ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

আয়ারল্যান্ডের ভিসা পাওয়া এতো সহজ! পর্ব ৩

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৬, ৮ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আয়ারল্যান্ডের ভিসা পাওয়া এতো সহজ! পর্ব ৩

দিল্লিতে আয়ারল্যান্ড দূতাবাসের সামনের পার্কে লেখকের সেলফি

উদয় হাকিম, ডাবলিন (আয়ারল্যান্ড) থেকে ফিরে : ভেবেছিলাম ৯ মে ভিসার কাগজপত্র জমা দেব। দশ এগারো তারিখের মধ্যে আয়ারল্যান্ডের ভিসা পেয়ে যাব। ১২ তারিখ সকালে রওনা হলেও খেলা শেষে প্রেজেন্টেশন সেরিমনি ধরতে পারবো। কিন্তু কাগজই জমা দিতে পারলাম না। ভিসা কেমনে পাবো? কবে পাবো? আদৌ পাবো কি?

দিল্লির লা মেরিডিয়ান হোটেলটা বেশ গোছানো। প্রচুর বোর্ডার। দূতাবাস এলাকা চানক্যপুরীর সবচেয়ে কাছের হোটেল। জনপথ রোডে। দশতলায় হোটেল কক্ষে গিয়ে ডাক্তার ইকবাল জিজ্ঞেস করলেন, রুম পছন্দ হয়েছে? হোটেলের নাম-ডাক-ব্র্যান্ডভ্যালুর তুলনায় রুম ছোটো। তবু ডাক্তারকে বললাম, হ্যাঁ হয়েছে। ডাক্তার পূব পাশের জানালা খুলে দিলেন। নিচে একটা গোল চক্কর। এদিকটায় গাছগাছড়া আছে ভালোই।

ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। ডাক্তার ইকবাল বললেন, চলেন বের হই। কোথায় যাব? আমিতো দিল্লির কিছু চিনি না। নো প্রবলেম। আমি চিনি। চলেন আগে কিছু খেতে হবে তো। কোথায় যাবো? নিজামুদ্দিনের মাজারে। ওখানে কেন? আশেপাশে খাবার হোটেল নেই। ওখানেই যেতে হবে। ওকে, বাট কোন নিজামুদ্দিন? নিজামুদ্দিন আউলিয়া? ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, বড় পীর। আপনি ডাক্তার হয়েও পীরের মাজারে যাবেন! ডাক্তার মুচকি হাসেন, আগেও গিয়েছি। চলেন আবার যাই। ওখানকার খাবার খুব মজার। সন্ধ্যায় আর কি করবেন। একটু ঘুরে টুরে আসি চলেন।

বের হলাম। একটা অটোরিকশা নিলাম। দিল্লির রাস্তায় অটোরিকশা চলে অনেক। আমাদের দেশের সিএনজি চালিত অটোরিকশার মতো। কিন্তু ওগুলো চলে ডিজেলে। আধা ঘণ্টার মধ্যে মাজার এলাকায় চলে গেলাম। শত শত মানুষের ভিড়ে পথ চলাই মুশকিল! মাজারের মূল ভবনের অনেক আগে থেকেই বেজায় ভিড়। এই ভিড় ঠেলে ভেতরে যাওয়া আমার ভালো লাগেনা। সুস্থ্য মানুষের এসব রাস্তায় চলা দুষ্কর। ডাক্তার যাচ্ছিলেন তো যাচ্ছিলেনই। কখনো হারিয়ে যাচ্ছিলেন, দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন।

এই উপমহাদেশেই এটা সম্ভব। মাজারগুলো দুনিয়ার লোকে ভরা। কিলবিল করা মানুষ। বেশিরভাগই হুজুগে! পৃথিবীর আর কোথাও এরকম মানুষ দেখা যায় না। অলি গলি, এঁেদা-পঁচা নোংরা পথঘাট মাড়িয়ে সামনে যাচ্ছিলেন তিনি। দুপাশের স্থাপনা বা বিল্ডিংগুলো আমাদের পুরনো ঢাকার মতো। গরিব এলাকার সব ছাপ রয়েছে দোকান পাটগুলোতে। কোথাও বসার এক চিলতে জায়গা নেই। গলি ঘুপচির মধ্যে একটা সংকীর্ণ রেস্টুরেন্টের দুতলায় উঠে গেলেন। অনেক কষ্টে গা বাঁচিয়ে উঠতে হলো। নোংরা ঘাম আর খাবারের উচ্ছিষ্ঠ জড়ানো গায়ে হোটেলের কর্মচারিরা ঝুঁকিপূর্ণ চাপা সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করছিলেন।

