ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আদমের পায়ের ছাপ নিয়ে ভ্রান্তি বিলাস!

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০৬, ১৮ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আদমের পায়ের ছাপ নিয়ে ভ্রান্তি বিলাস!

অবশেষে পূরণ হলো সাধ! স্বপ্নের অ্যাডামস পিক এ আমি! আদম পাহাড়ের চূড়ায় এঁকে দিলাম নিজের পায়ের ছাপ! বাপরে বাপ! ভেবে পুলকিত হচ্ছিলাম। সে যেন এক জনমের পুণ্য! আমি ধন্য! আদম পাহাড়ের চূড়া, যেখানে প্রথম মানব পৃথিবীতে রেখেছিলেন তাঁর পদচিহ্ন; সেখানে পৌঁছে গেলাম আমিও।

আদমের পায়ের ছাপ দেখার জন্যই অ্যাডামস পিক বা আদম পাহাড়ের চূড়ায় যান সবাই। সবাই বলতে পর্যটক এবং কিছু ধর্মানুরাগী মানুষ। যদিও বৃহত্তর অর্থে সবাই পর্যটক। বলতে গেলে ওই বিশেষত্ত্ব ছাড়া এটা আর দশটা পাহাড়ের মতোই।

আদমের পায়ের ছাপ কেমন? এটি আসলে পাথরের উপর এক ধরনের অঙ্কন! কঠিন শিলার উপর আবছা কিছু দাগ। লোকজন সেটাকে পায়ের ছাপ মনে করেন। ওই ছাপটি অনেক বড়। দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি (কেউ বলে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি), প্রস্থে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি। আদম (আ.) নাকি ৬০ গজ লম্বা ছিলেন। অর্থাৎ ১৮০ ফুট। কেউ অবশ্য বলেন ৬০ ফুট লম্বা ছিলেন। মানুষ কীভাবে এতো লম্বা হবে সেটা আমার মাথায় খেলে না। আমিতো দেখছি প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষ লম্বা হচ্ছে, গড় আয়ু বাড়ছে। তাহলে?

আগে ওই পাথরের অংশটুকু উন্মুক্ত ছিলো। এখন সেটিতে ছাউনি দিয়ে মন্দিরের অংশ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। হতে পারে জায়গাটিকে স্রেফ সংরক্ষণের জন্য, ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য ওই ছাউনি। দূর থেকে দেখলে ওটাকে ঠিক একটা সাধারণ পাথর খন্ডই মনে হবে। খুব কাছ থেকে দেখলে তার উপর ছাপ লক্ষ্যণীয়। কিন্তু ছাপের উপর কী আছে ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই।

আদম (আ.) নাকি প্রথমে মাটিতে ফেলেছিলেন ডান পা। ওই ডান পায়ের উপরই নাকি তিনি দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে ছিলেন! কতদিন দাঁড়িয়ে ছিলেন? কেউ জানে না। সেই সঙ্গে তিনি গন্ধম খাওয়ার পাপের জন্য নাকি আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করেছেন। ক্ষমা চেয়েছেন। যে কারণে আশপাশের অংশের চেয়ে পাথরের পায়ের অংশ কিছুটা নিচু! মুসলমানরা বলেন, ছাপটি পশ্চিম দিকে লম্বা। মানে কেবলার দিকে। যাকে বলা হয় বায়তুল্লাহ। ওই পাহাড় থেকে নেমে তিনি নাকি হেঁটে বায়তুল্লাহতে গিয়েছেন। যাকে আমরা কাবা শরিফ বলে চিনি।

এখন অবশ্য ওই পায়ের ছাপ শক্ত দেয়াল দিয়ে ঘেরা। অতটা ভালো বোঝা যায় না। ভিড়ের মধ্যে মানুষ শুধু সিমেন্ট কংক্রিটের দেয়াল আর তার মাঝখানে কিছুটা অ্যাশ কালারের পাথর বসানো দেখেই চলে আসেন। যারা ভাগ্যবান তারা সুযোগ পান সেখানে প্রণাম, ভক্তি বা দোয়া করার। অথবা সময় নিয়ে দেখার।

