ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

আয়ারল্যান্ডের আকাশে মায়া ছড়াচ্ছিলো সোনারঙা ফুল

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৭, ২০ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আয়ারল্যান্ডের আকাশে মায়া ছড়াচ্ছিলো সোনারঙা ফুল

উদয় হাকিম, ডাবলিন (আয়ারল্যান্ড) থেকে ফিরে : ভোর ছ’টায় ফ্লাইট। চানক্যপুরীর পাশের জনপথ রোডে লা মেরিডিয়ান হোটেল। সেখান থেকে শেষ রাতে মিনিমাম আধা ঘন্টা লাগবে এয়ারপোর্টে যেতে। তার মানে শার্প সাড়ে তিনটায় রওনা হতে হবে। ৪ টার মধ্যে দিল্লী এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে। গন্তব্য আয়ারল্যান্ড।

ভয় হচ্ছিলো, ঘুমিয়ে গেলে যদি জাগতে না পারি। তাহলে কি করব? মোবাইল ফোনে এলার্ম দিয়ে রাখলাম। তিনটায় ঘুম থেকে উঠতে হবে। আমার একটা অভ্যাস আছে। কোথাও রওনা হলে গোসল করে যেতে হবে। আধা ঘন্টা প্রস্তুতির জন্য লাগবেই।

চিন্তায় ঘুম হচ্ছিলো না। ওদিকে রুমমেট ডাক্তার ইকবালও ঘুমুচ্ছিলেন না। আমাকে বাই বলে উনি ঘুমাবেন। ভালো কথা। রাত একটা বেজে গিয়েছিলো তখন। কি করব? বললেন, গল্প করে কাটিয়ে দিই।

কথায় বলে ঘোড়া দেখলে খোঁড়া রোগ হয়! ডাক্তার দেখলেও নানা রোগের কথা মনে পড়ে। জিজ্ঞেস করলাম, গলায় খাবার আটকে যাবার একটা ভয় ছিলো আমার দীর্ঘদিন। এখনো মাঝে মাঝে হয়। ডাক্তারি ভাষায় এ সম্পর্কে কি কয়?

বললেন, এটাকে বলে চক বা চকিং। গলায় খাবার বা পানীয় আটকে যেতে পারে। হয়তো উপরে নিচে কোন দিকেই খাবার বা পানীয় যাচ্ছে না। খাব কি খাব না, এরকম দু’টানা থেকে হতে পারে। দুই দিকের বাতাসের চাপেও হতে পারে।

কিছুদিন আগে একটা টেলিভিশনে চাকুরীর জন্য এক সাংবাদিক এসেছিলেন আমার কাছে, সুপারিশের অনুরোধ নিয়ে। তার দাঁড়ি দেখে সন্দেহ হচ্ছিলো! জঙ্গী কি না। ছেলেটি বলছিলো তার একটা সমস্যা আছে। গলায় খাবার আটকে যাবার ভয় কাজ করে। কখন মরে যাই ঠিক নাই। তাই ধর্ম মেনে দাঁড়ি রাখি।

ফ্ল্যাশ ব্যাকে পেছনে চলে গেলাম। তখন আমি ঢাকা কলেজে ইন্টারে পড়ি। হঠাৎ এক দুপুরে ডাইনিং এ খেতে গিয়ে মনে হচ্ছিলো খাবার গলায় আটকে যাবে। ঢোক গিলে প্রেসার দিয়ে খাবার ভেতরে নিতে সাহস পাচ্ছিলাম না। শহীদ নামে এক বন্ধু ছিলো। পরে সে আমাকে নিয়ে গেলো ঢাকা মেডিকেলে। এতো ভয় পাচ্ছিলাম যে ঢোক গিলতেও সাহস হচ্ছিলো না। সেদিন ঢাকা মেডিকেলের আউটডোর বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ফিরে গিয়েছিলাম। ভয় নিয়ে অনেকদিন ছিলাম। আস্তে আস্তে ভয় কেটে গিয়েছিলো।

 

শহীদের কথা মনে পড়ে কষ্ট বাড়লো। খুব মেধাবী ছাত্র ছিলো। সুলিমুল্লাহ মেডিকেল থেকে ডাক্তারি পাশ করে পিজি হাসপাতালে চাকরী নিয়েছিলো, সাজার্রি বিভাগে। কঠিন এক চর্মরোগ হলো তার। শরীর শুকিয়ে গেলো। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিলো। লাভ হলো না। চলে গেলো পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। মৃত্যুর কিছুদিন পর ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু হায়, মানুষের মৃত্যুর পর তার নিকটাত্মীয়রাও সব ভুলে যায়!

