ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ম্যাটারহর্ন গ্লোসিয়ার প্যারাডাইস

ফারজানা ব্রাউনিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৯, ১০ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ম্যাটারহর্ন গ্লোসিয়ার প্যারাডাইস

যতদূর চোখ যায়, চোখের আয়নায় ভেসে ওঠে ধবধবে কলঙ্কহীন সাদা আর সাদা। এরই মাঝে সূর্যের তীব্র আলো চোখে মুখে লুটোপুটি খাচ্ছে। কিন্তু দিনমণির প্রবাহে কোনো উত্তাপ নেই। বরং, উল্টো ঠান্ডা লাগছে। প্রচন্ড ঠান্ডা! ঠান্ডা মাপার যন্ত্রে মাইনাস সাত ডিগ্রী সেলসিয়াস দেখাচ্ছে।

পায়ে বরফের মধ্য দিয়ে চলার উপযোগী জুতো, তার সঙ্গে জুড়ে আছে বরফ কেটে এগুনোর ব্লেড। হাতে বরফের মধ্য দিয়ে এগুনোর জন্য সহায়ক দুটো সরু লাঠি নিয়ে তৈরী আমি। জীবনে প্রথমবারের মতো আইস-স্কী করতে যাচ্ছি। কী রোমাঞ্চকর অনুভূতি! ওপর থেকে নিচে যতদূর চোখ যায় তাতে দেখা যায় শুধুই সাদা বরফাবৃত পর্বত চূড়া। না, আমি কোনো স্বপ্নের কথা বলছি না। আমি বলছি পৃথিবীর উত্তরগোলার্ধের অন্যতম নান্দনিক স্থান, সুইজারল্যান্ডের আল্পস্ পর্বতমালার খ্যাতনামা পর্বতশৃঙ্গ ম্যাটারহর্ন’ (Matterhorn)-এর কথা।

সকালে জারম্যাট গ্রাম থেকে রওনা দেয়ার আগে আমি কল্পনাও করতে পারিনি, আজ আমি এমন সুন্দর, শুভ্র এক বিস্ময়কর দৃশ্যের মুখোমুখি হবো। স্বর্ণ কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে কিশোরী পুষ্টি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতেই বাংলাদেশ থেকে আমাদের মোট আটজনের একটি দল সুইজারল্যান্ড এসেছি। এ নিয়ে চার চারবার সুইজারল্যান্ড আসা হলেও কখনও পর্বত চূড়ায় আরোহণের পরিকল্পনা করা হয়নি আমার। কিন্তু এবার করলাম। কাজের পরে আমার থাকার সময়টা একটু বাড়িয়ে নিলাম। মনে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে পরিকল্পনা করলাম, আল্পস্-এর বহুল আলোচিত নান্দনিক পর্বতশৃঙ্গ ম্যাটারহর্ন-এ আরোহণ করে তবেই বাড়ি ফিরব।

এবার আমার সফরসঙ্গী, না, বরং এভাবে বলা ভালো- আমার পর্বত বিজয়ের সফরসঙ্গী হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডক্টর চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী, বীর বীক্রম। একজন পাহাড়জয়ী যোদ্ধাকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডের ট্রেন স্টেশনে এসে চড়ে বসলাম জারম্যাটগামী ছিমছাম ট্রেনটিতে। পরিকল্পনার সময় জেনেছিলাম, সুইজারল্যান্ড থেকে জারম্যাট, ট্রেনে সময় লাগে ৩ ঘণ্টার কিছুটা বেশি সময়।

ঠিক কাটায় কাটায় ৩ ঘণ্টা ১৪ মিনিট-এর এক অসাধারণ পাহাড়ি-সৌন্দর্য্য ভ্রমণের পর এসে পৌঁছুলাম কাঙ্ক্ষিত জারম্যাট-এ। স্টেশনে পৌঁছুতেই মনে হলো টাইম-মেশিনে পৃথিবীর অন্য কোন এক সময়ে আমরা পৌঁছে গেছি। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখলাম ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়ানো। সেই সঙ্গে দাঁড়ানো চারকোণ আকৃতির কিছু অদ্ভুত রং-বেরঙের ট্যাক্সি। হঠাৎ করেই লম্বা ঐতিহ্যবাহী পোষাকে পায়ের জুতোয় আওয়াজ তুলে নাচতে নাচতে ফ্রেমে প্রবেশ করল কিছু মেয়ে। পাশ্চাত্যের ঐতিহ্যবাহী ট্যাপ-ডান্সিং-এর সঙ্গে কঠিন ও কোমল পানীয় দিয়ে স্বাগত জানাল তারা আগত অতিথিদেরক। তৈরী হলো এক মোহময় পরিবেশ। কিছুক্ষণ আগেই হওয়া তিন ঘণ্টার বিস্ময়কর ট্রেন ভ্রমণের সৌন্দর্যমণ্ডিত অভিজ্ঞতা তাদের এই মোহময় স্বাগত-অভিবাদনে নিমেষেই ফিকে হয়ে গেল যেনো। মনে হলো, এই মানুষগুলো আমাদের বহুদিনের পরিচিত, চিরচেনা খুব নিকটজন। ঘোড়ার চিঁহিহি ডাকে মনে হলো আমরা আছি সেই নারনিয়ার কল্পরাজ্যে।

