ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চতুর্থ পর্ব || টোকিও’র রবীন্দ্রনাথ

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০২, ৭ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চতুর্থ পর্ব || টোকিও’র রবীন্দ্রনাথ

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে প্রশস্ত রাস্তা। আমি দাঁড়িয়ে থাকি, আমার হাতে নতুন কেনা অসমো প্লাস। এই ক্যামেরা আমার ফোন দিয়ে চলে, ওজনে হালকা। আমি এক হাতে এটা চালাতে পারি। ফোনের সঙ্গে একটা সেলফি স্টিক লাগানো থাকলে যেমন ওজন হয়, এটা এর চেয়ে খুব বেশি ভারী নয়।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে একবারেই টের পেয়ে গেলাম, প্রায় একশো বছর আগেই যখন এ শহরের নগর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তখনই গাড়ি চলার পর দুই পাশে আরো দুই প্রশস্ত লেন রেখে দেয়া হয়েছিল, যেখানে মানুষ পায়ে হাঁটবে। পায়ে হাঁটার পথের সঙ্গে লাগানো সাইকেলের পথ, আছে গাছপালার ছায়া। সব মিলিয়ে গাড়ি চলার সমান গুরুত্ব দিয়ে পায়ে চলার রাস্তা।

এ রকম শান্তশিষ্ট রাস্তা দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথও, ১৯১৬ সালে। লিখেছিলেন: ‘একটা জিনিস এখানে পথে ঘাটে চোখে পড়ে। রাস্তায় লোকের ভিড় আছে, কিন্তু গোলমাল একেবারে নেই। পথের মধ্যে হঠাৎ একটা বাইসাইকেল মোটরের উপরে এসে পড়বার উপক্রম করলে, আমাদের দেশের চালক এ অবস্থায় বাইসাকেল-আরোহীকে অনাবশ্যক গাল না দিয়ে থাকতে পারত না। এ লোকটা ভ্রুক্ষেপমাত্র করলো না। এখানকার বাঙালিদের কাছে শুনতে পেলুম যে, রাস্তায় দুই বাইসাকেল, কিম্বা গাড়ির সঙ্গে বাইসাকেলের ঠোকাঠুকি হয়ে যখন রক্তপাত হয়ে যায়, তখনো উভয় পক্ষ চেঁচামেচি গালমন্দ না করে গায়ের ধুলো ঝেড়ে চলে যায়।’

শত বর্ষ আগের টোকিও

আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। সুশান নামক এক তরুণী গাইড করছেন। বাস ছাড়ার আগে তিনি প্রথমে নিশ্চিত হলেন যে, যাত্রীদের সবাই সিট বেল্ট লাগিয়েছে কিনা। এ রকম ৩০ সিটের বাসে চড়ার সময় আমরা কেউ সিটবেল্ট বাঁধি না। এটা শুধু বাংলাদেশেই না, ইউরোপ-আমেরিকার কোনো পাবলিক বাসে সিটবেল্ট বেঁধেছি বলে মনেও করতে পারি না, কিন্তু জাপানে নাকি সিটবেল্ট বাঁধা ফরজ। প্লেনের হোস্টেসের মতো একে একে সবার কোমরবন্ধনী পরীক্ষা করার পর তবেই গাড়ি ছাড়ার হুকুম পেল।

গাড়ি ছাড়তেই ক্রমাগত আমাদের সামনে দিয়ে, ডানে-বামে দিয়ে শহর পার হয়ে যায়। গাইড আমাদের শহরের ইতিহাস শোনায়, নিয়মের কথা বলে। জাপানের জনসংখ্যা নিয়ে বলতে গিয়ে গাইড শোনায় ভারি মন খারাপের কথা। এই শহরের মানুষের গড় আয়ু দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে, জন্মহার কমে যাচ্ছে। যেমন মানুষ মরছে তারচেয়ে কম মানুষের জন্ম হচ্ছে। ভাবখানা এমন যে, এই হারে মানুষ কমতে থাকলে একদিন জাপান জনশূন্য হয়ে যাবে, তাদের এই সম্পদ খাবে কে?

এটা তো আর বলার বাকি নাই যে, বর্তমানের জাপান পৃথিবীর একটা অন্যতম বড় শক্তি। সে ধারেও কাটছে, ভারেও কাটছে। এমন না যে সৌদীর মতো মাটির তলার খনি ভাঙ্গিয়ে বড় লোক হয়ে গেছে, নিজের কোনো মেধা তাদের যোগ করতে হয় নি। এই জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশ শুরু হয়েছিল এদো যুগে। এরপর ১৮৬৮ সাল থেকে মেইজি যুগে জাপানের অর্থনীতি প্রসার লাভ করে। এই সময় জাপান বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করেছিল। সেই সময় থেকেই জাপান এশিয়ার সর্বাধিক সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত জাপানের সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশ শুরু হয় জিডিপির হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর জাপানই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, ক্রয়ক্ষমতা সাম্যের হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের পর চতুর্থ বৃহত্তম জাতীয় অর্থনীতি।

