ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ষষ্ঠ পর্ব || বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যা

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৮, ১৮ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ষষ্ঠ পর্ব || বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যা

আকিহারাবায় হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত। রাতের খাওয়া হয়ে গেছে সাড়ে নটার মধ্যে। এবার  হোটেলে ফেরার পালা। আমি লাভলু ভাইকে বলি, ট্যাক্সি নেন, হোটেল যাবো। আর পারি না। কিন্তু শপিং মল থেকে বেরুতেই দেখি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি।

আমাদের দু’জনের হাতে দুটি ছাতা। কিছুক্ষণ আগে আমরা ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় এমন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পেয়েছিলাম। তখন ১৪০০ইয়েন (বাংলাদেশি টাকায় ১০৫০ টাকা) দিয়ে দুটো ছাতা কিনে নিয়েছিলাম। সেই ছাতা মাথায় দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি।

লাভলু ভাই তাঁর চোখের সামনে থেকে ফোন সরাতে সরাতে বলেন, এখান থেকে আমাদের হোটেল ম্যালা দূর- প্রায় ৬ কিলোমিটার! ট্যাক্সিতে যেতে সময় লাগবে ১৯ মিনিট, কিন্তু ভাড়া ৫৫০০ ইয়েন। আর মেট্রোতে গেলে ৩০ মিনিট। ৯মিনিট হাঁটার পর ট্রেন পাবি। ১১ মিনিটে তোকে পৌঁছাবে ইয়তসুয়া স্টেশনে, সেখান থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা পথে আমাদের হোটেল। ভাড়া দুইজনের ২৮০ ইয়েন। কী করবি ?

আমি বলি, হোটেলে ফেরার তো তাড়া নাই আমার। এটা তো ঢাকা না যে রাত দশটা হলে বাসা থেকে ফোন আসবে, খাওয়ার জন্য বসে আছে সবাই, খেতে বসতে হবে। এখন আমাদের পুরো সময়টা হচ্ছে টোকিও এক্সপ্লোর করার। ১০ দিনের এই সফরে আজ আমরা প্রথম বেরিয়েছি টোকিও দেখতে। এই শহরের ট্রেনও একটা দেখার জিনিস। আমাদের ইয়েন বাঁচবে ৫ হাজার আর মাগনা চড়া হয়ে যাবে টোকিওর ট্রেনে। লাভলু ভাই মেশিনে টেপাটেপি করে দুটি কাগজ বের করে আনেন। এক টুকরা আমার হাতে দিয়ে বলেন, এই নে টিকেট, ঢুকে পড়।

স্টেশনে ঢোকার আগে প্রথম মনে হলো, এই স্টেশনটি খুব ছাতা বান্ধব। যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে এবং সবাইকেই কিছু না কিছু পথ পায়ে হেঁটে আসতেই হয়েছে, সুতরাং ছাতা আছে সবার সাথে। স্টেশনের যে ব্যারিকেড পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে হবে সেখানেই দেখি অনেকগুলো লম্বাটে প্রকোষ্ঠ। এর  দৈর্ঘ্য এক ছাতার সমান। লোকজন এই প্রকোষ্ঠে তাদের ভেঁজা ছাতা ঢুকিয়ে কেমন করে একটা মোচড় দিয়ে আবার বের করে আনছে। বের করে আনা ছাতাটি দেখি একটা স্বচ্ছ পলিথিনে মুড়িয়ে দেয়া। এবার এই ছাতা থেকে চুইয়ে পড়া পানি স্টেশনের কোন ফ্লোর আর ভেজানোর সুযোগ পাবে না।

আমরা এসে দাঁড়াই ৫নং প্ল্যাটফর্মে। এর নাম Chuoo-subo line. সিনজুকুগামী এই ট্রেনটি চারবার নানা স্টেশনে থামবে, পঞ্চম স্টেশনটি আমাদের।

