে যাচ্ছে আচিক ভাষায়। বুঝলাম না ভাষাটা। তবে কিছুটা আঁচ করেছি, ওনার মুখে পানি কুলি করে দেবতার অবয়বের চারদিকে ধূপের লিকলিকে ধোঁয়ায়। ফসলের ওপর অশুভ শক্তির বিনাশে দেবতার পূজা করছেন। এই পূজোকে রাক্কাশি আমুয়া বলে। বাঁশের বেতি দিয়ে দুইদিকে যেগুলো ঝুলানো আছে ওগুলো মিদ্দি রাক্কাশির অলংকার, গলার মালা আর কানের দুল। এই অবয়বের নিচে একটা লাল টকটকে পালকের দেশি মোরগ এনে কাটলো। অবয়বের ঠিক গলার কণ্ঠরেখায় মোরগের আঁতুড়ি ঝুলালো। সন্ধ্যে ঘনালে জনিক আচ্ছুর দুই ঘরে রুগালা পূজা করলো। আগে চুনিয়ার প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে এই রুগালা পূজা করা হতো। এটি মূলত উৎপাদিত নতুন ফসল দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। বলটং, দামা, আদুরি বেজে ওঠলো ধুপের লিকলিকে ধোঁয়ায়...

এরপরে এলেন উঠানে, তখন সন্ধ্যের শেষ। আবার দামা, আদুরি, বলটং বেজে ওঠলো জোরসে। কলার পাতায় বরাবরের মতো পূজার নানান উপকরণে খামাল জনিক নকরেক মন্ত্র জপে যাচ্ছে... এই পূজার নাম জলআন্না। দেবতাদের ভোগ দিয়ে এই পূজা করা হয়। আমার ভেতরটা কেমন জানি রোমাঞ্চে আর অচেনা সবকিছুর খাপে আলাভোলা...

 



আমার মনটাতে কেমন করা বুঝতেও পারলাম না। পূজার পরে শামিয়ানা টানা উঠোনে দুটো বেশ বড়সড় দিক্কাভরে চু... জগে করে কিশোর-কিশোরীরা আগত অতিথিদের চু দিয়ে হাতে গ্লাস তুলে দিচ্ছে, কখনো হাতের খালি গ্লাস ভরিয়ে দিচ্ছে। চলছিল সারারাত চু গেলা। রাতের খাবার খেলো কিনা জানি না। আমি রাত দশটার আগে ফিরে এলাম। ভাত খেয়ে অচেতন ঘুমে ডুবে গেলাম ক্লান্তিতে...।

হঠাৎ শীত ঝেঁকে আসা ভোররাতে দরজায় কড়া নাড়লো কেউ যেন। হয়তো এমনটা মনে হয়েছে। পূর্ণিমাদের বাড়ির উঠোনে কয়েকজনের কথাবার্তা শুনা যাচ্ছে স্পষ্ট। দরজা খুলতেই দেখলাম আসমা বীথি উঠোনে হাঁটাচলা করছে। পূর্ণিমা রেডি হচ্ছে জনিক নকরেকের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। আমিও দুচোখ ঢলে ঢলে তাদের পিছনে এগিয়ে গেলাম। ঠাণ্ডা লাগছে, বুকে দুহাতে চেপে বগলে আড়াআড়ি গুঁজে এগোলাম। জনিক নকরেকের মাথায় তখন দুমি গুঁজে দিচ্ছে। মাথায় বেঁধে দিচ্ছে সাদা ধুতি দিয়ে পাগড়ি। লিচু গাছের তলা থেকে বিছিয়ে দিলো সাদা ধুতি। সেদিক থেকে হেঁটে আসছে খামাল মানে জনিক নকরেক। এক মহিলা ময়দার জল ছিটাচ্ছে দামা-আদুরির বাজনার তালে তালে নেচে। আমার প্যান্টে ছিটে পড়লো কয়েক ফোঁটা। যেন আমার স্বপ্নে এসব ঘটে যাচ্ছে। আসমা বীথির ক্যামেরায় তখন এসব স্মৃতি ফ্রেমবন্দি হচ্ছে। আমিও আমার মোবাইলে দামা-আদুরির বাজনায় তুলে যাচ্ছি...। ভোরের আলো তখন ফুটছে, সাদা ধুতির বিছানো গালিচায় জনিক নকরেকের হেঁটে আসার শেষ হতেই...।

