ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রাজকোটবাসীদের স্যালুট

মিলটন আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৫, ১১ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাজকোটবাসীদের স্যালুট

রাজকোট শহরের দৃশ্য

পশ্চিম ভারতের সমৃদ্ধ রাজ্য গুজরাট। এর প্রধান শহর রাজকোট। আগের রাতে দেরি করে ঘুমিয়েছিলাম। তাই কখন সকাল হয়েছে টের পাইনি। মোবাইলে নয়টা বেজে আটচল্লিশ। দেশের বাইরে গেলে রাতে ঘুমাতে কিছুটা দেরি হয় বৈকি।  কিন্তু সব সময় সকালে প্ল্যান থাকে বলে সময় মতো ঘুম ভাঙে, সময়মতো বের হই। কিন্তু আজ ওরকম প্ল্যানিং ছিল না, আশেপাশে কোথাও ঘুরতে যাব। তাই সকালে তড়িঘড়ি করে ওঠার প্রয়োজন মনে করিনি। আমাদের তিনজনের সাথে ট্যুরে বই থাকে। উদয় হাকিম স্যার, ফিরোজ স্যার, আমি– তিনজনেরই পড়ার অভ্যাস আছে।  সিনেমা দেখতেও পছন্দ করি।

গোসল করে বেরিয়ে পড়লাম। তার আগে গুগল মামার সহায়তায় জানতে পারলাম কাছেপিঠে স্বল্প সময়ে আর অল্প খরচে রাজকোট চিড়িয়াখানায় ঘুরে আসা যাবে। হোটেল থেকে বিশ বাইশ মিনিটের পথ। একশ কুড়ি রুপিতে অটোরিকশা নিলাম।

চিড়িয়াখানায় কি দেখতে পাব সেটা তো সবারই জানা। ডিএসএলআর ক্যামেরার ব্যাগে অতিরক্তি কিছু টি-শার্ট নিলাম। চেঞ্জ করে করে ছবি তোলা হবে। চিড়িয়াখানায় ঢুকতে একেকজনের পঁচিশ রুপি করে নিল। ক্যামেরার জন্যও বিশ রুপি মূল্যের একটি টিকিট কিনতে হলো। তা না হলে ক্যামেরা ভেতরে এলাউ না। 

ভেতরে ঢুকে অনেক হেঁটেছি।  প্রাণী দর্শনে আগ্রহ ছিল না। ফরেস্ট অঞ্চলটায় হাঁটব, ছবি তুলব এটাই উদ্দেশ্য।  হাঁটতে হাঁটতে কয়েকটা সুন্দর স্থানে একে অপরের ছবি শিকারও হচ্ছে।  ইচ্ছা হল সাদা বাঘ দেখব, দেখলাম। এই বাঘ নাকি চিড়িয়াখানা বা মনুষ্যসৃষ্ট ফরেস্ট ছাড়া বাঁচতে পারে না।  পাশেই দেখলাম একটি জায়গায় লেখা হায়েনা। এই প্রাণীটাকে খালি চোখে দেখার দারুণ ইচ্ছা হলো। যদিও এরা দেখতে কুকুরের মতোই প্রায়। তবু আমাদের দেশে অনেক সময় অতি মাত্রায় হিংস্রতা বোঝাতে এই প্রাণীটির নাম মুখে আনে। এই প্রাণীটি কি জানে ওর এত কদর মানুষের কাছে? বেচারাকে নিরীহভাবে বসে থাকতে দেখলাম। যতদূর শুনেছি এই হায়েনার সাথে এখন কুকুরের ক্রস করা হয়। সম্ভবত দোবারম্যান, পিনশার এই জাতীয় কুকুরকে আরো হিংস্র আর স্মার্ট করতে এই পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয়।

হঠাৎ কাছেপিঠে বিকট গর্জন শুনে ফিরোজ স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিসের শব্দ? উনি অপেক্ষায় থাকলেন ৩ সেকেন্ড। আবার সেই গর্জন। বললেন, সিংহ। বাপরে। আমার মুখ থেকে কথাটা বের হয়ে এল।  মিনিট দুই তিন হাঁটার পর দেখলাম অদূরে গা এলিয়ে শুয়ে আছেন মামা। মামাই তো। ছোটবেলা তো বইতে সিংহ মামা জেনেই এসেছি। যাই হোক, ক্যামেরা আমার– ছবি তুললাম মামার।

