ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

হনুমান ধোকায় একদিন

গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৭, ১০ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হনুমান ধোকায় একদিন

কাঠ ও লোহার পাইপ দিয়ে ঠেক দেয়া হয়েছে, যাতে ভেঙ্গে না পড়ে

গাজী মুনছুর আজিজ: দরবারে প্রবেশ পথের এক প্রান্তে বেশ বড় আকৃতির হনুমান। পাঠক, চমকে ওঠার কারণ নেই। ওটা আসলে হনুমানের মূর্তি। এই মূর্তির জন্যই দরবারটির পোশাকি নাম ‘হনুমান ধোকা’ দরবার। নেপালের কাঠমান্ডুতেই এর অবস্থান। এটি ‘কাঠমান্ডু দরবার’ নামেও পরিচিত। ১৫০ রুপির টিকিট কেটে কাঠমান্ডুর প্রাচীন এই রাজপ্রাসাদে যখন প্রবেশ করি তখন সূর্য মাথা বরাবর। অবশ্য বরফের দেশ বলে সূর্যের তেজ খুব একটা গায়ে লাগছে না। তবে দরবারে প্রবেশ করে মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ, দরবারের অনেক স্থাপনা ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে ভেঙ্গে গেছে। ভূমিকম্পের প্রায় বছর দুই পর প্রথমবার এসেছিলাম এই দরবারে। এক বছরের মাথায় আবারও এলাম। এবারের ভ্রমণসঙ্গী সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদ।

দরবারের অন্যতম আকর্ষণ বসন্তপুর টাওয়ার। ভূমিকম্পের আঘাতে টাওয়ারও ভেঙ্গে গেছে। টাওয়ারসহ পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়া দরবারের স্থাপনাগুলো নতুন করে সংস্কার করা হচ্ছে। এছাড়া যেসব স্থাপনা বেশি বা অল্প ক্ষতি হয়েছে, সেগুলোরও সংস্কার চলছে আগের আদলে। কিছু কিছু স্থাপনার দেয়াল কাঠ ও লোহার পাইপ দিয়ে ঠেক দেয়া হয়েছে, যাতে ভেঙ্গে না পড়ে। দরবারের খোলা চত্বরে অস্থায়ী অনেক দোকানে নানা পণ্য সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। আমরা ঘুরে ঘুরে দোকানের পণ্য দেখি। এসব পণ্যের মধ্যে আছে কাসা-পিতলের বৌদ্ধমূর্তিসহ বিভিন্ন দেব-দেবির মূর্তি, নেপালের ঐতিহ্যবাহী খুরকি বা নকশা করা খাপঅলা ছুরি, কাসা-পিতলের বিভিন্ন পাত্র, উজ্জ্বল রঙের পাথর, পুতি বা কাঠের মালা, চুড়ি, নানান গহনাসহ বিভিন্ন পর্যটন-স্মারক। কিছুক্ষণ এসব পণ্য দেখি।

দরবারের মূল ভবন

দরবারের ইতিহাস ঘেঁটে জানি, ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন কাঠমান্ডুর প্রথম রাজা ছিলেন রত্ন মল্লা। মূলত তার নির্দেশেই দরবারের নির্মাণ কাজ শুরু। ১৬ শতকেও কিছু নির্মাণ হয়েছে। ১৬৭২ সালে দরবারের প্রধান গেটের সামনে হনুমানের মূর্তি স্থাপন করা হয়। তবে ১৭ শতকে রাজা প্রতাপ মল্লার দ্বারা দরবারের অধিকাংশ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। মূলত ১৫ থেকে ২০ শতকের মধ্যে নির্মিত হয় রাজকীয় এ প্রাসাদ। রত্ন মল্লা থেকে বীর বিক্রম শাহ পর্যন্ত প্রত্যেক রাজাই প্রাসাদে কিছু না কিছু নির্মাণ বা সংস্কার করেন। এ দরবার ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত নেপালের রাজকীয় প্রাসাদ ছিল। ১৯৭৯ সালে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব সংস্কৃতির ঐহিত্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।

