ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আদম পাহাড়: নামার পথ কখন শেষ হবে? 

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১১, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আদম পাহাড়: নামার পথ কখন শেষ হবে? 

মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম এ‌্যাডামস পিক

সত্যি বলতে কি, দূর থেকেই অ্যাডামস পিক বেশি সুন্দর! আদম পাহাড়ের চূড়ায় তেমন কোনো সৌন্দর্য নেই। নেই সেখানকার স্থাপনাতেও। ওই দূর থেকে কাশবন দেখার মতো।   

গুরুত্ব অনুযায়ী আদম পাহাড় আরো বেশি যত্ন দাবি করে। যেখানে আদমের পায়ের ছাপ সংরক্ষণ করা- ওই জায়গাটি পরিকল্পিতভাবে সাজানো যেতো। তাতে যতটা না অর্থের প্রয়োজন, তার চেয়ে ঢেড় বেশি প্রয়োজন পরিকল্পনার, ইচ্ছার। অনেকটা গরিবের সুন্দরী বউয়ের মতো ঘোমটা মাথায় নিরাভরণ দাঁড়িয়ে অ্যাডামস পিক, শ্রী পদ।

একেবারে নিচের দিকে চমৎকার একটি ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখছিলাম অ্যাডামস পিক। ওখান থেকে সবচেয়ে বেশি সৌষ্ঠব দেখাচ্ছিলো আদম পাহাড়কে। যুবতী কন্যার মতো। ষোড়শীরমতো। চপলা চঞ্চলা তরুনীর মতো। শিষ বাজিয়ে আবাহনকারী চটুল কিশোরীর মতো। বনানী রানীর মাথার মুকুটের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো শান্ত সৌম্য চূড়া। রোদের আলোয় রাজমুকুটের মতোই ঝিলমিল করছিলো পিক। পুরো চরাচর ভেসে যাচ্ছিলো সূর্যের অপার্থিব আলোয়। 

আগেই বলেছিলাম, ঠিক ওখান থেকে ওভাবে অ্যাডামস পিক দেখতে পারব, ভাবিনি কখনো! মিলটন কিছুটা পেছনে ছিলো। যখন তাকে দেখালাম ওই যে, অ্যাডামস পিক! প্রথমে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকিয়েছিলো। কিছুক্ষণ বুঝত পারছিলোনা কি করবে। তারপর শুরু হলো ছবি তোলা। আমি আর ফিরোজ আলম ছবি তুলছিলাম মোবাইল ফোন দিয়ে।ডিএসএলআর ছিলো মিলটনের হাতে। সেটা বন্দুকের মতো তাক করে মিলটন অনবরত পাগলের মতো ছবি তুলছিলো।   

দাঁড়িয়ে, বসে, রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বেশ কিছু ছবি হলো সবারই। কিন্তু ওই পাহাড়ের কাছে সবকিছু দূরে। ওটার যে সম্মোহনী শক্তি তাতে তাকে একাই ভালো মানাচ্ছিলো। যতদূর চোখ যায় কেবল গাছের মাথা, সবুজ পাতা। উপরের আকাশ উজ্জল নীল। দু একটা মেঘ সাদা আলপনা ছড়াচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো ওই স্পট (আমরা যেখানে ছিলাম) থেকে পাহাড়ের মাথা পর্যন্ত পথ টুকু প্রজাপতি সড়ক; প্রজাপতিরা গাছ-ফুলের মধু খেতে খেতে উড়ে চলে যাবে ওই গন্তব্যে।তাদের চলার পথে ব্যাক গ্রাউন্ড মিজজিক বাজবে- গুন গুন গান গাহিয়ানীল ভ্রমরা যায়।  