খুব ক্ষুধা লেগেছে, অনেক হাঁটার কারণে। ভেতরেই আমরা একটা ক্যান্টিনে ঢুকে স্যান্ডউইচ দিতে বললাম। আলু স্যান্ডউইচ তৈরি করে দিলেন দোকানদার।  অনেক কষ্ট করে সে জিনিস একটু খাওয়া গেল। সাথে কোকাকোলা।  ঢকঢক করে গলায় ঢেলে বিল মিটিয়ে বের হয়ে এলাম।

আরেক মামা তখন মধ্য গগনে। সূর্য। হোটেলে ফিরে আসলাম। রুমে ঢুকে চেঞ্জ করেই লাঞ্চের অর্ডার দিলাম। এখানের ভেজিটেবল বিরিয়ানি খুব বিখ্যাত। আরও আছে ভেজিটেবল খিচুড়ি। খিচুড়ি অর্ডার করলাম। রাজকোটের মানুষ ভোজন বিলাসী। তবে ভেজেটেরিয়ান। এখানকার প্রায় নব্বই শতাংশ বাসিন্দা ভেজেটেরিয়ান। প্রশ্ন করতে পারেন– তাহলে ভোজন বিলাসী কিভাবে? হ্যাঁ, এরা ভেজেটেরিয়ান হয়েও শত রকমের খাবার খায়। এখানের মানুষ খেতে ভালোবাসে।  হরেকরকম আর পদের। তবে প্রচলন নেই মদের। এই অঞ্চলে নাকি এসব পানীয় ছুঁতেও মানা।  অনেক রকমের রেস্টুরেন্ট আছে।  এখানকার নানা রকম স্ট্রিট ফুডও যথেষ্ট বিখ্যাত।

রাজকোটে প্রথম যেদিন এসেছিলাম, হোটেলে লাগেজ রেখেই দুজন বেরিয়ে পড়েছিলাম। সিনেমা হলে ঢোকার আগে দুপুরে হালকা কিছু খাওয়ার জন্য আশেপাশে অনেক সময় ঘোরাঘুরি করে কোনো খাবার পাইনি। সব জায়গা কেমন যেন শুনশান নিরব ব্যাপার ছিল। এরকম দুপুরবেলা দোকানপাটও সব বন্ধ দেখে আমরা ধরে নিয়েছিলাম বোধহয় সাপ্তাহিক ছুটির দিন।  দুইটি রেস্টুরেন্ট খোলা ছিল বটে।  কিন্তু আমাদের জানানো হল লাঞ্চটাইম শেষ। তখন তিনটা বাজে। একদিন পর আজ সব বুঝে গেলাম আসলে ব্যাপারটা কি।  ব্যাপারটা হলো- এখানকার মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। আগেই বলেছি এরা ভেজেটেরিয়ান। প্রথমত, এখানে দুপুর তিনটার পর কোথাও কোন রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, দুপুরে সব দোকানপাট বন্ধ থাকে।  যদি কোনো দোকানে একজন থাকে, তবে তিনি বন্ধ করে বাসায় গিয়ে ২/৩ ঘণ্টার ন্যাপ নিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে শপ ওপেন করবেন।  যদি শপে দুইজন থাকে, সেক্ষেত্রে পালা করে রেস্ট করে থাকে।  তবে সেটা যেনতেন বিশ্রাম নয়। দোকান বন্ধ করে ভেতরে ঘুমাবে। অথবা একেবারে বাসায়। সেজন্য আমরা টারমিনেটর দেখে যখন ফিরছিলাম তখন দেখি একেবারে রমরমা ব্যাপার। ঐযে বললাম, দুপুরে রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যায় এরা দিনের দ্বিতীয় ভাগের ব্যবসা আরম্ভ করেন। অর্থাৎ দুপুর একটা থেকে অন্তত পক্ষে চারটা পর্যন্ত পুরো শহর বিশ্রামে থাকে। মজার না? 