খাবারটা সত্যিই সুস্বাদু। রুটি মাংস খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই সন্ধ্যা নেমে এলো। মূল মাজার ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন, ভেতরে যাবেন? জুতা খুলে যেতে হবে। আমি আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। জুতা খুলে, মোবাইল ফোন রেখে যেখানে যেতে হয় সেগুলোতে বরাবরই আমার অনাগ্রহ।

পাশেই মির্জা গালিবের মাজার, লাইব্রেরি। ততক্ষণে লাইব্রেরি বন্ধ। মাজারের বাইরে দাঁড়ালাম। ডাক্তার ইকবাল লাইব্রেরির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন। তুলে দিলেন আমারও। অনেক গরম। টিকতে পারছিলাম না। বাইরে গিয়ে একটা স্কুটার নিয়ে চলে এলাম হোটেলে।

 


মির্জা গালিবের লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার ইকবাল কবির

 

ভাবনা জুড়ে কেবল ভিসা। মনে হচ্ছে না, ভিসা হবে। তাহলে কি করবো? ঢাকায় চলে যাবো। নাকি কয়েক দিন দিল্লিতে ঘুরবো। ভিসা না হলে লজ্জাও বটে। পাসপোর্টে এতো দেশের ভিসা আছে- তারপরও আয়ারল্যান্ড ভিসা দিলো না! একথা বলব কীভাবে। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, ওরা যদি অ্যাম্বাসিতে ঢুকতে না দেয় কিংবা শেষমেষ ভিসা না দেয় তাহলে ফরিদ ভাইয়ের কাছে চলে যাবেন। ফরিদ ভাই নিজে অথবা হাই কমিশনারকে দিয়ে কিছু করতে পারেন কি না- চেষ্টা করবেন।
সবই কেমন কঠিন আর অসম্ভব মনে হচ্ছিলো।

সকাল দশটার মধ্যে আয়ারল্যান্ড অ্যাম্বাসিতে চলে গেলাম। দুর্গের মতো অ্যাম্বাসি বিল্ডিং। আমার কাছে সেটা আরো দুর্ভেদ্য মনে হচ্ছিলো। দূতাবাস ভবনের বিপরীতে পার্কের নিচু দেয়ালে একটা কাঠবিড়ালি। দূর থেকে ভ্রুকুটি কাটছিলো আমার দিকে। ও বোধ হয় বুঝে গেছে- যতই ঘোরো চান্দু ভিসা পাবে না। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কাঠবিড়ালির ছবি তুললাম। বেশ ভাব আছে মনে হলো। কই ভয় পাবে নতুন এক বাঙালিকে দেখে, তা না! বেশ ডাটের সঙ্গে পোঁজ দিলো।

চৌকির দিকে গেলাম। আগের দিনের সেই লোকটিই ভেতরে বসে ছিলেন। হাই, হাও আর ইউ, বলে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। বছর দুয়েক গড়িয়ে গেছে এরই মধ্যে, নোটবুকটাও পাচ্ছি না। তাই লোকটার নাম মনে নেই। ধরে নিলাম নাম তার অজয়। বাড়ি ধর্মশালায়। অরুনাচল প্রদেশ রাজ্যে রাজধানী। অনেকেই আমরা ইন্ডিয়ার সেভেন সিস্টারের কথা বলি। অরুণাচল প্রদেশ তাদের একটি। চীন সীমান্ত ঘেঁষা ভারতের উত্তর পূর্ব কোণে এক কুঠুরিতে এর অবস্থান। অদ্ভূত সুন্দর এই অরুনাচল প্রদেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এর তুলনা হয় না। স্কুল জীবনে এক ক্লাসমেট ছিলো আমার। নাম তার অরুণা। অরুণাচল নামটা মাথায় আসলেই অরুনার কথা মনে পড়ে। ভালো লাগতো মেয়েটাকে।