আমাদের গন্তব্য হোটেল দানিয়েলা। টগবগ টগবগ করে পাহাড়ের উপরে সৃষ্ট এক অপরূপ মানব বসতির রাস্তা দিয়ে চলছি আমরা। কী এক অদ্ভুত ভালোলাগা মেখে আছে পুরো রাস্তায়। ভীষণ যৌবনবতী এক পাহাড়ি ঝরনা দ্রুত ঝমঝম করে বয়ে চলেছে পাহাড় কেটে। খুব অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম আমরা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

হোটেলগুলোকে বাইরের দিক থেকে দেখতে বেশ শান্ত ও সুদৃঢ় মনে হলো। কাঠের নির্মাণের মাঝে রং-বেরঙের জানালাগুলো যেনো আঁকা ছবির মতো। সব মিলিয়ে রূপকথার সেই স্বপ্নের দেশ!

হোটেলে ঢুকতেই একজন কোমল চেহারার মেয়ে আমাদের হাসিমুখে স্বাগত জানাল। অপেক্ষা কক্ষে হরেক রকমের চা, ফল ও বিস্কিটের পসরা, যা সকল অতিথিদের জন্য বিনিময় মূল্য ছাড়াই অপেক্ষমান। এমনকি বৃষ্টির জন্য ছাতা এবং বেশী শীতের জন্য কয়েকটি জ্যাকেটও রয়েছে। আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলে যেভাবে খাবার দিয়ে আতিথেয়তা করা হয়, আবার তাদের ছাতা কিংবা জ্যাকেটও প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। ঠিক তেমনি এই হোটেলটিকে মনে হলো খুব কাছের কোন মানুষের বাড়ি।

একটি আপেল ও ফুলের সৌরভ যুক্ত চা এবং ক্রোয়েসান্ট খেয়ে রুমে ঢুকতেই মনে হলো একেবারে আধুনিক এক পাঁচতারকা হোটেল এসে পড়েছি। সত্যি সেলুকাস, কত সুন্দর এই পৃথিবী!

সন্ধ্যায় ফন্ডু খাবার পরিকল্পনা রয়েছে বলে দ্রুত তৈরী হয়ে পৌঁছে গেলাম রেস্তোরাঁয়। আমাদের খাবার টেবিলটির ঠিক পেছনেই সেই বিখ্যাত ম্যাটারহর্ন পর্বত চূড়া। এই বিখ্যাত পর্বতচূড়াকে শুধু ছবিতেই দেখা হয়েছে। আজ একেবারে চোখের সামনে দেখে খাবার অর্ডার করতে বেমালুম ভুলে গেলাম। আরও একটু সামনে গিয়ে পাহাড়ি তেজস্বী ঝরনার কলকল সুরে পরিবেশ আরও মধুময় হয়ে উঠল। কাল সকালে এই পর্বত চূড়াতেই তো আমরা উঠব, ভাবতেই মনটা আবারও আনন্দে ভরে উঠল।

