ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

সাধুর আস্তানায় রক্তাক্ত ইতিহাস

সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাধুর আস্তানায় রক্তাক্ত ইতিহাস

ঘড়ির কাটায় তখন হয়তো ভোর ছয়টা। আমি নিদ্রাদেবীর আবেশে আবিষ্ট। এরই মাঝে আমার সহধর্মিণী সানন্দা গুপ্ত কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছেন। ঘুম থেকে ওঠো- সকালটা কি সুন্দর! ঝরা পাতাগুলো মৃদু বাতাসে ছন্দ তুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। কুয়াশা সকালের সূর্যকে গিলে ফেলতে চাইছে সমস্ত শক্তি দিয়ে। কিন্তু সূর্য মামার সঙ্গে পেরে ওঠে সাধ্য কার!

আমি বললাম- উঠছি! এই ফাঁকে তিনি ঘরের সব জানালা খুলে দিলেন। বাইরের শীতল হাওয়া ঘরে প্রবেশ করতে লাগল। এই হাওয়ায় নিদ্রাদেবী আমায় আরো বশ করে নিলেন। কিন্তু পাখির কলরব আলো বেশি কানে এসে বাজছে। এবার সত্যি সত্যি ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠেই তৈরি হয়ে নিলাম নতুন গন্তব্যে যাব বলে। বলাই হলো না, আমি আমার নতুন ভ্রমণসঙ্গীকে নিয়ে উঠেছি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে; দুসাই রিসোর্টে। অসাধারণ পরিবেশ- সবুজের মাঝে সর্পিল পথ। বেশ ভালোই কাটছে আমাদের।

সকালের নাস্তা শেষ করে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম নতুন গন্তব্যে। কোথায় যাওয়া যেতে পারে ভাবছিলাম। ভ্রমণের জন্য চার চাকার গাড়ি ইতোমধ্যেই ছুটতে শুরু করেছে। চার চাকার মহাজনকে বললাম, নতুন কোথায় যাওয়া যায় বলুনতো? তিনি বললেন, স্যার বধ্যভূমি-৭১-এ চলেন। ভানুগাছ সড়কে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সেক্টর হেড কোয়ার্টারসংলগ্ন ভুরভুরিয়া ছড়ার পাশেই অবস্থিত। এটি এখন শ্রীমঙ্গল শহরের অন্যতম স্থান। আমি বললাম, চলো তাহলে।

গাড়িতে চলছে পুরনো দিনের গান। এগিয়ে চলছি আঁকাবাঁকা পথ ধরে। প্রকৃতির অসাধারণ রূপ আমাদের মোহিত করছে। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছালাম বধ্যভূমি-৭১। সত্তর থেকে আশি বছরের পুরোনো একটি বিশাল বটগাছ। গাছটির ডালপালা বেশ বিস্তৃত। চারপাশে সমানভাবে সম্প্রসারিত। দেখে মনে হয়, সোঁদা মাটির গন্ধ নিতে গাছটি চারপাশে অনেকগুলো বাহু মেলে ধরেছে। বিশাল এই বটগাছের পাশ দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে পাহাড়ি ঝরনা। আমাদের চালক সাহেবের কাছে নাম জানতে চাইলে বললেন- পাহাড়ি ঝরনাধারার নাম ভুড়বুড়িয়া ছড়া। ছড়ার এক পাশে জেমস ফিনলে কোম্পানির ভাড়াউড়া চা-বাগান। বাগানে চোখজুড়ানো সমান্তরাল চায়ের আবাদ। অন্য পাশে বিজিবি ১৪ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর। ধীর পদক্ষেপে আমরা এগিয়ে গেলাম বধ্যভূমির দিকে।

সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। দূর থেকেই চোখে পড়ল ঝুলন্ত সেতু। পরিচয় হলো এলাকার প্রবীন রমিজ উদ্দিনের সাথে। তিনি বললেন, পাকিস্তান আমলে এই বটগাছের নিচে একজন সাধুর আস্তানা ছিল। এখানে চা-শ্রমিক ও বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মানত করত, পূজা দিত। জায়গাটি ‘সাধু বাবার থলি’ নামে পরিচিত ছিল। দৃষ্টিনন্দন এই পূণ্যস্থান আরও পবিত্র হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নয় মাসে; এই পূণ্যভূমে ঘুমিয়ে আছে শত-সহস্র তাজা প্রাণ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে এখানে হত্যা করেছে। হত্যার আগে বটগাছের ডালে ঝুলিয়ে হানাদারেরা তাঁদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধা নন, তাঁদের স্বজন ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকেও ধরে এনে বটগাছের ডালে উল্টো করে বেঁধে রেখেছে। তৃষ্ণায়, মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করে তাঁরা এখানে শহীদ হয়েছেন।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম- সবুজ গালিচা বিছানো চায়ের জনপদ থেকে জন্ম নেয়া পাহাড়ি উচ্ছল ঝরনাধারা স্বাধীনতা সংগ্রামের নয়টি মাস এখানে এসে রক্তে প্লাবিত হয়েছে। ভুড়বুড়িয়া নামের এই ঝরনা না-জানি কত শত-সহস্র অকুতোভয় মুক্তিসেনা, মুক্তিকামী সাধারণ বাঙালি আর পাশের চা-বাগানের আদিবাসী নিরীহ শ্রমিকদের পবিত্র রক্ত বুকে ধারণ করেছে। হয়তো এর কিছু অংশ তার জন্মঋণ শোধ করতে বয়ে নিয়ে গেছে উপজেলার পশ্চিম সীমান্তে। আমরা নগ্ন পায়ে এগিয়ে গেলাম, দেখা পেলাম ছড়ার পাশে শহীদদের নামফলক। সেখানে কিছু সময় দাঁড়িয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। ২০১০ সালের শেষ দিকে বধ্যভূমিতে নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভ। এরই ধারাবাহিকতায় এখানে নির্মিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য মৃত্যুঞ্জয়ী-৭১, যা ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন হয়।

লক্ষ্য করলাম অনেকেই এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য দেখতে। চারদিকে সবুজের লীলা। সারি সারি চা-গাছ; সবুজ সতেজ। হয়তো এরই মাঝে একঝাঁক পাখি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাবে সুরের মুর্চ্ছনায়। স্মৃতিস্তম্ভ বধ্যভূমির চারপাশ যেন প্রকৃতির নিজ হাতে আঁকা মায়াবি এক নৈসর্গিক দৃশ্য। সুনীল আকাশ, শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো চা বাগানের মনোরম দৃশ্য যে কাউকেই নিয়ে যাবে ভিন্ন জগতে। দেখতে দেখতে আমাদের বিদায়ের পালা চলে এলো। আমরা ফিরে চললাম নতুন গন্তব্য পথে।

শ্রীমঙ্গল শহরেই বধ্যভূমি-৭১- এর অবস্থান। যেতে হলে আপনাকে বাস অথবা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল শহরে নামতে হবে। শহরের চৌমুহনা থেকে রিকশায় ৭-৮ মিনিটের পথ। ভানুগাছ সড়কে বনবিভাগ অফিসের বিপরীতে এবং বিজিবির সদর দপ্তরসংলগ্ন এই বধ্যভূমির অবস্থান।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়