যাহোক, ঠিক তার কিছু দিন আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক পর্বে বাংলাদেশ খেলতে গিয়েছিলো অরুণাচলে। ধর্মশালা স্টেডিয়াম খুব সুন্দর। ওই অজয়ের বাড়ি ধর্মশালায়। কিছুটা খাতির জমানোর চেষ্টা করলাম। বললাম, তোমাকে আয়ারল্যান্ডের লোক ভেবেছিলাম। অনেক লম্বা চওড়া তুমি। ফরসা, চেহারাও আইরিশদের মতো। অনেক হ্যান্ডসাম তুমি। ‘থ্যাংক ইউ’ বলে মৃদু হাসলো। বললাম, তুমি ভাই বলো কীভাবে আমি দ্রুত ভিসা পেতে পারি। একটু বোঝার চেষ্টা করো, আয়ারল্যান্ডে খেলা; সেখানে টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশের একটা কোম্পানি। এটা আয়ারল্যান্ডেরই লাভ। ওই খেলার প্রেজেন্টেশন সেরিমনিতে থাকতে হবে আমাকে। ১২ তারিখে প্রথম ম্যাচ। আজ নয় তারিখ। সময় নেই। তুমি একটু হেল্প করো।

অজয় আবারো মুচকি হাসলো। বললো, কিচ্ছু করার নেই। বাংলাদেশের নাগরিকদের কলকাতায় কাগজ জমা দিতে হয়। ক্যুরিয়ারে সেটা সরাসরি দূতাবাসে আসবে। তারপর প্রসেসিং। কতদিন লাগবে তার ঠিক নেই।

তাহলে কি আমি আয়ারল্যান্ড যেতে পারব না?

সেটা আমি কি বলবো, অজয়ের উত্তর। তবে আরেকটা উপায় আছে। কি? আমি উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে ছিলাম অজয়ের মুখের দিকে। দিল্লিতে ডিএইচএল সেন্টার থেকে কাগজ পোস্ট করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সময় কিছুটা কম লাগবে।

 


পার্কের কাঠবিড়ালি তাকিয়ে ছিলো আড়চোখে

 

কিন্তু আমি জানি, এই আবেদন হাতছাড়া হওয়া মানেই ভিসা অনিশ্চিত। যা করার এখান থেকেই করতে হবে। না হলে নাই। অনুরোধ করলাম অজয়কে, আমাকে একটু ভেতরে যেতে দাও। বুঝতেই পারছো, বিষয়টা জরুরি। আমি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলব। না হলেও অন্য যে কারো সাথে কথা বলতে দাও।

অজয়ের উত্তর- ইমপসিবল। কেন? এখানে কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে আগে থেকে অ্যাপয়নমেন্ট থাকতে হবে। সে কি কথা! জরুরি বলে তো একটা কথা আছে। নিশ্চয়ই ইমার্জেন্সির জন্য কোনো ব্যবস্থা আছে? নেই। মুখ শক্ত করে অজয়ের উত্তর। এতোক্ষণ লোকটাকে ভালোই মনে হচ্ছিলো। কিছুটা হাসি খুশি। এখন বুঝলাম, ভালোই হারামি। মনে হচ্ছিলো, লোক ভেতরে যাতে যেতে না পারে সেজন্যই তাকে রাখা হয়েছে। অন্য কোনো কাজ নেই তার। আবারো অনুরোধ করলাম, ভাই প্লিজ আমাকে ভেতরে যেতে দাও। আমি ওদের বলে কয়ে যা পারি করে নেবো। আমার কাছে সব কাগজই আছে। বিষয়টাও জরুরি। অজয়ের একই কথা, নট পসিবল। বললাম, তুমি ভেতরে সংশ্লিষ্ট কাউকে ফোন করে বলো আমার কথা। অজয়ের একই উত্তর, নট পসিবল।

কি আর করা। পাশের ছোট পার্কে গিয়ে বসলাম। খানিকটা জঙ্গলের ভেতর থেকে সেই কাঠবিড়ালি আমার দিকে তাকিয়ে। মনে হচ্ছিলো আমার অসহায় অবস্থা নিয়ে তামাশা করছিলো।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ জুন ২০১৯/উদয় হাকিম/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়