২০১০ সালের হিসাব অনুসারে, জাপানে শ্রমিক সংখ্যা ৬৫.৯ মিলিয়ন। এ দেশে বেকার নাই বললেই চলে, মাত্র ৪ শতাংশ। মাথাপিছু আয় প্রায় ৪০ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশের চেয়ে ২০ গুন বেশি। তারপরও জাপানের তরুণ-তরুণীরা বিবাহে খুব আগ্রহী না, যে কারণে শিশু জন্মের হার অনেক কম। জাপানি কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি, যার ৪০ শতাংশ নারী। নারীদের এই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতাই কি তবে তাঁদের সংসারবিমুখ করে রেখেছে?

অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতাই হয়তো জাপানী তরুণীদের পুরুষবিমুখ করে রেখেছে

এ নিয়ে ইন্টারনেটে কিছু মজার তথ্য পেলাম। জাপানের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশনে পরিবারহীন নারীদের দায়ী করেছেন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী তারো আসো। জাপানের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। ১৯৭০ সাল থেকেই দেশটির জনসংখ্যা ক্রমাগত কমছে। ২০১৭ সালে দেশটিতে ৯ লাখ ৫০ হাজার কম শিশুর জন্ম হয়েছে। বিপরীতে মৃত্যু হয়েছে ১৩ লাখ মানুষের। এর কারণ হিসাবে জাপানের তরুণরা ক্রমেই প্রেম বা যৌনতার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে বলে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। সরাসরি শারীরিক সম্ভোগে না গিয়ে অবিকল নারী বা পুরুষের মডেল বানিয়ে এসব প্রাণহীন নারী-পুরুষের সঙ্গে যৌনাচার করার ‘লাভ হোটেল’ চালু হয়েছে জাপানে। এ রকম নারীহীন ব্রোথেল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হলেও, জাপানই এর উদ্ভাবক। বিবিসির এক জরিপে দেখা গেছে যে জাপানের ১৮ থেকে ৩৪ বছরের তরুণদের ৪৫ শতাংশ জানিয়েছে, তাদের কখনোই কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। ৬৪ শতাংশ বলছে, তারা কোনো প্রেম বা সম্পর্কে নেই।

৪৫ বছরের একজন মহিলা শিল্পী বলছেন, একটি সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়তো একটি ছেলের জন্য খুব সহজ ব্যাপার নয়। এজন্য তাকে প্রথমে একটি মেয়েকে ডেটিংয়ে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিতে হবে। এতোসব ব্যাপার হয়তো অনেক তরুণ করতে চায় না। বরং তারা ইন্টারনেটে পণ্য দেখে যৌন তৃপ্তি পায়। ৩৪ বছর বয়সি এক পুরুষ এক্সিকিউটিভ স্পষ্টই বলেছেন যে, আমার মতো অনেকেই নারীদের ব্যাপারে সংকোচ বোধ করেন, কারণ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার চেয়ে বরং অন্য কিছুতে মনোযোগ দেয়াই ভালো। এ রকম স্বাবলম্বি একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তোলার জন্য যে পরিমাণ অর্থযোগের দরকার, তা মিলাতে না পেরে তারা বিকল্প আয়োজনের দিকে যাচ্ছে। তাতে তার জৈবিক চাহিদাটুকু হয়তো মিটে যাচ্ছে, কিন্তু জাতি জনশূন্য হবার দিকে এগুচ্ছে। জাপানি তরুণরা না হয় ইন্টারনেট থেকে যৌন তৃপ্তি পেল, কিন্তু তরুণীরা?

হিসাব কর্মকর্তা ২৪ বছরের আনা একই সাক্ষাৎকারে বলছেন, যৌনতার চেয়েও তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভালো খাবার আর ঘুম। আনা বলছিলেন, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখনই আমি প্রথম আমার কঠোর বাবা-মায়ের শাসন থেকে বেরিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করলাম। আমি বন্ধুদের সঙ্গে রাত করে বাইরে থাকা বা পানীয় পান করার সুযোগ পেলাম। একজন প্রেমিক হয়তো আমার সেই স্বাধীনতা সীমিত করে ফেলবে, যা আমি চাই না। ইন্টারনেট যৌনতা বা নিজেকে লুকিয়ে রাখা, কারণ যাই হোক না কেন, গবেষণায় জানা যাচ্ছে, তরুণ জাপানিদের অর্ধেকই কোনো রকম প্রেম বা যৌন অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাদের ত্রিশ বছর বয়স পার করতে চলেছেন। সক্ষম হওয়ার চেয়ে নারীর সুন্দর হওয়াতেই পুরুষ বেশি জোর দেন- জাপানের নারীরা এ কারণেই পিছিয়ে রয়েছেন এমন কথা বলেছেন দেশটির ফার্স্টলেডি আকি আবে। তিনি বলেন, জাপানি পুরুষ সক্ষম ও পরিশ্রমী নারীর চেয়ে সুন্দর নারীকেই বেশি পছন্দ করেন। এমনকি ভীষণ মেধাবী নারীকেও তারা পাশ কাটিয়ে যান।

