ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

শেষ রাতে আদম পাহাড়ের চূড়া...

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৮, ৩ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শেষ রাতে আদম পাহাড়ের চূড়া...

অ‌্যাডামস পিকে উঠব, তাই বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কার গহীন অরণ্যে আমরা। এত উঁচু পাহাড়ে উঠতে পারবে না, এই ভয়ে কিছুদূর গিয়ে ক্ষান্ত দিল সাংবাদিক ইমন।  রাতের আঁধারে তাকে একা রেখে সামনে এগোচ্ছিলাম।

এতক্ষন রাস্তা খুব একটা কঠিন ছিল না। পাহাড়ি পথ, উঁচু নিচু এই।  ইমনকে যে মন্দিরে রেখে আসলাম, সেটি মনে হলো এক রকমের বেস ক্যাম্প। অ‌্যাডামস পিকে উঠার প্রথম বেস ক্যাম্প ধরা যায় ওটাকে। ইমনকে রেখে আসার পর থেকেই শুরু হলো আসল চ্যালেঞ্জ।  কয়েক মিনিট হাঁটার পরই শুরু হলো খাঁড়া পথ। অন্ধকারে বোঝাও যাচ্ছিল না কতটা খাঁড়া। কতক্ষণ উঠতে হবে সেটাও ঠাহর করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর হাঁপিয়ে উঠলাম। কোথায় যাচ্ছিলাম? অসীম অজানা গন্তব্যে ছুটছিলাম যেন।  কতদূর, কতক্ষণ এভাবে উঠতে হবে জানতাম না।

সত্যি বলতে কি, ওই খাড়া পাহাড় উঠতে গিয়ে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। ইমনতো চলে গেল, আমি কি করব? ইমন যেখানে রয়ে গেল সেখানে বসার জায়গা ছিল, ঘুমানোও যেত; আলো ছিল। কিন্তু আমি এখন যেখানে, সেখানে আলো নেই। বসার জায়গা নেই। আবার ওই বিজন বনে ভয় আছে নানা রকমের। বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে হলেও যেতে হবে। বসে থাকাও নিরাপদ নয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করলাম।

আদম পাহাড়ে উঠা বেশ কষ্টসাধ্য। তারপরও জায়গাটি মানুষকে আকৃষ্ট করে।  আদমের পায়ের ছাপ দেখতে, অথবা পৃথিবীর প্রথম মানবের আগমন হয়েছিল যে স্থানে- তা দেখতে সেখানে ছুটে যান সবাই।

পা চালাচ্ছিলাম। অনেক দূর যেতে হবে।  সামনে মনে হলো অনেক উচুঁ এবং খাড়া পাহাড়।  সেটার উপরে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। জায়গাটা তুলনামূলক বেশি অন্ধকার। গাছের ছায়ায় নিবিড় আঁধার। কল কল জলের শব্দ তুলনামূলক প্রবল। অনুমান করছিলাম পাশেই বড় আকারের ঝরনা। ডান পাশটাতে খাঁদ। পূবদিক থেকে এতক্ষণ পশ্চিমে যাচ্ছিলাম। পাহাড়টা পেরোনোর জন্য খানকিটা দক্ষিণে মোড় নিয়েছিল রাস্তা।

আবারো রাস্তাটা দুদিকে উঠে গেছে।  কোনদিকে যাব? ভুল রাস্তায় গিয়ে কোথায় যাব? আবার ফিরে আসতে হবে কি না? মিলটনকে বললাম সামনে টর্চের আলো ফেলতে। তাতেও বোঝা যাচ্ছিল না। তবে মনে হলো দুটি রাস্তাই একসঙ্গে মিশেছে উপরে গিয়ে।  ডানের রাস্তাটা বেশি খাঁড়া ছিল। তবে পথ কিছুটা কম হতে পারে ভেবে সেদিকেই যাচ্ছিলাম। আমাকে দেখে ফিরোজ এবং মিলটন তারাও ডানেই চললো। এত কষ্ট পাহাড় বাওয়া! বাপরে বাপ!