ধ‌্যানমগ্ন বুদ্ধের সঙ্গে

ছবি তোলা শেষ করে নিচের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। খানিকটা জায়গা অবশ্য প্রায় সমতল ছিলো ওখানে। একটা ছোট ঘর ছিলো। এটা চা নাস্তার দোকান। কিন্তু পরিত্যক্ত।মাস দুয়েক পরে হয়তো সরগরম হয়ে উঠবে। নিচের দিকে আরেকটু নামতেই একটা বড় মন্দির চোখে পড়লো। একতালা, টিনের ছাউনি। বিশাল মন্দির চত্বর। জায়গাটা চেনা চেনা লাগছিলো। আরেকটু সামনে এগোতেই চিনতে পারলাম। মন্দিরের মূল বেদিতে গৌতম বুদ্ধের বড় মূর্তি। তাকে ঘিরে অসংখ্য পূঁজারী। সেগুলোও মূর্তি। বুদ্ধের পুরো সভাষদ যেন। কোনো গুরুত্বপূর্ন আলোচনা বা প্রার্থণা সভা। সবাই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে নেতার দিকে। 

চেনা চেনা লাগছিলো কেন তা কি বুঝতে পেরেছেন? মধ্য রাতে টর্চের আলো ফেলে এই মন্দির দেখেছিলাম- পাহাড়ে উঠার সময়। তখন নীরব ছিলো চারদিক। গা ছমছম করছিলো। অচেনা আঁধারে মূর্তি গুলোকে অশরীরী আত্মার মতো লাগছিলো। একা থাকলে নিশ্চয় খুব ভয় পেতাম। তিন জন ছিলাম বলে রক্ষা। দিনের বেলাতেও জায়গাটি কিছুটা ভয় জাগানো। আর কখনো কোথাও দেখিনি- পুরো একটা সভার সবগুলো চরিত্র এভাবে মূর্তিমান! 

বুদ্ধের মূর্তি কেন জানিনা আমার খুব ভালোলাগে। এক সময় একজন প্রিয় মানুষ আমাকে বুদ্ধ বলে ডাকতেন। মূর্তি গুলো ছিলো বুদ্ধের ডানে এবং বামে। কয়েকটা সেলফি তুললাম। এক পাশে বসে পড়লাম আমিও। মিলটনকে বললাম ছবি তুলতে। মনে হচ্ছিলো ওই সব মূর্তি গুলোর পাশে আমিও একটা মূর্তি। বুদ্ধের মাথাটা লাল কাপরে ঢাকা ছিলো। পরনে ছিলো গেরুয়া বসন। সাদা মূর্তি গুলোর পাশে সাদা টি শার্ট গায়ে বসেছিলাম। একটু পর ফিরোজ আসলেন। ছবি তোলা শুরু করলেন সে-ও। তার ফটো সেন্স খুব ভালো। বললেন, আরো চেপে বসেন, গৌতম বুদ্ধের পাশে বসলাম। মিলটনকে আবার বললাম, বিপরীত পাশে গিয়ে দুটো মূর্তির ফাঁক দিয়ে একটা ছবি নিতে।  

মন্দিরের বাইরে একটা বেঞ্চে ঠিক এই জায়গাটাতেই বসেছিলেন ইমন। ভোরের ডাকের সাংবাদিক। যিনি আমাদের সঙ্গে মধ্য রাতে যাত্রা শুরু করেছিলাম, অ্যাডামস পিক এ উঠবেন বলে। এই মন্দির পর্যন্ত উঠে ক্ষান্ত দিয়েছিলেন। হাঁপিয়ে উঠে ছিলেন। আর পারবেন না বলে বসে পড়েছিলেন। রাতের আঁধারে ওখানে তাকে রেখে আমরা যাচ্ছিলাম উপরে। কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম শেষে, তিনি চলে গিয়েছিলেন হোটেলে। এই সেই ব্ল্যাক স্পট। হয়তো দিনের আলোয় হলে আমরাও আর উপরে উঠার সাহস পেতাম না। মনে হতো এ তো দূর কীভাবে উঠা সম্ভব!রাতের বেলায় কোনো এক অদৃশ্য মায়ার টানে উঠে গিয়েছিলাম। 

তবে নিচে নামতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। পাদ দেশের কাছাকাছি ওই ভিউ পয়েন্ট থেকে দারুন লাগছিলো আদম পাহাড়। যেভাবে এর চূড়া এবং আশপাশের জায়গাটা দেখা যাচ্ছিলো- বোধ হয় আর কোনো জায়গা থেকেই ওটাকে এতোটা সুন্দর দেখায় না। ভিউ পয়েন্টটাতে রেলিং দেয়া। যাতে নিচের খাদে কেউ না পড়ে। যদিও আমরা সেটা ব্যবহার করলাম ছবি তোলার কাজে।  

তাড়া ছিলো নিচে নামার। দেরি করার সুযোগ নেই। গাড়ি অপেক্ষা করছিলো। হোটেলে গিয়ে হয়তো বিশ্রাম নেবার ও সময় পাব না। দ্রুত ছুটতে হবে কলম্বোর দিকে। হাঁটছিলাম। হঠাৎ ইমনের ফোন। ভাই কই আপনারা? বললাম, যেখান থেকে আপনি ফিরে গিয়েছেন, সেখানেই আমরা। ইমন বললো, থাকেন আমি আসছি। এখন এসে কি করবেন? আপনি আসতে আসতে আমরা আরো নেমে যাব। নাছোড় বান্দা। সে আসবেই। আসুক। 


জাপানিজ টেম্পলের সামনে

নিচের দিকে কিছুক্ষণ নামতেই পেয়ে গেলাম সেই টেম্পল, জাপানীজ টেম্পল। হয়তো জাপানের অর্থায়নে মন্দিরটি হয়েছে। উপর থেকে দেখা যাচ্ছিলো সাদা মুকুট পরা সুউচ্চ চূড়া। ওখানে বেশ কিছুটা জায়গা সমতল। মূল রাস্তা থেকে একটু ভেতরে মন্দির। মূল গেটে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। 

ফিরোজ আর মিলটন মূল রাস্তাতেই দাঁড়ালেন। আমি খানিকটা ভেতরে গিয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম। 
আর কিছুটা পথ নামতেই দেখলাম মালভূমির মতো একটা চত্বর। পাহাড়ের উপরে থাকা সমতল ভূমিকে বলা হয় মালভূমি। এরমধ্যে টেবিলের মতো দেখতে মালভূমিকে টেবিল মালভূমি বলা হয়। ওই জায়গা থেকে উত্তরের পর্বত শ্রেণী সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে স্পষ্ট দেখাচ্ছিলো। পাথর বেয়ে নেমে আসা অসংখ্য ঝরনা দেখতে পাচ্ছিলাম। কাছে থাকায় সেগুলো আরো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। ফিরোজ আর মিলটন মনে হয় জায়গাটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। যত ইচ্ছে ছবি তুলছিলো। আমার ছবি তোলার সাধ মিটে গেছে ততক্ষণে। আর কত! মোবাইল প্রায় ভরে উঠে ছিলো ছবিতে।  

মনে হচ্ছিলো এইতো নেমে গিয়েছি। কিন্তু নামা আর শেষ হচ্ছিলো না। নামার সময় কষ্ট কম বলে রক্ষা। যাদের আগে নামতে হয়, পরে উঠতে হয় তাদের কি অবস্থা! 
আরো মিনিট দশেক পরে একটা গেট চোখে পড়লো। রাতে এই গেট বোঝা যাচ্ছিলো না। অনেক বড়। ওই গেটের ভেতর দিয়েই উঠতে, নামতে হয়। বলা চলে ওই গেটের পর থেকেই পাদেশের অংশ শুরু। 

আদম পাহাড়ের উঠার পথে, বিশেষ করে শুরুর দিকে কত যে মন্দির আর কত যে মূর্তি! হিসেব রাখার জো নেই। সামনে পড়লো অপেক্ষাকৃত নিচু একটা ছাউনি। আদম চূড়ার বিপরীত দিকে। ওই ছাউনিতে লম্বা হয়ে শুয়ে গৗতম বুদ্ধ। অনেক বড় মূর্তি। শুয়ে ছিলেন বলে মন্দির বা ছাউনি উঁচু করার দরকার হয়নি। ব্যাক গ্রাউন্ডে দেখাচ্ছিলো পাথুরে গুহায় ধ্যান মগ্ন বুদ্ধ।

আমরা এতোটা ক্লান্ত ছিলাম যে, ওসব মূর্তি আর ভালো লাগছিলো না। মনের স্ফূর্তিও শেষের দিকে। পথ কেন শেষ হয় না? নামার পথ কখন শেষ হবে সেই চিন্তায় মগ্ন।  


 

শ্রীলঙ্কা/উদয় হাকিম/নাসিম

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়