জাপানে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়েই আছে

জাপানে কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা পুরুষের প্রায় সমান হলেও কোম্পানিগুলোর বিভাগীয় প্রধান অথবা আরো উচ্চ পদে নারীর উপস্থিতি অনেক কম, মাত্র ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। আরেকটা জিনিস দেখলাম, আপাতভাবে এই শহরে মেয়েরা অনেক বেশি সক্রীয় কাজে এবং কর্মে। আমাদের ট্যুর গাইড তরুণী, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে যাদের নেয়া হয়েছে, প্রায় সবাই তরুণী। গাড়ি চালাচ্ছেন এক পুরুষ, কিন্তু তাকে সহায়তা করছেন এক নারী। আরেকটা জিনিস খেয়াল হলো, রাস্তায় চলাচলের সময় কোনো নারী কোনো পুরুষের গায়ে ধাক্কা খেল নাকি কে কাকে ছুঁয়ে দিলো, এই নিয়ে কোনো বিকার নাই, গায়ের সাথে গা লেগে বসে আছে, হেঁটে বেড়াচ্ছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে ঘুরছে, যে দুই দলের মানুষ তাদের মধ্যে যে লিঙ্গ ভেদ আছে, এটা এদের চালচলনের মধ্যে দেখা গেল না। এটা আমি যখন দেখছি তখন ২০১৮ সাল, অথচ এর একশো বছর আগে, ১৯১৬ সালেই দেখি রবীন্দ্রনাথও প্রায় একই কথা লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর লেখায় ছিল: ‘জাপানের শহরের রাস্তায় বেরুলেই প্রধানভাবে চোখে পড়ে জাপানের মেয়েরা। কারো কারো কাছে শুনতে পাই, জাপানের মেয়েরা এখানকার পুরুষের কাছ থেকে সম্মান পায় না। সে-কথা সত্য কি মিথ্যা জানি নে, কিন্তু একটা সম্মান আছে সেটা বাইরে থেকে দেওয়া নয়, সেটা নিজের ভিতরকার। এখানকার মেয়েরাই জাপানের বেশে জাপানের সম্মান রক্ষার ভার নিয়েছে। এখানে মেয়ে-পুরুষের সামীপ্যের মধ্যে কোনো গ্লানি দেখতে পাই নে; অন্যত্র মেয়ে-পুরুষের মাঝখানে যে একটা লজ্জা-সংকোচের আবিলতা আছে, এখানে তা নেই। মনে হয়, এদের মধ্যে মোহের একটা আবরণ যেন কম। তার প্রধান কারণ, জাপানে স্ত্রী-পুরুষেরা একত্রে বিবস্ত্র হয়ে স্নান করার প্রথা আছে। এই প্রথার মধ্যে যে লেশমাত্র কলুষ নেই তার প্রমাণ এই যে নিকটতম আত্মীয়েরাও এতে মনে কোনো বাধা অনুভব করে না। দেহ সম্বন্ধে উভয় পক্ষের মন খুব স্বাভাবিক। পৃথিবীতে যত সভ্য দেশ আছে তার মধ্যে কেবল জাপান মানুষের দেহ সম্বন্ধে যে মোহমুক্ত, এটা আমার কাছে খুব একটা বড়ো জিনিস বলে মনে হয়। অথচ আশ্চর্য এই যে, জাপানের ছবিতে উলঙ্গ স্ত্রী মূর্তি কোথাও দেখা যায় না। উলঙ্গতার গোপনীয়তা ওদের মনে রহস্যজাল বিস্তার করে নি বলেই এটা সম্ভবপর হয়েছে। এখানে মেয়েদের কাপড়ের মধ্যে নিজেকে স্ত্রীলোক বলে বিজ্ঞাপন দেবার কিছুমাত্র চেষ্টা নেই। এখানকার মেয়েদের কাপড় সুন্দর, কিন্তু সে কাপড়ে দেহের পরিচয়কে ইঙ্গিতের দ্বারা দেখাবার কোনো চেষ্টা নেই। জাপানিদের মধ্যে চরিত্র দৌর্বল্য যে কোথাও নেই তা আমি বলছি নে, কিন্তু স্ত্রী পুরুষের সম্বন্ধকে ঘিরে তুলে প্রায় সকল সভ্যদেশেই মানুষ যে একটা কৃত্রিম মোহপরিবেষ্টন রচনা করেছে জাপানির মধ্যে অন্তত তার একটা আয়োজন কম বলে মনে হল এবং অন্তত সেই পরিমাণে এখানে স্ত্রী পুরুষের সম্বন্ধ স্বাভাবিক এবং মোহমুক্ত।’ (চলবে)

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়