শ্রীলঙ্কা একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। এর চারদিকে সমুদ্র। দেশটির মাঝখানে ঘন জঙ্গলের মাঝে সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় নেমেছিলেন সৃষ্টির আদি পুরুষ আদম। আগেই বলেছিলাম, বৌদ্ধরা মনে করেন ওটা গৌতম বুদ্ধের পায়ের ছাপ। হিন্দুরা মনে করেন দেবতা হনুমান অথবা শিবের পা। খ্রিস্টানরা ভাবেন অ্যাডামস এর পা, মুসলমানদের কাছে আদমের..।

ভোরের আকাশ ক্রমেই অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিলো। জোরে বাতাস বইছিলো। বাতাসের সঙ্গে ছিলো ঘন কালো মেঘ। সে মেঘ এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে পর্যটকের সংখ্যাও কমে যাচ্ছিলো। নামতে শুরু করা উচিত। বৃষ্টি নামলে ভিজতে হবে। সঙ্গে নেই ছাতা। নির্ঘাৎ ভিজবে মাথা। ক্যাপও অস্ট্রিয়ান যুবকেরা নিয়ে গিয়েছিলো।

যদি সূর্য থাকতো- দেখতে পারতাম আশপাশের অপরূপ সৌন্দর্য। যা নেই, তার জন্য আক্ষেপ করে কেন হারাবো খেই। তাড়াতাড়ি নামতে শুরু করা উচিত। উঠতে যেমন কষ্ট, নামতেও নিশ্চয় তেমন কষ্ট। তাছাড়া ওইদিনই কলম্বো ফেরার কথা। সেভাবেই হোটেল বুক করা। গাড়ি ভাড়া করা হয়েছিলো কলম্বো থেকে, ড্রাইভার নিচে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। যত দ্রুত নিচে নামতে পারব, তত দ্রুত ফিরতে পারব। মনে হচ্ছিলো কিছুটা বিশ্রাম না নিলে এই শরীর নিয়ে কলম্বো রওনা হওয়া যাবে না। কিন্তু সময় কই।

 

 

নামতে শুরু করলাম। চূড়ার কাছের ধাপগুলো এতো বড় যে, সহজে নামা যাচ্ছিলো না। নিচু হয়ে বসে নিচের ধাপে নামতে হচ্ছিলো। নিচে তাকাতে সমস্যা হচ্ছিলো। এতো কঠিন পথ কীভাবে গিয়েছিলাম, ভাবছিলাম সেটাই। নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরছিলো। পাশে তাকালে ভয় করছিলো। খাঁড়া অসীম খাঁদ। ওই খাঁদে পড়লে জীবন বরবাদ। শীর্ষ থেকে নিচের দৃশ্যগুলো দেখতে পারলে অবশ্যই অন্যরকম লাগতো। বিমান থেকে নিচের দিকে তাকালে যেমন দেখায়, ঠিক তেমন উচ্চতায় ছিলাম আমরা। ওদিকে নিচ থেকে উপরের বিমান দেখতে যেমন, আমরা ছিলাম ঠিক তেমন।

বড় ধাপগুলোতে কষ্ট হলেও ছোট ধাপগুলো অনায়াসেই নামতে পারছিলাম। যেটুকুতে রেলিং ছিলো সেখানে রেলিং ধরে ধীরে ধীরে নামছিলাম। মনে হচ্ছিলো পেছন থেকে কেউ ধাক্কা দিচ্ছিলো। আর তাই উঠার ঠিক উল্টো চিত্র নামার সময়। সবার আগে আমি নামছিলাম, আমার পরে ফিরোজ আলম, তারপর মিলটন। ফুল রিভার্স!