ঢাকা কলেজে আমার আরেক ক্লাসমেট ছিলো শাহীন। জামালপুরে বাড়ি। ডেন্টাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করলো। ডেন্টালের একটা জুনিয়র মেয়েকে বিয়েও করেছিলো। এর ছয় মাসের মাথায় কঠিন এক রোগে সে-ও মারা গেলো। সব মৃত্যুই বেদনাদায়ক। কিন্তু অল্প বয়সী মৃত্যুগুলো একেবারেই মেনে নেয়া যায় না।

এরপর প্রতি বছর শীতে আমার চকিং সমস্যা হতো। ভাত খেতে গেলে মনে হতো গলায় আটকে যাবে। দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। পরে বুঝলাম এটা মানসিক সমস্যা। ধীরে ধীরে আমি রিকভার করেছি। এখন আর সে সমস্যা নেই।

সাংবাদিক মামুনকেও বললাম, এটা মানসিক সমস্যা। জাস্ট ভুলে যান এটার কথা, আর ভালো থাকুন। মফস্বলের ছেলে বলে কি না, তার সাহস খুব কম। দেখলাম সেই দাঁড়িটা এখনো আছে।

চকিং নিয়ে কথা বলতে বলতে রাত তিনটে বেজে গিয়েছিলো। কথা হচ্ছিলো আমাদের কমন কর্মস্থল দৈনিক প্রথম আলো নিয়েও।

গোসল সেরে নিয়েছিলাম। ঠিক সাড়ে তিনটায় হোটেল লবিতে গিয়ে হাজির। গাড়িও রেডি। ডাক্তার ইকবালের সঙ্গে কোলাকুলি করে গাড়িতে উঠলাম। দেখছিলাম রাতের দিল্লী। কি মায়াময় রাত! প্রকৃতি রাতকেও অঢেল সৌন্দর্য দিয়ে রেখেছে।

এয়ারপোর্টের সব ফর্মালিটিজ শেষ। বোর্ডিং এ ফাইনাল কল চলছিলো। ভাবছিলাম শেষের দিকে উঠি। হঠাৎ এয়ারপোর্টের সাউন্ড সিস্টেমে আমার নাম এ্যানাউন্স হচ্ছিলো। ঘটনা কি! সমস্যা কোথায়! আমার নাম বলার মতো কিছু তো হবার কথা না। বোর্ডিং এক্সিকিউটিভদের সঙ্গে কথা বলতে বলছিলো। কমবয়সী জেট এয়ারের এক এক্সিকিউটিভকে বললাম, আমার নাম এ্যানাউন্স করছে কেন? ছেলেটা নির্বিকার হয়ে বললো, অয়েট করেন। তার মানে এরকমটা ওখানে প্রায়ই হয়। সিরিয়াস কিছু নয়। ফ্লাইট যদি ছেড়ে দেয়- ছিলো সে ভয়। কিছুক্ষণ পর আরো তিনজন জুটলো। চারজন গেলাম রিমান্ডে। সেখানে আরো কিছু লোক ছিলো। এক চীনা ভদ্রলোকও ছিলো।

 

এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি অফিসাররা একটা ব্যাগ দেখিয়ে বললো, এটা আপনার? ইয়েস। ভেতরে পাওয়ার ব্যাংক আছে? ইয়েস। ব্যাগ খুলতে হবে। খুলে দিলাম। পাওয়ার ব্যাংক বের করলো। যে ছেলেটি বোর্ডিং এরিয়া থেকে আমাকে সেখানে নিয়ে গেলো, সে-ই পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে নিলো। বললাম, ব্যাংকটা দেন। হ্যান্ড লাগজে নিচ্ছি। দিলো না। মন খারাপ হলো। সুন্দর জিনিস, অনেক দাম দিয়ে কেনা। এরকম কতজনেরটা যে ওরা নিয়ে নিচ্ছে! কাজটা কতটা যৌক্তিক? কিছুটা কষ্ট পেলাম।

আমরা উঠার পর পরই ফ্লাইট ছেড়ে দিলো। প্রথমে ইস্তান্বুল, তুরস্কের রাজধানী। এরপর সেখান থেকে ডাবলিন। এর আগেও ইস্তান্বুল হয়ে লন্ডন এবং চেক রিপাবলিকে গিয়েছি। ইস্তান্বুল এয়ারপোর্ট অনেকটা চিড়িয়াখানার মতো মনে হয়। দুনিয়ার সব রকমের চিড়িয়ার দেখা মেলে সেখানে। উইরোপের গেটওয়ে বলা হয় একে। বিশেষ করে আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিমান যোগাযোগ অনেকটাই ইস্তান্বুল কেন্দ্রিক। বারো রকমের মানুষ আর ৫২ রকমের কীর্তিকাহিনী সেখানে।