এক পুরুষ কণ্ঠের ডাকে চূড়ার সঙ্গে মনসংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই বুঝতে পারলাম, সময় বেশ গড়িয়ে গেছে। ফন্ডুর জন্য এখনই বলতে হবে। আমার কোন্ ধরনের ফন্ডু চাই তাও জানাতে হবে খুব দ্রুত। কারণ ঐতিহ্যবাহী এই খাবার তৈরীর প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। জারম্যাট গ্রামের প্রচলিত খাবার ফন্ডু। এ অঞ্চলের মা-চাচী, দাদী-নানীরা এ খাবার খুব মনোযোগ দিয়ে তৈরী করে থাকেন। ফন্ডু হয় হরেক রকমের। হাসান সারওয়ার্দী আমার উপরেই ছেড়ে দিলেন ফন্ডু অর্ডারের ভার। কিছুটা সময় অতিবাহিত হবার পর ঐতিহ্যবাহী সেই ফন্ডু চলে এলো আমার সামনে। বিভিন্ন ধরনের পনির, রসুন, আঙ্গুরের রস আর প্রাকৃতিক ভেষজের সংমিশ্রণ জ্বাল দিতে দিতে যখন সুস্বাদু গলিত পনিরে রূপান্তরিত হয়, তখন তাকে বলা হয় ফন্ডু। ফন্ডু যে টেবিলে পরিবেশন করা হয় সেই টেবিলের নিচে বিশেষভাবে সেট করা থাকে একধরনের চুলা। ফন্ডু এনে টেবিলের সেই নির্দিষ্ট চুলায় হালকা আগুনে রাখা হয়। টুকরো রুটি, মাংসের টুকরো, ব্রোকোলিসহ আরও অন্যান্য সব্জির টুকরো লম্বা কাটা চামচে নিয়ে গলিত গরম পনিরে অর্থাৎ, ফন্ডুতে ডুবিয়ে তবেই খেতে হয়।

প্রথম টুকরো মুখে দেবার আগেই জিভে জল চলে এলো আমার। পেছনে দাঁড়িয়ে সুউচ্চ ম্যাটারহর্ন। আর ঠিক ঝরনার পাশের ফন্ডু রেস্তোরাঁর মাঝে বসে আমার মনে হচ্ছে সুইজারল্যান্ডকে তাদের সেই সময় আর এই সময়ের সুতোয় গেঁথে আমি যেনো ঠিক ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়ে বসে আছি। টেবিলে পরিবেশন যোগ্য চুলার উপর গলিত পনিরের  মাঝে ছোট এক টুকরো ব্রোকলি লম্বা কাঠি দিয়ে গেঁথে, গলিত মশলা যুক্ত গরম পনিরে, অর্থাৎ ফন্ডুতে ডুবিয়ে মুখে দিতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো আমার। সমস্ত মনোযোগ জিহ্বার উপর। বাহ্! কী দারুণ স্বাদ; যেনো অমৃত। মোমবাতির আলোতে মুহূর্তটি আরও সোনালী হয়ে উঠল! অনেকক্ষণ ধরে খাবার আর স্থানীয় সঙ্গীতে সন্ধ্যাটি হয়ে উঠল স্মৃতিময়। পর্বত চূড়া ম্যাটারহর্নকে বিদায় জানিয়ে পরদিন সকালে দেখা হবার প্রতিজ্ঞা করে হোটেলে ফিরে এলাম আমরা। রাতে ঘুম হলো না কিছুতেই আমার। কেবলই থেকে থেকে মনে হতে লাগলো এইতো সূর্য উঠলেই আমরা যাচ্ছি আল্পস্-এর সেই বিখ্যাত চূড়ায়।

পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে নাস্তার টেবিলে আসতেই আবারও মনে হলো আত্মীয়ের বাড়ি। হরেক রকম খাবার সাজানো টেবিলে। পছন্দ মতো খাবার প্লেটে তুলে নিয়ে ডিম সেদ্ধ করবার জায়গায় এসে লক্ষ্য করলাম বয়েল-টাইম ১৫ মিনিট। যেখানে সমতলে হাফ-বয়েল করতে ৫ মিনিট আর ফুল বয়েল করতে লাগে ৮ মিনিট। সেখানে ৫৩১০ ফুট কিংবা ১৬০৮ মিটার উপরে এসে ডিম সেদ্ধ করার সময়টা বেশি লেখা কেন? ভুল করেনি তো? জানতে পারলাম, উচ্চতা যতো বাড়বে আর তাপমাত্রা যতো কমবে, খাবার সেদ্ধ কিংবা রান্না করার সময় ততো বেশি লাগবে। জ্ঞানার্জনের পর সকালের বাহারী নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লাম ম্যাটারহর্ন জয়ের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা এই পর্বত ঘেরা গ্রাম জারম্যাট থেকে নির্দিষ্ট পথ ধরে চলে যাব আল্প্‌স-এ সেই অত্যাশ্চার্য পর্বতশৃঙ্গে।