লন্ডনের এক সিনিয়র ফ্রেন্ড আছে আমার। তার নাম লেন মিলার। প্রায়ই বাংলাদেশে বেড়াতে আসে। এরই মধ্যে বেশকিছু বাংলা শব্দ শিখে ফেলেছে সে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ওই কথাটা- বাপরে বাপ! বিদেশিদের মুখে কথাটা সত্যিই ভারি সুন্দর শোনায়।

উপরে নিচে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। অনুমান করছিলাম অনেক দূর উঠে গিয়েছিলাম। খানিক বাদে আবার খাড়া পাহাড়।  সিমেন্টের বাঁধাই করা সিড়ি। পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে পায়ের শক্তি কমে আসছিল।

এরই মধ্যে বনভূমি কাঁপিয়ে বৃষ্টি আসছিল। সর্বনাশ। বৃষ্টি হলে পথ পিচ্ছিল হবে। ভিজতে হবে। রাতের বেলা জঙ্গলে বৃষ্টিতে ভেঁজা মানেই অসুখ বাধানো। কি যে ভুল করলাম। সন্ধ্যা বেলায় একটা রেইন কোট কিনলেই ভালো করতাম।  আশপাশে বড় গাছও ছিল না। ছিল না কোনো রকমের ছাউনি।  ছোট একটা গাছ ছিল। অনেকটা আমাদের দেশের বড়ই পাতার মতো পাতা। তার নিচে বসে পড়লাম। ভাগ্য ভালো। আশপাশ দিয়ে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাদের গায়ে কয়েকট ফোঁটা লাগিয়েই ‘জেন্টল জেশচার’ দিয়ে চলে গেল।

পথটাতে এমন শুনশান নীরবতা। যেন কোনো কালেই সেখানে কেউ যায়নি। আমরাই প্রথম যাত্রী। মনে পড়ল বিভূবিভূষণের কথা। তাঁর চাঁদের পাহাড়ের কথা।  চাঁদের পাহাড় উপন্যাসটা যারা পড়েছেন তাদের বলব ভাগ্যবান মানুষ। ওরকম একটি লেখা পড়া সবার ভাগ্যে জুটে না। যদিও কলকাতা থেকে ওই নামে একটি সিনেমা বানানো হয়েছে। সিনেমাতে আসল চাঁদের পাহাড়ের ছিঁটোফোঁটাও নেই। আফ্রিকার জঙ্গলে হিরের খনির সন্ধান, একজন মানুষের একাকী সংগ্রাম, রাতের নিস্তব্ধতা, নিখাঁদ প্রকৃতি, হাজারো প্রতিকূলতা- সবই ফুঁটে উঠেছে তাতে। মনে হচ্ছিল সেই শঙ্করের মতো আমরাও গহীন অরণ্যের গোলক ধাঁধাঁয় আটকে গেছি।

যেতে হবে অনেক দূর। শরীরে যতটা কুলোয় চেষ্টা করছিলাম। রাতের আঁধারে এসে ভালোই হয়েছে। দিনের আলোতে হাঁটলে বুঝতে পারতাম এতদূর যাওয়া সম্ভব না। ইমনের মতো ক্ষান্ত দিতাম। আঁধার অনেকটা আলেয়ার মতো। একটু একটু করে ভেতরে টানে। নিয়ে যায় অজানা কোথাও। গোলক ধাঁধায় আমরাও পড়লাম কি না!

হাঁপিয়ে উঠলাম আবারো। কয়েক গজ সামনেই মিলটন আর ফিরোজ। আমাকে বসতে দেখে তারাও কাছে এসে বসল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল কথাটা- আর পারছি না। ফিরোজ পেয়ে বসল- বলছিলাম না, দরকার নেই। এখন বুঝছেন তো মজা। চুপ করে রইলাম। মধ্যরাতের এমন বিজন পাহাড়ে যাওয়া আর কি কোনদিন ভাগ্যে জুটবে? যত কষ্টই হোক এর মূল্য আছে। অথবা মূল্য দিয়ে কেনা যায় না এই অনুভূতি। এই ফিরোজ আলমই একদিন বলেছিল, নাথিং গোস আনপেইড। মানে কোনো কিছুই বিফলে যায় না। আমি জানি, এই পাহাড়ে উঠার মূল্য কতটুকু আমার কাছে!

আমার মুখের উপর টর্চ লাইট ধরল ফিরোজ। মিলটনকে ডেকে বললেন, দেখেন, চোখের দিকে তাকান! কি হয়েছে। ভ্রু’র উপর কুয়াশা জমেছে। কুয়াশা নয়, মেঘ। আগের বিকেলে দেখেছিলাম এই পর্বতশ্রেণিকে ঘিরে অসংখ্য মেঘের আনাগোনা। বলা চলে ওটা মেঘের লীলাভূমি। তার মানে মেঘের ভেতর দিয়েই যাচ্ছিলাম আমরা।

আবার উঠলাম। হাঁটছিলাম। কিছুক্ষণ পর একটা রাস্তাটা বাঁয়ে বেকে গেল। ঠিক ওই বাঁকটার মধ্যেই একটা ক্যাপ, ছইওয়ালা। সিমেন্টের তৈরি রেলিংয়ের উপরে রাখা। মিলটন ফিরোজ দুজনেই দেখেছেন। মিলটন বললেন, নিয়ে নেন।  বৃষ্টি হলে কাজে লাগবে। সত্যিই তো। হাতে নিয়ে নিলাম। আবার বৃষ্টি হলে অন্তত মাথাটা বাঁচবে।