সকাল বেলা। আকাশ ছিলো পরিষ্কার। তুরস্কের কাছাকাছি ভূমিরূপটা খুব বিচিত্র। পাহাড়, সমুদ্র, নদী, জলাভূমি, বিস্তীর্ণ মাঠ সবই দেখা যাচ্ছিলো বিমান থেকে। বিশেষ করে এয়ারপোর্টের আগে রয়েছে বিশাল কৃষ্ণ সাগর। ইংরেজিতে যাকে বলে ব্ল্যাক সি। বিমান থেকে জল অনেকটা কালোই দেখায়। কালো নীলের জলতরঙ্গ। পানির সামান্য উপর দিয়ে অনেকটা পথ যেতে হয় ফ্লাইটে। এটা অসাধারন একটা অভিজ্ঞতা। নিচ দিয়ে নৌকা, জাহাজ, স্পিডবোট চলছিলো। পাশেই শহরের উঁচু দালান কোঠা। বলা চলে আকাশ থেকেই তুরষ্ক দেখা হয়ে যাচ্ছিলো। এয়ারপোর্টের আগে একটা বড় নদী ঢুকে গেছে শহরের ভেতরে। যেটি শহরকে দুভাগ করে রেখেছে। সুউচ্চ ঝুলন্ত সেতু দিয়ে গাড়ি পার হচ্ছিলো।

ঘন্টাখানেকের বিরতি ছিলো সেখানে। ফ্লাইটের ভেতরই ছিলাম। কিছু যাত্রী নামলো। কিছু উঠলো। ঘন্টাখানেক পর আবার ফ্লাই অফ। ইস্তান্বুল থেকে সরাসরি ডাবলিন, দক্ষিন আয়ারল্যান্ডের রাজধানী।

ইস্তানবুল থেকে ডাবলিন যেতে সময় লাগছিলো সাড়ে চার ঘন্টা। এক সময় আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্যের সঙ্গেই ছিলো। এখন দক্ষিন আয়ারল্যান্ড আলাদা। আর উত্তর আয়ারল্যান্ড এখনো যুক্তরাজ্যের সঙ্গেই। যুক্তরাজ্যের ঠিক পশ্চিমে আয়ারল্যান্ড। মাঝখানে বিশাল সাগর। যার নাম আইরিশ সি। শুনলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামি ফেরি চলে উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের মধ্যে। স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের একটি বিশাল রাজ্য। সৌন্দর্যের জন্য যার খ্যাতি জগৎজোড়া।

ডাবলিন এয়ারপোর্টও সাগর তীরের কাছেই। বিমান উঠার সময় তাড়াতাড়ি উঠে যায়। ল্যান্ডিংয়ের সময় অনেক দূর থেকে নিচ দিয়ে চলতে থাকে। জানালার পাশে বসলে পাখির চোখে সব দেখা হয়ে যায়।

দেখছিলাম ডাবলিনের রূপ। জলাশয় শেষেই অনিন্দ্য সুন্দর ভ্যালি- উপত্যকা। অপরূপা আয়ারল্যান্ড। ভেবেছিলাম সবুজ মানেই বাংলাদেশ; বাংলাদেশের মতো এতো সবুজ আর কোথাও নেই। অথচ ডাবলিনের সবুজ আমার চোখ ঝলসে দিচ্ছিলো। বাতাস বইছিলো। দোল খাচ্ছিলো গাছ গাছালি, লম্বা ঘাস, লতা-পাতা। সবুজ মখমলে মোড়ানো মাঠ। ক্ষেতের আ’লে ফুলের গাছ। নানা রঙা ফুল। হলদে ফুলই বেশি। সোনারঙা ফুল নিকটবর্তী আকাশে মায়া ছড়াচ্ছিলো। সে মায়ায় বিমোহিত হচ্ছিলাম। একেকটা গাছের পাতা একেক রকম, বিচিত্র! বর্নিল! ফ্লাইট থেকে দেখছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এ তো মাঠ নয়, সাধারণ ভূমি নয়; রীতিমতো ফুলের বাগান, স্বর্গোদ্যান।

 





 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুলাই ২০১৯/উদয় হাকিম

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়