আল্পস্-এর ম্যাটারহর্ন পর্বত সুইজারল্যান্ড ও ইটালির সীমানার মাঝে অবস্থিত। যা কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে মৃত্যুপ্রবণ শৃঙ্গ। প্রায় পাঁচশ আলপিনিস্ট মৃত্যুবরণ করেন এই পর্বতে আরোহণ করতে গিয়ে এবং প্রথমবারের মতো ১৮৬৫ সালে ১৪ জুলাই এডওয়ার্ড উইমপার ও তার দল ম্যাটারহর্ন আরোহণে সফল হন। দুর্গম এই পর্বতশৃঙ্গের ছবি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা কিংবা বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় বলে, এটিকে পৃথিবীর সেলিব্রিটি পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।

‘ম্যাটারহর্ন এক্সপ্রেস ক্যাবল-কার’-এ শৃঙ্গে উঠবার জন্য, ক্যাবল-কার স্টেশনে পৌঁছে টিকেট কেটে অপেক্ষায় দাঁড়ালাম। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঝুলন্ত বাসের মতো দেখতে ক্যাবল-গন্ডুলা এসে হাজির হয়ে গেল। সংখ্যাটি ঠিক ওভাবে মনে নেই। প্রায় ৩৫ জনের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত আমরা সমমনা মানুষেরা একসঙ্গে চড়লাম সেই গন্ডুলায়। দরজা আটকে গিয়ে আমাদের যাত্রা হলো শুরু। উপরের দিকে যাত্রা প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোণে। জারম্যাট-এর বাইরের ঘন জঙ্গল আর বুনো-সবুজ সমতলের উপর দিয়ে দশ মিনিটের যাত্রার পর আমরা পৌঁছে গেলাম একটি স্টেশনে। এখান থেকে এতক্ষণ যে ক্যাবল-কার-এ চড়ে এলাম; তারচেয়ে তিনগুণ শক্তিশালী ক্যাবল-কার দি নিউ থ্রি এস ক্যাবল ওয়ে-তে করে প্রায় ৯০ ডিগ্রি কোণে ৩৫ মিনিট সময় ব্যয়ে ঊর্ধ্বপানে ছুটলাম। দি নিউ থ্রি এস ক্যাবল-গন্ডুলাটি আমাদের টেনে তুলে নিয়ে এলো শৃঙ্গ চূড়ায়। আগের দশ আর পরের পঁয়ত্রিশ, মোট ৪৫ মিনিটের যাত্রায় আমরা এক হাজার দুইশ আট মিটার উঁচুতে পৌঁছে গেলাম খুব সহজে।

এখান থেকে আবারও যাত্রা। ‘ক্লেইন ম্যাটারহর্ন ক্যাবল-কার’-এ দ্বিতীয় যাত্রা যেন একেবারে ভিন্ন। এবার যেন পিঠে পাখাজুড়ে উড়তে লাগলাম আমরা। সে কী শিহরণ! একটু দুলুনি, পেটের ভেতর হঠাৎ শূন্য হয়ে যাওয়া। ঝুলন্ত বাসটি ঊর্ধ্বপানে ছুটছে একেবারে পাহাড়ি, বন্ধুর, সফেদ বরফাঞ্চল আল্পস্-এর উপর দিয়ে। সৃষ্টিকর্তার কী অপরূপ সৃষ্টি! এ জীবনে এই দৃশ্য অবলোকন এই প্রথম। এতো সাদা, এতো বরফ, আর স্বপ্নের পর্বতমালা আল্পস্। ঈশ্বর মহান, বড়ই মহান। তিনি আমাকে এ কিসে অবগাহন করালেন!

একদম শেষ সময়ে এসে আমার মনে হলো আমাদের যেন ঠিক কেউ মাথার উপরে টেনে তুলছে। ঝুলন্ত গন্ডুলার সামনে একদম খাড়া পাহাড়। ভাবছিলাম এডওয়ার্ড উইমপার-এর কথা। কী করে সফল হয়েছিলেন তিনি? কীভাবে সম্ভব? আসলে পৃথিবীর যেকোনো বিষয়েই যারা পথিকৃৎ, কষ্ট ও আত্মোৎসর্গের বিষয়টা তাদের জীবনের সঙ্গে এক হয়ে যায়। কিন্তু পরে যারা হাঁটেন সেই পথে, তারা কজনইবা মনে রাখেন এই মহান মানুষদের কথা? এই দৃশ্য সেই সাক্ষী দিচ্ছে, কেন এই পর্বতশৃঙ্গ সবচেয়ে মৃত্যুপ্রবণ।