দরবারের খোলা চত্বরে অস্থায়ী দোকান

দরবারে একাধিক চৌক বা আঙ্গিনা আছে। প্রতিটি চৌকের আলাদা আলাদা নাম। এসব চৌক বা আঙ্গিনায় যেসব ভবন বা মন্দির আছে, তার নামও আলাদা। একেকটি ভবন একেক রকমের। কোনোটি দুইতলা, কোনোটি তিনতলা, আবার কোনোটি চারতলা বা তারও বেশি তলা বিশিষ্ট। তবে সব ভবনই নান্দনিক কারুকাজে নির্মিত এবং প্রায় একই ধাঁচের। ঘুরে ঘুরে একে একে দেখে আসি দরবারের দখ চৌক, সুন্দরী চৌক, মহাখালী চৌক, মাসান চৌক, মহা বিষ্ণু মূর্তি, নরসিংহের মূর্তিসহ বিভিন্ন চৌক। সব চৌক বা আঙ্গিনার ভবন অনেকটা একই নকশায় নির্মিত। এছাড়া অধিকাংশ ভবনের উপরের অংশ চৌচালা আকৃতির। কিছু আছে গোলাকার। তবে সব উপরের অংশই পর্যায়ক্রমে নিচেরটার চেয়ে উপরেরটা ছোট হয়ে উঠে গেছে। অনেকটা পিরামিডের মতো। অবশ্য প্রত্যেক ভবনেরই দরজা ও জানালা কাঠের। শুধু কাঠের নয়, এসব দরজা ও জানালায় নিখুঁতভাবে খোদাই করে নকশা করা ফুল, পাখিসহ বিভিন্ন দেব-দেবির মূর্তি রয়েছে। কাঠের এসব কারুকাজ সত্যিই বিস্ময়কর! শত শত বছর আগে যেসব কারিগর বা শিল্পীরা কাঠের এই কারুকাজ করেছেন, তারা অনেক মেধাবী ও সৃজনশীল ছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। কাঠের কারুকাজ ছাড়াও দরবারের বিভিন্ন আঙ্গিনা ব ভবনের দরজার দুই পাশে আছে বড় আকৃতির সিংহসহ বিভিন্ন মূর্তি।

দরবারের আঙ্গিনায়  নির্ভয়ে কবুতরের ওড়াউড়ি

দরবারের একটি আঙ্গিনায় দেখি অনেক কবুতর। দরবারে আসা দর্শনার্থীরা কবুতরকে খাবার ছিটিয়ে খেতে দেন। ভ্রমণসঙ্গী আসাদও কিছু খাবার ছিটিয়েছেন। কবুতরগুলো খাচ্ছে। আমরা দাঁড়িয়ে দেখছি। দরবারের খোলা চত্বরের অস্থায়ী দোকানের পাশাপাশি বিভিন্ন ভবনের নিচে ছোট ছোট দোকান আছে। শুনেছি সেসব দোকানে আছে বিভিন্ন গরম কাপড়, চিত্রকর্মসহ নানা ধরনের পণ্য ও পর্যটন স্মারক। সুতরাং আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওদিকে হাঁটতে শুরু করলাম।

দরবারের জাদুঘরে রাজ পরিবারের বংশানুক্রমিক ছবি 

বিভিন্ন আঙ্গিনা ঘুরে প্রবেশ করলাম দরবারের জাদুঘরে। মূলত এটিও একটি আঙ্গিনা বা ভবন। এ আঙ্গিনায় এক সময় নেপালের রাজ পরিবারের বসবাস ছিল। আঙ্গিনার বারান্দার দেয়ালজুড়ে সাজানো রাজ পরিবারের ছবি। এছাড়া এ জাদুঘরে আছে শাহ সিংহাসন। শাহ রাজারা এ সিংহাসন ব্যবহার করতেন। আরও আছে রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের বহন করার জন্য পালকি। পিতলসহ নানা ধাতুর মাধ্যমে কারুকাজ করা এ পালকি রাজ পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানেও ব্যবহার হতো। পালকির পাশাপাশি রাজ পরিবারের সদস্যদের লাশ বহন করার জন্য ব্যবহৃত স্ট্রেচারও আছে। এছাড়া জাদুঘরের আরেক আকর্ষণ মল্লা সিংহাসন। কাঠের নির্মিত এ সিংহাসন নান্দনিক কারুকাজে বেশ দৃষ্টিনন্দন। কাঠমান্ডুর এ দরবার ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। সে গল্প আরেক দিন বলব।

ছবি : লেখক


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়