সিনেমা দেখার বিরতিতে ফিরোজ আলম ও তায়েব অনন্তর সাথে লেখক মিলটন আহমেদ (ডানে)

দুপুর আড়াইটা নাগাদ আমাদের হোটেলে ফিরে আসি। বলতে ভুলে গিয়েছি, আমরা এখানে যে হোটেলে উঠেছি ওটার নাম পাত্রিয়া স্যুইতস। রুমে এসেই আগে লাঞ্চের অর্ডার দিলাম। ওই একই লাঞ্চ– ভেজিটেবল খিচুড়ি। ল্যাটকা। সাথে কোঁকাকোলা। দুজনেই অনেক ক্ষুধার্ত। এরই মধ্যে তায়েব অনন্ত সাহেব নক করলেন ম্যাসেঞ্জারে। ব্রাদার, আপনারা কই? আমি ফিরতি মেসেজে জানালাম- হোটেলে ফিরলাম। চিড়িয়াখানা দেখে। অনন্ত জানতে চাইল- আপনাদের ওখানে আসা যাবে? তার সাথে আমাদের পটেও ভালো। আসলে আমার কাজ অনেকটা স্পোর্টস সাংবাদিকদের সাথেই। আগেই বলেছি কেউ বড় ভাই, কেউ বন্ধু, কেউ ছোট ভাই। রিলেশানটা এরকমই হয়ে গেছে। অনন্তকে জিজ্ঞাসা করলাম খেয়ে এসেছে কিনা, নাকি অর্ডার দিব? ও নাকি খেয়েই এসেছে। তবে কিছুক্ষণ পর আইসক্রিম খেতে চাইলো।

জার্নির ধকলটা ভালোমতো টের পাচ্ছি। একে তো জার্নি। দ্বিতীয়ত, একবেলা জন্তু জানোয়ারদের এলাকায় ঘুরে ফিরে ক্লান্ত। দিল্লিতে গরম ছিল না। বরং হালকা শীতের আমেজ ছিল। কিন্তু রাজকোটে তা নয়। এখানের ওয়েদার গরম। এমনিতেই এই অঞ্চল পুরো ভারতের মধ্যে অতিরিক্ত গরম অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম। বিকালের আগে আসা তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা গভীরে তলিয়ে গেল।  সন্ধ্যার পর শরীরটা বেশ বোধ করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম রাতে সহসা ঘুম বাবা ধারে কাছে আসবে না। মনে হচ্ছিলো রাত জেগে অর্ধেক লিখে রাখা রাজকোটের গল্পটা শেষ করতে পারব।

পরের দিন। সকাল নয়টায় ইন্দ্রীয় সজাগ হলেও দশটা অব্দি বিছানায় পড়ে থাকলাম। টুংটাং এসএমএস আসা শুরু করেছে মোবাইলের মেসেঞ্জারে। চোখ পিটপিট করে মোবাইলে চোখ রাখলাম। তায়েব অনন্ত। গুডমর্নিং জানিয়েছে। কি করছি? আজকের প্ল্যান কি? জানাল- ব্রাদার আপনাদের মুভি দেখাতে চাই আজকে। সম্ভব? মানে আপাদের শিডিউল হবে? কাল রাতেই আমরা প্ল্যান করে রেখেছিলাম। এগারটায় বেরিয়ে আশেপাশে কোথাও ঘুরে বেড়াব।  অথবা মুভি দেখব।  আর বিকালে মাঠে যাব। সন্ধ্যায় বাংলাদেশ–ভারতের মধ্যকার দ্বিতীয় টি টোয়েন্টি ম্যাচ।  রাজি হলাম অনন্তের প্রস্তাবে। ফিরোজ স্যার সার্চ করা আরম্ভ করলেন কি মুভি দেখা যায়।  নতুন যে সিনেমা পাওয়া গেল সেটা ‘মেইড ইন চায়না’। এটা না দেখলে হয় না! রাজকুমার রাওকে আমাদের তিনজনেরই দারুণ পছন্দ। এটাই মূল কারণ এই মুভি দেখার। এই অভিনেতার কোনো সিনেমা আজ পর্যন্ত ফ্লপ হয়নি। দারুণ মেসেজ থাকে ওর সিনেমায়।