ম্যাটারহর্ন গ্লেসিয়ার প্যারাডাইস পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে চার হাজার চারশ আটাত্তর মিটার উপরে অবস্থিত। আল্পস্ পর্বতমালায় চার হাজার মিটার কিংবা তেরো হাজার ফুট-এর উপরে উচ্চতার এমন প্রায় একশ শৃঙ্গ রয়েছে। তবে ৪৮১০ মিটার উঁচু ‘ম্যঁ ব্লা’ শৃঙ্গটিই ইউরোপের এবং আল্পস্ পর্বতমালার সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ। আর ঠিক তার পরেই অবস্থান ম্যাটারহর্ন-এর। সেই ম্যাটারহর্ন-এর সবচেয়ে উঁচু স্থানটিতে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা। একেবার ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে শুধুই পর্বতশৃঙ্গ চোখে পড়ছে। ধবধবে সাদা। প্রায় চার হাজার মিটার উঁচু এই পর্বতশৃঙ্গে দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখে নিলাম প্রায় ১৪টি গ্লোসিয়ার বা বরফের চাঁই ঘেরা শৃঙ্গ। বেশ কিছু রং-বেরঙের তালা ঝুলছে একটি লৌহনির্মিত রেলিং-এ। মনের কথা তালা মেরে প্রতিজ্ঞা করে তালা বন্ধ করা হলে তা আর ব্যর্থ হবে না বলে যারা বিশ্বাস করেন, তারা এখানে একটি করে তালা ঝুলিয়ে চাবি বরফের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে চলে যান। দু’হাত ভরে বরফ কুঁচি নিয়ে গালে আলতো করে ছুঁয়ে নিলাম। কিছু বরফ মুখে পুরে দিয়ে এর স্বাদ নিতেও ভুল হলো না। এক সময় চির শীতল ধবধবে সাদা বরফের মাঝে শুয়ে পড়লাম হাত পা ছড়িয়ে। চির উষ্ণতম সূর্যের সঙ্গে পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে সবচেয়ে কাছে থেকে ইশরায় কিছু ভাব বিনিময়ও হলো!

খুব বেশী সুন্দর কিছুকে বেশিক্ষণ সহ্য করা মুশকিল। তাই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে ধারণ করে নিলাম এই বিস্ময়কর সৌন্দর্য।  এরপর নিচে এসে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ছোট্ট হলে ঢুকে ডিমের মতো গোল চেয়ারে বসে একটু উষ্ণ হয়ে নিলাম। এরপর যে থ্রী-ডি চলচ্চিত্রটি আমার চোখের সামনে চলল তা আমার অনুভূতির পূর্ণতা এনে দিল। এই চলচ্চিত্রে বছরজুড়ে বিভিন্ন ঘটনা ও শৃঙ্গের উপর নির্মিত চলমান চিত্র দেখানো হয়। মনে হলো, আমরা যেন হেলিকপ্টারে চড়ে পর্বতশৃঙ্গ ঘুরে দেখলাম উপর এবং চারপাশ থেকে। সেই অনুভূতি নিয়ে ঢুকে গেলাম বরফ রাজ্য গ্লোসিয়ার প্যালেসে। বরফ নির্মিত এক রাজ্য একেবারে শক্ত বরফের চাঁই কেটে নির্মিত সুরঙ্গ দিয়ে হেঁটে ভেতরে যেতেই দেখা গেল বরফ কেটে তৈরী করা বিভিন্ন শিল্পকর্ম। কয়েকটি নেকড়ে, উড়ন্ত বক, হরিণ, রানী, ষাঁড়-যুদ্ধ, আরও কত কী! এর মাঝে রয়েছে স্নো-টিউবিং। বরফের মাঝে চিকন সুরঙ্গ কাটা রয়েছে। যার এক মাথায় বসে যাত্রা শুরু করলে পিচ্ছিল খেয়ে স্লিপারের মতো দ্রুত আরেক প্রান্তে এসে পড়া যায়। ভেতরের সময়টুকু একদম কাঁচঘেরা একটি টিউব এবং তা বেশ লম্বা। বরফ রাজ্যের রাজকন্যার অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে আসতেই মনের জোর বেড়ে গেল অনেকখানি। এবারে স্কী করবার পালা।

