ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

মেঘের দেশে ক্লান্তি শেষে : প্রথম পর্ব

আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ৪ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মেঘের দেশে ক্লান্তি শেষে : প্রথম পর্ব

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে লেখক

‘মেঘ-বিছানো শৈলমালা গহন-ছায়া অরণ্যে।
ক্লান্ত জনে ডাক দিয়ে কয়, ‘কোলে আমার শরণ নে।’
ঝর্না ঝরে কল্‌কলিয়ে আঁকাবাঁকা ভঙ্গিতে,
বুকের মাঝে কয় কথা যে সোহাগ-ঝরা সংগীতে।’
 [শিলঙের চিঠি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

রবীন্দ্রনাথ যেন ভর করে বসল আমাদের উড়াধুরা দলটার। না, কেবল রবীন্দ্রনাথকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের দলনেতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, পাঠচক্রে ‘শেষের কবিতা’ পড়াতে পড়াতে যেন দ্বিতীয়বার পাহাড়ের কোলে ক্লান্তি শেষে আশ্রয় নিতে চাইলেন। যদিও তাঁর দ্বিতীয়বার কিন্তু পুরো দলটার প্রথমবার। ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্যের হেঁটে চলা পাইন বনে যেন হাঁটতে শুরু করলাম আমরা অমিত-লাবণ্যরা। উকিঁঝুকিতে জড়িয়ে পড়লাম শিলং নামক শৈল শহরে, মেঘের আনাচ-কানাচে, পাহাড়ের কোলজুড়ে আমরা আসন পেতে বসে পড়লাম গরমের ক্লান্ত শরীরে।

‘গর্মি যখন ছুটল না আর পাখার হাওয়ায় শরবতে,
ঠাণ্ডা হতে দৌড়ে এলুম শিলঙ-নামক পর্বতে।’

সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি। তপ্ত গরমে ঢাকায় মাছভাজা। এমন সময় কেন্দ্রের ছাদে চাঁদ-হাওয়ার মাঝখানে স্যারের খেয়ালী কথা- চলো শিলং গিয়ে জুড়িয়ে আসি। তবে সবাই না। বাছাই করে কেউ কেউ। স্যারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাছাই পর্বে আমার নামটিও চলে এলো। শুরু হলো প্রস্তুতি। কারও পাসপোর্ট আছে, তো কারও নেই। কারও টাকা আছে, কারও ধার করতে হবে, কারও যাবার তীব্র ইচ্ছা, কিন্তু অভিভাবক বাধা। এমনি নানা প্রতিকুলতায় সময় ঘনিয়ে এলো। আমারও অফিসিয়াল সরকারি পারমিশন জুটে গেল। সেদিনের আনন্দ যেন আর কিছুতে তুলনীয় নয়। পরিকল্পনা হলো ট্রেনে সিলেট, একরাত সিলেট স্টে করে পরদিন ভোরে শিলংঙের উদ্দেশ্যে যাত্রা। যথা কথা, তথা কাজ। শুভস্য শীঘ্রম। মে মাসের ৭ তারিখ দুপুর আড়াইটায় কমলাপুর থেকে ট্রেনে যাত্রা শুরু। হৃদয়ের কিনারজুড়ে তখন মেঘের রাজ্যে যাবার আনন্দ সবার। টুকিটাকি কেনাকাটা শেষ। একে একে প্লাটফরমে সবাই উপস্থিত। দল আঠারো জনের। একজন অনুপস্থিত। বারবার ঘড়ি দেখা। আসছে না সে! উঠে পড়া হলো ট্রেনে। সময়মতো চিত্রার হুইসেল। ঘটঘট করে রাজনন্দিনী প্লাটফরম ছেড়ে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে দেখা গেল আমাদের অতি প্রিয় খুশী হাজির। তখন আর ট্রেন আটকাবার উপায় নেই। ওর চোখের জল দেখে সবার মন কেমন করে উঠলেও সমাধান বেরিয়ে গেল। ফোনে বলা হলো- বাই রোডে সিলেট চলে যেতে।