 



এই পূজার নাম ওয়ানচি গাদেবঙ্গা। মিসি সালজংকে ওয়ানগালার বাড়িতে অভ্যর্থনা জানিয়ে নকমান্দিতে নিয়ে আসার প্রতীকী পূজা। মানে ৮ নভেম্বর। সকাল হতেই শূকর (ওয়াক্) রান্না চলছে ধুমধাম। দুপুরে হঠাৎ তেজালো রোদে মানুষের সমাগম। জনিক নকরেকের বাড়ির উঠোন কানায় কানায় ভর্তি। সবার কপালে ময়দার জল দিয়ে ত্রিকোণা চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে কয়েকজন তরুণী। এটা নাকি মান্দিদের কাছে আশীর্বাদের তিলক এঁকে দেওয়া; স্থানীয়দের কলার পাতায় আর অতিথিদের বাসনে করে শুরু হলো দুপুরের ভোজন। সন্ধ্যার পরপরে শামিয়ানা টেনে বেতঝাড়ের পাতা, কলা পাতায় বিভিন্ন সাজে সজ্জিত স্টেজে মান্দির নিজস্ব আচিক ভাষার রে’রে ও সেরেন্জিংসহ বিভিন্ন ধরনের গানে কেউ নাচতে আসছে, কেউবা আসছে গাইতে...।

রাতে তেমন ছিলাম না। কেবল অনুষ্ঠানের পরে গভীর রাতে আরেকবার গেলাম। আগত অতিথিসহ মান্দিদের ছোট বড় সবাই দামা বাজিয়ে নাচছে চু খেয়ে খেয়ে। অন্যরকম এক জগৎ, সব যেন রঙিন আর ঘোলা ঘোলা। উঠোনের ধুলো একহাত পরিমাণ ময়দা হয়ে জমে গেছে নির্ঘাত...।

পরেরদিন পূজা তেমন ছিল না। অতিথিদের বিদায়ের পালা। গতকালের থেকে যাওয়া চু বা শূকরের মাংসে দুপুরবেলা চলল। আমার কোনোটা হলো না, পূর্ণিমার মা মানে মা মিথিলা আমার জন্য রান্না করে রাখেন। সন্ধ্যার আগে আগে মা মিথিলা নিজের গায়ের শাল দিলেন আমাকে। কেমন জানি মাটি-মাটিমাখা, দরদে চুনিয়া ছেড়ে আসতে শোকে অনড় বিনিময় বাসে...।

 



খুব মনে পড়ছে জনিক নকরেক মানে আচ্ছু জনিকের কথা। ওনি প্রায় এখন স্বপ্নে মৃত মানুষের হাতছানি দেখছেন! মান্দিদের স্বপ্ন নাকি সত্য হয়। আচ্ছু জনিকের শেষ ইচ্ছে- ওনাকে যেন সাংসারেক নিয়মে মরার পর পুড়ানো হয়... আহা, এক সাংসারেক মনে জগৎ-সংসারের কী মায়া আঁটসাঁটো; এসব মায়া ঠেলে ফিরতে হয় তবুও। মন সেতো লুটে আছে চুনিয়ার ধুলোতে। চুনিয়ার পূর্ণিমার রাত চুপচাপ বসে আছে, ভালোবাসায় ব্যাকুলতা নিয়ে, কোনো দরদীর পায়ের খুব কাছাকাছি...।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মার্চ ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়