আরো কিছুদূর হাঁটার পর মনে হলো আকাশ ফরসা হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ হলে কিছুক্ষণ পরই আজান শুনতে পেতাম। শ্রীলঙ্কার আদম পাহাড়ের আশপাশে কোনো মসজিদের দেখা পাইনি। লোকালয় সে-ও অনেক দূর। চাঁদের পাহাড়ের শঙ্কর যেমন প্রহর গুনতো, রাত কখন শেষ হবে- সেরকম প্রহর গুনছিলাম আমরাও। সেই সঙ্গে পথ কখন শেষ হবে সেটাও ছিল আরাধ্য।

একটা বিষয় বলে রাখা ভালো। ইউটিউবে যেসব তথ্যচিত্র আমরা দেখি তার নির্মাতারা বেশির ভাগই অ‌্যাডামস পিকে উঠেন নাই। অন্যের ছবি মেরে দিয়ে বানানো অথবা খণ্ডিত অংশ দেখান। কেউ কেউ আর অনেক গাল গল্প দিয়ে ভিডিও বানায় দর্শক বাড়ানোর জন্য। কেউ কেউ বলে ওখানে নাকি তুষারপাত হয়! ডাহা মিথ্যা কথা। ঝড় হয়- এটাও ঠিক না। তবে বৃষ্টি হয়। শীত বাদে অন্য সময়গুলোতে অনেক বৃষ্টি হয়। পাহাড়ের ফাঁটল দিয়ে বের হওয়া জল আর বৃষ্টির পানি মিলিয়ে সারা বছর ঝরনাগুলো থাকে প্রবল উদ্দাম।

আকাশ ক্রমশ ফরসা হয়ে উঠছিল। টর্চ লাইট আর লাগছিল না। কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানি জমে ছিল। কোথাও শ্যাওলা পড়েছিল। গাছের ডাল-পাতা-লতা জমে ছিল। সব মাড়িয়ে যাচ্ছিলাম সামনে। ঠিক সামনে নয়, উপরে- আরো উপরে।

ভোর বেলা পা আর চলছিল না।  শরীর অবশ হয়ে উঠেছিল। গায়ে কোনো বল শক্তি নেই যেন। মাস দুয়েক হলো আমার পায়ে একটু সমস্যা। ফিজিও বলেছেন আথ্রাইটিস।  ডান পায়ের হাঁটুতে সমস্যা।  বেশি হাঁটলে পা ব্যথা করে। এই বয়সেও দাঁপিয়ে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলতাম। এখন বোধহয় আর পারব না।  সেই হাঁটুতেও সামান্য পেইন হচ্ছিল।

আকাশ মেঘে ঢাকা।  তা না হলে সূর্যের দেখা মিলতো। এই পাহাড় থেকে সূর্য উঠা দেখার জন্য উদগ্রীব থাকেন আগন্তুকরা। সূর্যের দেখা নেই। হয়তো মিলবেও না। নিচে যতদূর চোখ যায় কেবল ধুয়াশা। মেঘ আর মেঘ। যতই উপরে উঠছিলাম, ততই ঝরনার শব্দ পাচ্ছিলাম। তার মানে আদম পাহাড়ে উঠার পথে অসংখ্য ঝরনা।

বেশি দূরে নেই।  আর একটু পথ উঠলেই সেই পরম কাঙ্খিত অ‌্যাডামস পিক! আদম পাহাড়! দুজন লোক নিচে নামছিলেন। এরা স্থানীয় হবে মনে হলো। জিজ্ঞেস করলাম- পিক আর কত দূর। তারা জবাব দিলেন বেশি দূর না। উঠতে থাকেন। কিছু পর আরো তিন চারজন নামছিলেন।  জানালেন, তারা মূলত সূর্য উঠা দেখার জন্য এসেছিল।  আকাশ মেঘলা দেখে ফিরে চলে যাচ্ছিলেন।

অ‌্যাডামস পিক হয়তো কাছেই। দেখা যাচ্ছিল না চূড়া। কিন্তু আর কতদূর? যত কাছেই হোক, যত দূরেই হোক- আমার কি ভাগ্য হবে সেটা দেখার। যারাই নেমে যাচ্ছিলেন তারাই বলছিলেন এইত সামনেই। চেষ্টা করুন। উঠে যাবেন। বুঝতে পারছিলাম সবাই উৎসার দেবার জন্য ওসব বলছিল। ওদিকে শরীর তো আর চলছিল না! 

**




শ্রীলঙ্কা/উদয় হাকিম/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়