পথ ধরে হইহই। রাতে সিলেটে স্যারের ছাত্রীর বাড়ি অবস্থান। ভোরে কাঙ্খিত মূল যাত্রা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছার কথা থাকলেও ভারত থেকে আমদানি করা কয়লা ও পাথরবোঝাই ট্রাকের আনাগোনায় তামাবিলের কাছাকাছি দুই-তিন কিলোমিটার অতিক্রম করতে আরও লাগল বাড়তি আধঘণ্টা। ট্রাকের ফাঁক গলিয়ে, গা বাঁচিয়ে বাংলাদেশের কাস্টমস ও পুলিশ চেকপোস্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারতীয় প্রান্তে ডাউকি চেকপোস্ট। ডাউকি থেকে শুরু হয় ওপরে ওঠার পালা। ডাউকি বাজার পেরিয়ে শতবর্ষী ঝুলন্ত ব্রিজ। দুটি লোহার তারের দড়ি দুই প্রান্তের পাহাড়ের রহস্যময় সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে গেছে। সেই দড়ির সঙ্গে ঝুলে আছে ব্রিজটি। নিচে নীলচোখা সারি নদী। ডাউকি চেক পোস্টের কাজ শেষে ট্যাক্সি ধরে ওপরের দিকে উঠতে হবে। গ্রুপের ছেলেরা ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে সিন্ডিকেট বিপত্তিতে পরে দেরী হয়ে গেল আরও খানিকটা। ততক্ষণে প্রায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেছে সবার, বিশেষ করে স্যারের। তার প্রবল প্রকাশ ঘটল যখন ডাউকি থেকে পাহাড়ি পথে আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত শতশত ট্রাকের ভিড়ে আটকা পড়তে হলো। মুক্তি মিলল ঘণ্টাদেড়েক পর। যতো ওপরে ওঠা ততো মেঘের রাশি জাপটে ধরল আলিঙ্গনে। গরম থেকে ঠান্ডা। ঠান্ডা থেকে আরও ঠান্ডা। রাশি রাশি মেঘে ঢেকে আছে সবুজ মাঠ, ধুসর পাহাড়, দূর দিগন্ত। শহর মাঠ বন পাহাড় সব ছেড়ে আকাশের নিচে ঝুলে ছুটে চলা মেঘের দেশে। এ যেন অন্য এক ভুবন, মেঘরাজ্য, মেঘালয়, মেঘবালিকার রূপকথার কোন দেশ। প্রকৃতির তুলিতে পেঁজা তুলোর রং নিয়ে কে এঁকে দিয়েছে নিখুঁত এই চিত্রপট? ক্ষুধার রাজ্য পৃথিবী পদ্যময় হয়ে উঠলো যেন। তৃষ্ণা ভুলে চেয়ে আছি মেঘের দিকে। আওড়াতে লাগলাম বোদলেয়ার- ‘আমি ভালোবাসি মেঘ... চলিষ্ণু মেঘ... ঐ উঁচুতে... ঐ উঁচুতে... আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল।’

গাড়ি ছুটছে আঁকাবাঁকা পথ ধরে ওপর থেকে আরও ওপরে। কখনও আবার ঘুরে ঘুরে নিচে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে ডানে-বাঁয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ফুট গভীর খাঁদ। হাড় হিম করা ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য। তাকাতে না চাইলেও বারবার চোখ ফিরে যায় সেই অতল গভীরে, যেখানে শুধুই গাঢ় নীল ছায়া। গা গুলানো মোচড় দিয়ে গাড়ি আবার উঠছে ওপরে। ভাসমান মেঘ ছুঁয়ে যায় পাহাড়ের গা। শাল-সেগুনের বদলে একটু পরপর পাইন-ফার-বিচ-বার্চ-সুপারি আর ওক। ‘গাছগুলো যেন আকাশ থেকে ছুড়ে দেওয়া ঈশ্বেরর তীর’। উষ্ণতার জায়গা নিয়েছে শীতল হাওয়া। শীতবস্ত্র গায়ে চাপানো হয়েছে আগেই। চলতি গাড়ির ভেতর তবুও যেন খোঁচা মারছে ঠাণ্ডা বাতাসের তীর। পাহাড়ে দুপুর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে নরম শিশুর মতো মেঘের কোলে। কে জানে, কোথায় কোন পাহাড়ের আড়ালে সূর্যটা ঢাকা পড়ে ভর দুপুরে অন্ধকার এনে দিতে চাইলো। ঘণ্টাখানেক পরই শিলং। দূর থেকে  শিলং শহর দেখা যাচ্ছে যেন আকাশের নিচে আরেকটি আকাশ।