চিন্তা নাই। প্রতি ৩মিনিট পরপর একটা করে ট্রেন আসে এই লাইনে। প্ল্যাটফর্মে গিয়েই দেখি একটা ট্রেন দাঁড়ানো এবং লাইন ধরে যাত্রীরা উঠছে। খানিক পর ট্রেনটা চলে গেলে খালি প্ল্যাটফর্মে দেখি নানান সারিতে কিছু লোক এসে দাঁড়াচ্ছে একটা হলুদ দাগের ওপর। যিনি সামনে দাঁড়ালেন তাঁর পেছনে দাঁড়াচ্ছেন আরেকজন। প্ল্যাটফর্মজুড়ে এরকম কতোগুলো দাগ দেয়া আছে, সেই সব দাগ মেপে দাঁড়িয়ে থাকে লোকজন। পাশে পুলিশ আছে একজন। লাভলু ভাই বলেন, এসব পুলিশের কাজ হচ্ছে, মানুষজন ধরে ধরে ট্রেনের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া। রাশ আওয়ারে এরা বেশি সক্রিয় থাকে। তখন শুঁটকিগাজার মতো একেকটাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকায়। এরা পুলিশ না। পুলার। হিউম্যান পুলার।

আমাদের জন্য হিউম্যান পুলার লাগেনি। ভেতরে সীটও পেয়ে যাই আরামে। এবং টের পাই, এই শহরের বেশীরভাগ মানুষই মাটির তলায় বেশি চলাচল করে।

৪টা স্টপেজ শেষে আমরা নেমে যাই ইয়তসুয়া স্টেশনে। সেই কাগজ টুকরাটা আবার দরকার হয়। আরেকবার মেশিনে ঢুকিয়ে দিলে সে আমার জন্য রাস্তা খুলে দেয়। আমরা বেরিয়ে পড়ি স্টেশন থেকে।

বাইরে বৃষ্টি। লাভলু ভাইকে বলি, ট্যাক্সি ডাকেন। আমি আর হাঁটতে পারবো না। রেল থেকে নামার পর অনেক ওঠানামা করতে করতে আমি ক্লান্ত।

টোকিওর বৃষ্টিস্নাত গলি

লাভলু ভাই ট্যাক্সি লেখা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন। টোকিওতে ট্যাক্সিওয়ালাদের 'না' বলে কোনো শব্দ নাই। সবুজ বাতি জ্বলা ট্যাক্সি হাত বাড়ালেই থেমে যাবে এবং অটোমেটিক্যালি বামপাশের দরোজা খুলে যাবে। আমাদের হোটেলে ট্যাক্সিতে যেতে লাগবে ৩ মিনিট, পায়ে হেঁটে যেতে ১০ মিনিট, দূরত্ব ৭০০ মিটার। আমি ছাতাটা বের করে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে থাকি। আমার হাঁটাহাঁটি দেখে লাভলু ভাই ট্যাক্সি লেখা জায়গাটা থেকে সরে এসে আমার কাছে আসেন। প্রথমে মনে হয়েছিল তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে যেতে এসেছেন। কিন্তু আমার কাছাকাছি আসতেই মনে হলো- না, তিনি আমার সঙ্গেই হাঁটতে এসেছেন।

আমি বলি, চলেন, সামনে একটা সেভেন-ইলেভেন আছে। সেখান থেকে কিছু পানি নিয়ে যাই রুমের জন্য। ৫০০ ইয়েন দামের ৪০০ মিলি পানি খেতে কষ্ট হয়।

আমরা ছাতা মাথায় রাস্তা পার হয়ে সেভেন ইলেভেনে যাই। দুই বোতল দুই লিটার পানি কিনি ১২০ ইয়েনে। বোতল হাতে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেই, এটা ফেরত দিব। এতো ভারি পানির বোতল নিয়ে ৬০০ মিটার হাঁটা যাবে না।

ফেরত দিলাম পানির বোতল। এবার খালি হাতেই হোটেলে ফেরার পালা। আমি ছাতা নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার খুব নিকোটিনের চাপ অনুভূত হয়। আমি এই সেভেন ইলেভেনে একটা  মোবাইল ছাইদানী কিনতে গিয়ে খবর পেলাম, এই দোকানে সিগারেট বিক্রি হয় এবং দোকানের সাথে লাগানো একটা ছোট্ট কিয়স্ক আছে, সেখানে ছাইদানীও রাখা আছে। কেবল সেখানে দাঁড়িয়েই সিগারেট খাওয়া যাবে।