অনন্তের আসতে দেরি দেখে আমরা রেরিয়ে পড়লাম সিনেপ্লেক্সের উদ্দেশ্যে। ফোনে কথা হলো ও সরাসরি স্পটে চলে যাবে।  যেই কথা সেই কাজ। এখানে পাশাপাশি তিনটি স্ক্রিনে সিনেমা চলছে।  আমাদের গন্তব্য এবং পরে অবস্থান তিন নম্বর স্ক্রিনে। স্বল্প বাজেটের দারুণ একটি সিনেমা ছিল ’মেইড ইন চায়না’। সুযোগ পেলে ছবিটা দেখে নেয়ার পরামর্শ দিলাম।

অনন্ত প্রিপারেশান নিয়েই এসেছিল। সিনেপ্লেক্স থেকে সরাসরি স্টেডিয়ামে যাবে। সেজন্যই সাথে করে ওর চ্যানেলের ভিডিও ক্যামেরার ব্যাগ, ট্রাইপড সাথে করেই এনেছে।  সিনেমা শেষ করে ও যথারীতি মাঠের দিকে চলে গেলে আমরা হোটেলে ফিরে আসি। ঘণ্টাখানেক রুমে সময় কাটিয়ে ফ্রেশ হলাম। গন্তব্য সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট এসোসিয়েশান স্টেডিয়াম। হাইভোল্টেজ এই ম্যাচের দামামা বাজতে শুরু করেছে প্রথম ম্যাচে ভারতের হারার পর।

শহর থেকে বেশ দূরের এই স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখলাম এক চুল পরিমাণ ফাঁকা নেই গ্যালারি। যুদ্ধংদেহী ভাব বিরাজ করছে গ্যালারিতে। চারতলা স্টেডিয়াম। আমি মাঠের মধ্যে নিচের সবুজ গালিচায়। দর্শকের উন্মাদনা, ঢোল, আতশবাজি আর উচ্চশব্দের মিউজিকে মনে হচ্ছিল সেকালের গ্রিসের কোনো যুদ্ধের ময়দান। উঁচু কোনো পাহাড়ের চারপাশে উন্মাদ দর্শক সেই প্রতিযোগিতা দেখতে আসত। আর পাহাড়ের নিচের খাদে যোদ্ধারা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতো। হেরে যাওয়া যোদ্ধার মৃত্যু অপরিহার্য ছিল। আর যে জয়ী হত সে আখ্যা পেত গ্ল্যাডিয়েটর-এর। রাজকোটে এসে সেটা টের পেলাম। সবার মুখে মুখে হেরে যাওয়া ম্যাচের ময়নাতদন্ত।

এখানকার মানুষের মধ্যে ভালো যে দিকটি আমরা আবিস্কার করলাম, তা হলো ভারত প্রথম ম্যাচে হেরে গেলেও সবাই বাংলাদেশের দারুণ প্রশংসা করছে। মুশফিকুর রহিমের প্রতি শ্রদ্ধাভরে ভালোবাসা জানিয়েছে। মুস্তাফিজের প্রতি ওদের ভালোবাসার কমতি নেই।  উঠতি তারকা সৌম্য সরকার, মোসাদ্দেক, মিরাজদের প্রতিও ভালোলাগা জানিয়েছে আমাদের কাছে।  ওরাই যে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ সেই আশাও তাদের।  হোটেলের লবিতে, রেস্টুরেন্টে, সবখানে টিম বাংলাদেশের প্রতি মুগ্ধতা দেখেছি আমরা। নিজেদের দেশে হেরে যাওয়ার পর ওদের মতো শ্রদ্ধা জানাতে পারি না আমরা অন্য জাতির খেলোয়াড়দের প্রতি। অথচ ওদের মুগ্ধতা আমাদেরও মুগ্ধ করেছে।  সম্মানিত করেছে। নিরবে নিভৃতে আমরা স্যালুট জানাই রাজকোটের মানুষদের।

পড়ুন :


ভারত/মিলটন/সুজন/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়