স্বাগতম-এর বদলে শহরে ঢোকার রাস্তায় কুবলাই (খাসিয়া ভাষা)। শিলং যে গগণচারী দূরের বিদেশ নয় মোটেই, তা পৌঁছে বুঝতে পারলাম। রাজ্যের নাম মেঘালয়। নামেই যার পরিচয়- মেঘের বসতি যেথা। একদিকে সুরমা অববাহিকা, অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র। মাঝখানে এই খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় নিয়ে ক্ষুদ্র রাজ্য মেঘালয়। সিলেটের তামাবিল থেকে মাত্র ঘণ্টা দুই আড়াইয়ের রাস্তা। ডাউকি থেকে শিলং ৮০ কিমি। তামাবিলের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৫০ কিমি। আর শিলং ৫ হাজার থেকে ৬৫০০ কিমি (শিলং পিক)। যাবতীয় রহস্য আর রোমাঞ্চ সেখানেই। সমতল থেকে আকাশ যাত্রা। ছোট একটি লোকবসতি থেকে ইংরেজদের হাতে শিলং শহরের গোড়াপত্তন ১৮৬৪ সালে।  খাসি অ্যান্ড জৈন্তা হিলসের জেলা সদর হিসেবে। খাসিয়াদের নিজ রাজ্য মেঘালয়। তবে জয়ন্তিয়া, গারো, কোচ, হাজং ও কুকিদেরও বাস এ রাজ্যে। একসময় শিলং শহরে বাঙালিদের আধিক্য ছিল। এখন তেমনটি না হলেও লাবান, রিলবং, জেল রোড, লাইমুখড়া, রেঞ্জা প্রভৃতি এলাকায় সিলেটি বাঙালিদের প্রাধান্য। ক্যাথলিক, চার্চ, চ্যাপেল, কনভেন্ট স্কুলের পাশাপাশি ভাষার ক্ষেত্রে খাসিয়া, অহমীয়, হিন্দি, নেপালী, বাংলা (কিছু ক্ষেত্রে সিলেটের আঞ্চলিক), ইংরেজি। অফিসিয়াল ভাষা যদিও ইংরেজি।

স্যার থাকার নিবাস খুঁজে বের করলেন। হিল স্টার হোটেল। শিলং পৌঁছে সাইফুল ভাইয়ের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা দুশ্চিন্তার কবলে পড়লেও জুলকার নাইনের কৌতুকে তা মিইয়ে গেল নিমিষেই। আজ আর কোথাও না। টাটা সমু গাড়ি ও জিপ ঠিক করা হয়ে গেল সন্ধ্যার আগেই। ড্রাইভার বাহাদুর থাপাই থাকবে আমাদের টুরিস্ট গাইড। ছেলে-মেয়েদের সীমানার মাঝখানের কমন রুম আমাদের ‘পরি-কল্পনা ঘর’-এ  প্রথম দিনের সফরসূচী ঠিক করা হলো এভাবে- ক্রিনোলাইন ফলস, মলিংটং গ্রাম, লেডি হাইডি পার্ক, হায়দারী পার্ক, ওয়ার্ডাস লেক, ক্যাথিড্রাল (ডন বসকো), এ্যালিফ্যান্ট ফলস, পুলিশ বাজার, লায়লংকট, বিলিয়াম, পাইনর্সুলা। দ্বিতীয় দিন- মগটক (ডেম্প শোয়েরা), চেরাপুঞ্জী, ইকো পার্ক, মসমাই ফলস, মসমাই ক্যাব, চেরা বাজার, মসমাই গুহা, সেভেন সিষ্টার, নোহকালিকাই ফলস, রামকৃষ্ণ মিশন, থেঙ্গখারাঙ্গ পার্ক। তৃতীয় দিন- শিলং পিক, বড় পানি (বড়া উমিয়াম), হয়ে গৌহাটি। পাইনবন তো আছেই। (চলবে)


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়