উঠার সময় এতো টায়ার্ড ছিলাম যে, ছবি তোলার কথাও মনে ছিলো না। ফেরার সময় গল্প করতে করতে নামছিলাম আর ছবি তুলছিলাম। এক ফাঁকে ক্যাপ ফেরত দেয়ার গল্প বললাম সহকর্মীদের। তারা শুনে মজা পেলো।

দুই একজন লোক তখনো উপরের দিকে উঠছিলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করছিলেন, পিক আর কত দূর? আমরা যেরকম উত্তর পেয়েছিলাম, বলছিলাম সেরকমই। কী বলছিলাম? এইতো সামনেই। এসে পড়েছেন। আর সামান্য একটু। প্লিজ ট্রাই। এসেই গেছেন বলা চলে। অলমোস্ট ডান। ডোন্ট ওরি। ক্যারি অন। এইতো সামান্য একটু পথ বাকি ইত্যাদি।

অন্ধকারে উঠেছিলাম বলে টের পাইনি। দিনের বেলা বুঝতেছিলাম পাগলের মতো কোথায় উঠেছিলাম। ডে লাইটে হলে হয়তো ভয় পেয়ে ক্ষান্ত দিতাম। রাতে আবেগের ভূত টেনে নিয়ে গিয়েছিলো কোনো এক অজানায়! 

কতদূর উঠেছিলাম আমরা? কত উপরে? ৭৩৬০ ফুট। কতগুলো স্টেপ আছে উঠার। কেউ বলে ৫ হাজার ৫০০। কিন্তু সংখ্যাটা মোটেও সঠিক নয়। হতে পারে শেষ ধাপে ওই পরিমাণ স্টেপ রয়েছে। কারন ৭ হাজার ফুট উপরের দিকে উঠতে নিশ্চয় আরো বেশি স্টেপ থাকবে। সব স্টেপতো আর এক ফুট উঁচু হতে পারে না। তাছাড়া অনেক খানি পথ আছে সমান্তরালে হাঁটতে হয়। স্টেপ বা ধাপ নেই। তাহলে?

ওই আদমের পায়ের ছাপ নিয়ে কত রকমের বিভ্রান্তি যে রয়েছে। যারা না গিয়েছেন তারা অনেকেই ওইসব ভ্রান্তি বিলাসে বিশ্বাস করতে পারেন। নিজে যাওয়ার আগে জানতাম, পাহাড় চূড়া থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ওই পায়ের ছাপ। বিদেশী এক পর্যটকের লেখা এবং ছবি থেকে সেটা জেনেছিলাম। বুঝলাম লোকটা ভুল বলেছিলো। আসলে ওই পাহাড়ের আশপাশে যত রকমের গর্ত বা পায়ের ছাপের মতো, বা তার কাছাকাছি ধরনের যা কিছু দেখা যায়- সেটাকেই পর্যটকরা নিজের মতো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ফটোশপে বা ভিডিও এডিট করে একেকটা গল্প ফেঁদেছেন। আর তাই এ বিষয়ে গুগোল ইমেজে গেলে অনেক রকমের ছবি দেখবেন। ইউটিউবে অসংখ্য ভিডিও। সংলগ্ন ওইসব পাথুরে পাহাড়ে নানা রকমের চিত্র পাওয়া যায়। নিচের একটা খাদে পানি জমা একটু কাঁদামাটি দেখে অনেকে সেটাকেই আদমের পায়ের ছাপ বলে প্রচার করেছেন। কেউ কেউ পাহাড়ের গায়ে পায়ের আঙ্গুলের ছাপের মতো কিছু পেলে সেটাকেও অ্যাডামস ফুট প্রিন্ট বলে প্রচার করেছেন। আহা! ‘সেই সত্য যাহা রচিবে তুমি, ঘটে যাহা সব সত্য নহে!’

 

**



শ্রীলঙ্কা/উদয় হাকিম/জেনিস

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়