ঘোড়ামারার বটতলায় অন্যরকম মেলা
গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম
গাজী মুনছুর আজিজ : বৈশাখের দ্বিতীয় দিন এই মেলা বসে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের পেরাব গ্রামের পাশে। মূলত বৈশাখের দ্বিতীয় দিন ঘোড়ামারা সেবাশ্রমে সনাতনধর্মীরা পূজা করেন। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সাধু ও পুণ্যার্থীরা আসেন এবং এই উপলক্ষে মেলা বসে।
জায়গাটির নাম ঘোড়ামারা। তাই মেলার নামও ঘোড়ামারা। বৈশাখের দ্বিতীয় দিন দুপুরের কিছু আগে হাজির হই মেলায়। দর্শনার্থীর ভিড় তখনও বাড়েনি। বিক্রেতারা পণ্য সাজাচ্ছেন। কারণ তারা জানেন দুপুর যতো গড়াবে ততো ভিড় বাড়বে মেলায়। জায়গাটি খুব বড় না। চারপাশে ফসলি জমি। এরই মাঝে একটু জায়গায় মেলা বসেছে। মেলার মাঠের একপাশে বড় একটি বটগাছ। গাছের গোড়া সিঁড়ির মতো করে ইট দিয়ে পাকা করা। সিঁড়িতে সাদা রং দেয়া। সাদার উপর লাল রঙে লেখা: ‘ঘোড়ামারা সেবাশ্রম’। মূলত এই সেবাশ্রমকে কেন্দ্র করেই মেলা।
বটগাছের পাশে আমগাছসহ অন্য গাছও আছে। আর গাছের পাশে আছে টিনসেডের ছোট্ট একটি ঘর। দুপুরের দিকে সেবাশ্রমের পুরোহিত যাদপ সাধু এসেছেন। তাকে বসতে দেওয়া হয়েছে বটগাছের গোড়ার পাশে খেজুর পাতার পাটিতে। সাদা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরা সাধুর পুরো কপালে বয়স্ক এক নারী ছোট ছোট ফোটা দিয়ে দিচ্ছেন। এরপর সাধুর দুই কানে ও মাথার চুলে গুজে দিলেন জবাফুল। জবাসহ অন্য ফুল দিয়ে বানানো মালা সাধুর গলায় পরিয়ে দেয়া হলো। ছিটানো হলো গোলাপজল। পুণ্যার্থীরা সাধুকে প্রণামের পাশাপাশি টাকা দেন। কেউ কেউ তার কাছ থেকে বিপদ-আপদ-রোগ-বালাই থেকে মুক্তির জন্য আশীর্বাদ নেন।
লক্ষ্য করলাম, বটগাছের গোড়ায় পানিভর্তি কলসি রাখা হয়েছে। মাটির এ কলসিতে রঙিন আলপনা আঁকা। অনেক পুণ্যার্থী বটগাছের গোড়ায় মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছেন। কেউ দিচ্ছেন বিভিন্ন ফল ও টাকা। একজন দাঁড়িয়ে ঢোল পেটাচ্ছেন ও অন্যজন বাজাচ্ছেন ঘণ্টা। ধীরে ধীরে সাধুর কাছে জড়ো হওয়া পুণ্যার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এই ফাঁকে আমি মেলায় ঘুরতে শুরু করি। এরই মধ্যে মেলায় দর্শনার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে।
মেলায় হরেক রকম পণ্যের ভিড়ে আচারের সমারোহ একটু বেশিই মনে হলো। তাই প্রথম দেখায় যে কেউ ধারণা করতে পারেন- এটা বুঝি আচারের মেলা। চালতা, বরই, তেঁতুল, জলপাইসহ নানা পদের আচার। এসব আচার কেউ সিলভারের পাতিলে, কেউ বড় বোলে সাজিয়ে বসেছেন। আচার বিক্রেতা আকবর বলেন, এ মেলায় আশপাশের গ্রামের সব বয়সী নারী-পুরুষ আসে। এর মধ্যে ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেশি। তারা আচার পছন্দ করে। সেজন্য এখানে আচার বিক্রেতা একটু বেশি। শিশুদের খেলনা নিয়েও বসেছেন কয়েকজন। মাটির তৈরি, হাতি, ঘোড়া, পুতল ইত্যাদি আছে। আরও আছে, কাপড় ও পাটির তৈরি হাতপাখা। জিলাপি আর আমৃত্তি বিক্রি করছেন যারা, তারা ক্রেতাদের সামনেই তৈরি করছেন। ক্রেতারা কিনছেন গরম গরম। আমি মাসকলাইয়ের ডালের আমৃত্তি কিনলাম। স্বাদ ভালোই। রসগোল্লা, সন্দেশসহ অন্য মিষ্টির দোকানও আছে। বিক্রি হচ্ছে মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া, গজাসহ বিভিন্ন দেশিয় খাবার।
ষাট বছর বয়সী আলমাস খন্দকার জানালেন, ১৫/১৬ বছর ধরে মেলায় মিষ্টি বিক্রি করছেন তিনি। মেলার জায়গা খুব বড় না হওয়াতে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোরা হয়ে যায়। একটা চায়ের দোকানে বসে র-চা খেতে খেতে কথা বলি স্থানীয় মাঝবয়সী হয়রত আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘোড়ামারা সেবাশ্রমকে কেন্দ্র করে এই মেলা বসলেও আশপাশের গ্রামের সব ধর্মের লোকই এখানে আসে। এটা আমাদের একটা ঐতিহ্য এবং আনন্দের বিষয়। ছোটবেলা থেকেই আমরা এ মেলা দেখে আসছি।
চা শেষ করে আসি বটগাছের গোড়ায় সাধুর কাছে। সোনারগাঁও থেকে আসা সোহেলী বেগম বলেন, ‘অসুস্থ স্বামীর জন্য সাধুর কাছে আশীর্বাদ নিতে এসেছি। সব ধর্মের লোকই সাধুর কাছে আসেন বিশ্বাস নিয়ে। সেজন্য আমরাও এসেছি।’ পুণ্যার্থী পূজা মিত্র বলেন, ‘প্রতি বছরই আমরা এই সেবাশ্রমে আসি পূজা করতে। সেইসঙ্গে সাধুর কাছ থেকে আশীর্বাদ নিই। অনেকে মানত করে। আসলে ধর্ম যেমন যার যার, তেমনি বিশ্বাসও যার যার।’
সেবাশ্রমের দায়িত্বে থাকা কর্নকমল কুমার বলেন, লোকমুখে প্রচলিত, যামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে এখানে আসেন এবং মারা যান। সেজন্য এ জায়গাটির নাম ঘোড়ামারা। এ বটগাছটির বয়সও প্রায় শতবর্ষ হবে। আমরা সনাতনধর্মীরা এখানে সনাতন পঞ্জিকা অনুযায়ী পহেলা বৈশাখে পূজা করে থাকি। সরকারিভাবে পহেলা বৈশাখ যেদিন হয়, তার পরের দিন আমরা এখানে পূজা করি। অর্থাৎ বৈশাখের দ্বিতীয় দিন। আমাদের বাপ-দাদার সময় থেকেই এই মেলা হয়ে আসছে। সন্ধ্যায় মেলা উপলক্ষে বসে চৈতালী গানের আসর।
ছবি : লেখক
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ এপ্রিল ২০১৯/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন