ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

খৈয়াছড়া ঝরনার দুঃখ

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১০, ১৫ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খৈয়াছড়া ঝরনার দুঃখ

খৈয়াছড়া ঝরনা

ইকরামুল হাসান শাকিল: ‘ঝরো-ঝরো ঝরো-ঝরো ঝরে রঙের ঝরনা/ আয় আয় আয় আয় সে রসের সুধায় হৃদয় ভরে না/ সেই মুক্ত বন্যা ধারায় ধারায় চিত্ত মৃত্যু-আবেশ হারায়।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমার সব সময় হিংসে হয়। তিনি এমন কোনো আবেগ বাদ রাখেননি যা আমাদের মনের বাইরে। তিনি ঠিকই সেগুলোর সন্ধান পেয়েছেন, বের করে এনেছেন। তেমনি ঝরনার রূপও তাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। সত্যিই তো- যতই দেখি না কেন, ঝরনা দেখে মন কখনও ভরে না। তাই ঝরনার সামনে বসে কবি শামসুর রাহমানের মতো বলতে ইচ্ছে হয়- ‘আমার কোন তাড়া নেই।’ 

বর্ষা এলেই মন ছটফট করে- কখন যাবো ঝরনার কাছে। তাই সুযোগ খুঁজছিলাম ঝরনা দেখতে যাওয়ার। হঠাৎ একদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোট বোন জানালো তারা কয়েকজন ঝরনা দেখতে যেতে চায়। এর আগে তারা কখনো পাহাড় কিংবা ঝরনায় যায়নি। তাই তাদের সাথে আমাকে যেতেই হবে। আমারো মন টানছিলো ঝরনা দেখতে। তাই আর না করতে পারিনি। ঠিক হলো ৫ জুলাই শুক্রবার ভোরে ঢাকা থেকে আমরা রওনা হবো। সারাদিন ঝরনা দেখে সন্ধ্যায় ফিরে আসবো। ভ্রমণসঙ্গী আমাকেসহ ৬ জন। তাই একটা নোয়াহ্ গাড়ি ঠিক করে ফেললাম।

পাখির চোখে পাহাড়ের উপর থেকে খৈয়াছড়া ঝরনা 

সকাল ৬টায় চালক শ্যামলী থেকে সানজানা দিঠিকে গাড়িতে তুলে চলে এলো মিরপুর ডিওএইচএস। এখান থেকে আতিয়া হোসেন অনন্যা, সাকিবা শফিক, তাসমিম মিহা ও আরিফুল ইসলামকে গাড়িতে তুলে গাড়ি চলল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। এখান থেকেই আমি তাদের সঙ্গে যুক্ত হই। ঠিক পৌনে সাতটার দিকে আমরা পূর্বাচলের তিনশ’ ফিট রাস্তা ধরে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। এদের মধ্যে শুধুমাত্র আতিয়া আমার পূর্ব পরিচিত। বাকিরা তার বন্ধু। তাই সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিলাম।

আসুন এখন আমাদের গন্তব্যস্থানের কথা বলি। আমাদের উদ্দেশ্য চট্টগ্রামের মিরসরাই। এই মিরসরাইয়ের পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন ঝিরি, ছড়া ও ঝরনা। যা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। বাংলাদেশের এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বহু ধাপবিশিষ্ট খৈয়াছড়া ঝরনা এই এলাকাতেই। ঝরনাটিই এলাকার মূল আকর্ষণ। বর্ষা এলেই এই এলাকা হয়ে ওঠে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে পর্যটনকেন্দ্র। এ সময় প্রকৃতি তার পূর্ণরূপ যেন ঢেলে দেয়। আর আমরাও সেই রূপে কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যেতে সেখানে ছুটে যাই। 

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা

যাত্রাপথে আমরা সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। গান শুনে আর গল্প করে আমাদের যাত্রাপথ শেষ করে সাড়ে এগারোটা নাগাদ খৈয়াছড়া চলে এলাম। গাড়ি রেখে পোশাক পরিবর্তন করে আমরা ঝরনার উদ্দেশ্যে ট্রেকিং শুরু করলাম। যেহেতু তারা সবাই নতুন, তাই সাধারণ কিছু নিয়ম বলে দিলাম। যেন অতি উৎসাহী না হয়। ঝরনায় গিয়ে অনেকে আনন্দে আত্মহারা হন। ফলে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। তাই ঝরনায় নেমে সতর্ক থাকা উচিত। ঝরনার একদম পাড়ে দাঁড়াতে হয় না। কারণ ঝরনা অনেকটা পিচ্ছিল হয়। ঝিরিপথে হাঁটার সময় সতর্কতার সঙ্গে হাঁটতে হয়। ট্রেইলে কীভাবে হাঁটবে, ঝুঁকিপূর্ণ পথে কী করতে হবে, প্রকৃতির ক্ষতি হয় যেমন প্লাস্টিক বোতল, চকলেটের খোসা যেখানে সেখানে যেন না ফেলে ইত্যাদি বলে দিলাম। কারণ প্রকৃতির প্রতি যার সচেতনতার অভাব আছে, তার প্রকৃতির কাছে না যাওয়াটাই উত্তম। কারণ তিনি গেলে সুন্দর প্রকৃতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এখন এক শ্রেণির ট্রেকার তৈরি হয়েছে, যারা শুধু ট্রেকিংই করে। তাদের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই। যে যেভাবে পারছে পাহাড় ও ঝরনা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রতিবারের মতো এবারও ট্রেকিং করতে গিয়ে আমি খুবই অবাক হয়েছি। ঝরনার পানিতে বা ঝিরিতে পানির বোতল, পলিপ্যাক, চিপস, চকলেট- এমনকি খাবারের প্যাকেট ফেলতে দেখে। ফলে ঝরনার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে এবং প্রকৃতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যাদের মধ্যে এই বোধটুকু নেই; তাদের পাহাড় বা ঝরনায় না যাওয়াই শ্রেয়। তারা ঝরনার দুঃখ শুনতে পায় না।

পায়ে হাঁটা পথ। আমার ধীরে ধীরে ঝরনার দিকে এগিয়ে চললাম। পথে দেখা হচ্ছে অনেক ট্রেকারের সঙ্গে। কেউ উপরে উঠছে আবার কেউ নেমে আসছে। রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক পিচ্ছিল আর কাদা। এর মধ্যেই কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চলছি। আমরা সবাই যেহেতু তরুণ, তাই খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। কাদাপথ, ঝিরিপথ হেঁটে আমরা এসে পৌঁছলাম খৈয়াছড়ার পায়ের কাছে। এখানে এসে ঝরনার শীতলতা ও পানির শব্দ আমাদের মন ভরিয়ে দিল। আমাদের দলের সবারই পাহাড়ে এবারই প্রথম, তাই তারা কিছুটা ক্লান্তও হয়ে গেছে। তাদের চোখে-মুখে ক্লান্তির রেখা সবুজের ছায়া আর ঝরনার রূপ আড়াল করে দিয়েছে। তাদের উপরের ধাপগুলো দেখাতে উঠে গেলাম। ঝরনার শীতল জলে গা ভিজিয়ে নিলাম। আমরা বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত খৈয়াছড়া ঝরনার রূপে ডুবে ছিলাম। কঠিন কঠিন চড়াই উঠে এসে যখন দেখি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য তখন পেছনে ফেলে আসা সকল পরিশ্রম মুহূর্তেই ভুলে যাই।

দলবেঁধে আমরা গিয়েছিলাম ঝরনা দেখতে

ঝরনা থেকে নেমে এসে ভেজা পোশাক পরিবর্তন করে দুপুরের খাবার খেতে বসে গেলাম। খৈয়াছড়ার পথে এখন বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল হয়েছে। এর মধ্যে পুরনো হলো ঝরনা হোটেল। আগে এখানেই খেয়েছি। এবারো এখানেই খেতে বসেছি। হোটেলটি আগের চেয়ে অনেক পরিপাটি হয়েছে। এখানেই দুপুরের খাবার খেতে খেতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। খাবার শেষ করে গাড়িতে উঠে বসলাম। প্রকৃতির কখনো খালি হাতে ফেরায় না। অনেক কিছু উজাড় করে দেয়। আমরা প্রকৃতির দেয়া উপহার নিয়েই বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম। 

যেভাবে যাবেন: আমরা যেহেতেু রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে গিয়েছি তাই ভোরে রওনা হয়েছি। আর যারা ঢাকা থেকে বাসে আসবেন, তারা পথিমধ্যে মিরসরাই নেমে গেলে ভালো। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যেসব বাস ছাড়ে সেই বাসেই আসা যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৪৮০ টাকা (নন এসি)। মিরসরাই নেমে সকালের নাস্তা করে সিএনজি নিয়ে ঝরনার কাছে চলে যাবেন। ভ্রমণের সুবিধার জন্য সঙ্গে গাইড নেয়া ভালো। গাইডের জন্য মৌসুমভেদে ৩০০-৫০০ টাকা লাগতে পারে।

পর্যটকদের অসচেতনতায় বিপর্যস্ত পরিবেশ

সঙ্গে যা নেবেন: যেহেতু পাহাড়ি রাস্তা, সেহেতু ভালো গ্রিপওয়ালা বেল্টের স্যান্ডেল উত্তম। কারণ ঝিরিপথে হাঁটবেন তাই কাদা, পানি দিয়ে হাঁটতে হবে। কাঁটাছেড়া হতে পারে, তাই কিছু ব্যান্ডেজ আর এন্টিসেপটিক নিতে পারেন। যেহেতু ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা, তাই যাওয়ার আগে স্থানীয় চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা উচিত। আর সঙ্গে কিছু হালকা শুকনো নাস্তা আর খাবার পানি এবং শুকনো কাপড় নিতে হবে। বর্ষাকালে বৃষ্টি হতে পারে কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই। তাই ছাতা অথবা রেইন কোট নিতে ভুলবেন না।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়