আমি ছাতা মাথায় দিয়ে মহানন্দে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করি। আমার গাইড গুগল ম্যাপ। এই গুগল মামার উপর আমাদের অনেক আস্থা। কিন্তু খানিক পর এক গলির মুখে আসতেই দেখি, গুগলমামা আমাকে খালি উল্টা পথে যেতে বলে! অথচ আমাদের ৫৬ তলা উঁচু হোটেলটি সামনেই দেখা যাচ্ছে। মামা আমারে উল্টা যেতে কয় ক্যান? যে গলিটার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি, সে পথ দিয়ে কিছু মানুষের চলাচল আছে। সবার মাথায় ছাতা। আমাদের মাথায়ও ছাতা। কিছু মানুষের হাতে ট্রান্সপারেন্ট ছাতা। এই ছাতায় রোদ ঠেকায় না, বৃষ্টি ঠেকায়, কিন্তু আলোটা আটকায় না।

আমার এক হাত সিগারেটের জন্য ব্যস্ত। আমি লাভলু ভাইকে বলি, আপনি এই গলিপথের একটা ছবি তুলেন। সামনে যে কাপলটা আসছে, তাদের ছবি।

লাভলু ভাই গভীর মনোযোগের সাথে ছবি তুলতে থাকেন। আমার ইচ্ছা হলো এদের সঙ্গে একটু কথা বলতে। অপরিচিত জায়গায় কারো সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে হলে কোন একটা জায়গার ঠিকানা তাঁকে জিজ্ঞাস করাই যায়। এমন কিছু ইউরোপ-আমেরিকায় করেছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারো সময় হয় না, আজনবির সাথে কথা বলতে। তাদের ফ্রেইজে আছে –Never believe a stranger. কিন্তু জাপানিরা কেমন ?

আমি দেখি লাভলু ভাই তাদের সাথে কথা বলছেন। নিউ ওটানি হোটেলটা কোনদিকে জানার চেষ্টা করছেন। খানিক পরে আমার কাছে এসে বলেন, চল, এরা দেখিয়ে দেবে।

আমরা অপর একটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে আরেকটা রাস্তা পাড়ি দেই। আমি জানি, আমার গুগল মামাও আমাকে এই পথের কথা বলে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় লাইটপোস্টের পর ডান দিকে চলে গেলেই হোটেল।

সেই যুগল তাদের চলার পথ ফেলে রেখে আমাদের জন্য দ্বিতীয় লাইটপোস্ট পর্যন্ত এসে দাঁড়ায়।

স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষমান যাত্রী

বৃষ্টি পড়ে টোকিও আকাশ ফুঁড়ে। টিপটিপ বৃষ্টি, মাঝেমাঝে জোরে বাতাস বইছে। আমাদের মাথার উপর ছাতা। এই ছাতার উপর ভটভট শব্দ করে বৃষ্টির বড়বড় ফোটা পড়ে। কিছু সরাসরি আকাশ থেকে, আর কিছু এই সরু পাহাড়ি পথের দু’পাশে থাকা বড় বড় গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়া জল।

যে পথ দিয়ে আমরা হেঁটে যাই, তা খানিকটা উঁচু পথ। দুই পাশে টিলা। এই টিলাময় পথ পেরুলে হাতের বাঁয়ে বাঁক নিলে আমাদের হোটেলের গেট। মাঝপথ পর্যন্ত এসে একবার পেছনে তাকাই। দেখি স্বচ্ছ ছাতার নিচে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন জাপানি যুগল। আমরা হাত নাড়ি, বুঝাই, হোটেল পেয়ে গেছি, তোমরা চলে যাও।

হাঁটতে হাঁটতে যেখানে বাঁক নিয়ে হোটেলের গলিতে ঢুকবো, সেখান থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, যেই যুগল আমাদের দিকে তাকিয়ে তখনো দাঁড়িয়ে। (চলবে)


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়