হ্যাঁ, জীবনে প্রথমবারের মতো স্কী-ব্লেড, বরফে চলার উপযোগী জুতো আর সরু লাঠি নিয়ে আল্পস্-এর বিখ্যাত সফেদ বরফে আমি দৌড়ে বেড়াব। থরে থরে সাজানো সরঞ্জামগুলো হাতে নিতেই বেশ পুলক অনুভব করলাম। যথারীতি বরফের মাঝে সমস্ত কিছু নিয়ে পরিধানের সময় এক সাহায্যকারী বন্ধু এসে হাজির। আমার আচরণে তিনি ইতোমধ্যে বুঝে গিয়েছেন যে, আমার জীবনে এই ঘটনা প্রথম। এবার তিনি আমায় বুঝিয়ে বললেন, অন্তত তিন ঘণ্টা লাগবে শিখতে- বরফের মাঝে কী করে আমি দাঁড়িয়ে থাকব এবং সামনের দিকে পিছলে দৌড়াব। আমার আগ্রহ দেখে আমাকে শেখানোর আগ্রহ তারও জাগ্রত হলো। কিন্তু হাতে সময় বাকি আছে মাত্র বিশ মিনিট। এরপর আমরা সূর্যের শেষ রশ্মিতে ম্যাটারহর্ন-এর সোনালী চূড়ায়, পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে চার হাজার মিটার উপরে নৈশ ভোজে অংশ নিতে যাচ্ছি। আমি অনুভব করলাম, একটি জীবনের জন্যে এই একটি দিনের অভিজ্ঞতা অনেক বড় পাওয়া। শেষ ক্যাবল গন্ডুলা ছাড়ার ১৫ মিনিট আগেই আমাদের ভ্রমণ শেষ করতে হবে। জীবনে আবারও কোন একদিন সফেদ বরফের মাঝে স্কী-ব্লেড পরে দৌড়ে বেড়াব সেই স্বপ্ন আর আগ্রহ নিয়েই এবারে জারম্যাট ফিরতে হবে বুঝলাম। নির্দিষ্ট সময়ের পর এখানে থেকে যাওয়াটা মোটেও নিরাপদ নয়। তাই আইস-স্কী করার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ফিরে এলাম জারম্যাটে।

খাবারের সামনে এসে টের পেলাম- হ্যাঁ, পেটে বেশ ক্ষুধা আছে। চারদিকে কাঁচঘেরা এক দারুণ রেস্তোরাঁ! চারদিকে বরফ আর তার মাঝে সূর্য রশ্মি যেন এই সাদা রং সোনালী করে দিচ্ছে। যেনো কোনো পটু আঁকিয়ে তার তুলির আঁচড়ে রং ছড়াচ্ছে। রুটির বাটিতে অক্সটেইল স্যুপ, কিছু সবজি আর নরম গরুর মাংস রয়েছে আলু ভর্তার সাথে। শুধু খাবারের স্বাদ নয়। বরং পুরো পরিবেশটাই হয়ে উঠেছে একেবারে স্বর্গীয়।

এই স্বর্গীয় পরিবেশকে যেন শতভাগ পূর্ণ করল আমার ভ্রমণসঙ্গী। যেকোনো ভ্রমণে একজন মনের মতো ভ্রমণসঙ্গী থাকলে আনন্দ বেড়ে যায় শতগুণ। আমার আল্পস্ পর্বতশৃঙ্গ ভ্রমণের প্রিয় সঙ্গী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডক্টর চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী, বীর বীক্রম। পর্বতসম এই মানুষটি ছাড়া কেইবা হতে পারতো আমার এই ভ্রমণের সঙ্গী!

আল্পস্-এ সফর শেষ করে ক্যাবল-গন্ডুলায় যখন ফিরছিলাম। তখন কথা বলতে বলতে দুজনেই একমত হয়েছিলাম যে, সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমাদের জীবনের ছক কেটেই রাখেন। নতুবা পর্বতশৃঙ্গ ভ্রমণে কেনইবা আমরা এই দুজনই অবশেষে এক হলাম? পাহাড়েই কাটে যে মানুষটির যোদ্ধা জীবনের বড় অংশ। সেই তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হন দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে। আর দেশ মা তাকে তার রক্তের বিনিময়ে তুলে দেন সেই বিরল সম্মান, শ্রেষ্ঠ প্রতিদান, গর্বের বিশেষণ- ‘বীর বীক্রম’। দেশ মার্তৃকার এমন এক সূর্য সন্তানের সঙ্গে স্বপ্নের আল্পস্-এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পদার্পণ এই ভ্রমণকে দিয়েছে এক অনন্য শ্রেষ্ঠত্ব এবং করেছে স্মৃতি অম্লান।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়