ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অশ্রু বেদনা উদ্বেগ ও আশার বাংলাদেশ; তোমায় ভালোবাসি

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অশ্রু বেদনা উদ্বেগ ও আশার বাংলাদেশ; তোমায় ভালোবাসি

|| অজয় দাশগুপ্ত ||

বিজয় দিবসটি হওয়া উচিত ছিল সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন। এই দিনটি আমরা নিয়মমাফিক পালন করি বটে কিন্তু এর ভেতরের যে তেজ যে ইতিহাস ও যে আনন্দ আজ তার অনেককিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সাত-আট বছর আগে সিডনির একরাতে আমি ব্রুস উইলসনকে ফোন করেছিলাম। কীভাবে কীভাবে যেন তাঁর নাম্বার পেয়ে গিয়েছিলাম। জানতাম তিনি তখন কাজের সুবাদে বিলেত আছেন। কিন্তু জানতাম না আমার ফোনটি ধরবেন হাসপাতালের রোগশয্যায়।

 

অস্ট্রেলিয়ার নাম্বার দেখেই ফোন তুলেছিলেন তিনি। ফেয়ার ফ্যাক্স মিডিয়ার ডাকসাইটে কর্মকর্তা ব্রুস আমার নাম শুনে পারিবারিক পদবি জেনে একমুহূর্তে চিহ্নিত করেছিলেন হিন্দু বৈদ্য সম্প্রদায়ের মানুষ বলে। কে এই উইলসন? ইনি সেই সব সাংবাদিকদের একজন যিনি ষোলো ডিসেম্বর তখনকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের স্যারেন্ডার পর্বের সংবাদদাতা। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের প্রায় পুরো সময় তিনি মুক্তিবাহিনীর সাথে থেকে তাদের খবরাখবর যোগাড় করে দুনিয়াকে জানাতেন। জনমত গঠনের ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ আমাদের যারা সহায়তা ও সাহায্য করে দুনিয়াকে জানিয়েছিলেন ইনি তাদের একজন।

 

কথায় কথায় ইতিহাস বিকৃতির কথা বলে নিজের চাপা দুঃখ আর বেদনার কথা বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এ কে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন, সক্রিয় ছিলেন তারপরও তাঁর চোখের সামনে কেন এভাবে ইতিহাস বিকৃত হয়ে চলেছে? সেদিন আমরা কেউ জানতাম না কোনো একদিন এ কে খন্দকার তাঁর গ্রন্থে একজন মেজরকে যুদ্ধের ক্রেডিট চাপিয়ে দিতে চাইবেন। যতদূর জানি উইলসন আজ আর বেঁচে নেই। বেঁচে নেই একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক মুক্তিযোদ্ধা ওডারল্যান্ড। যাঁর কণ্ঠেও ছিল একই বেদনা। আজ এক বিভ্রান্ত দিশেহারা তারুণ্য যে কাহিনী, যে ইতিহাস জেনে বড় হয়েছে তারা এদের চেনে না। জানে না মুক্তিযুদ্ধ এমন এক ইতিহাস যার প্রতি পরতে জড়িয়ে আছে গৌরব ও বেদনা। একচোখে পানি আর একচোখে আনন্দের বিজয় আমরা হেলায় ম্লান করে এনেছি। এখন যা আছে তার নাম উন্মাদনা। 

 

প্রথাগত কিছু লেখা আর গৎবাধা কথার তোড়ে বিজয় ভেসে যাচ্ছে। চারদিকে তাকানোর সময় নেই আমাদের। অতীতে যাদের আগ্রহ তারা আর কাউকে একবিন্দু ছাড় দিতে রাজী না। যারা অতীতকে নিয়ে মিথ্যাচার করে তাদের চেহারা ভয়ংকর। তারা আপাতত কোনঠাসা কিন্তু ঘরে ঘরে তাদের দাপট। আমি এক তরুণকে জানি, তার নাম ‘বিজয়’ বলে এখন সংকুচিত হয়ে থাকে। বাবার দেওয়া গর্বের নামটি তার নিজের কাছেই কেমন গ্লানিকর। এটা তাকে একদিকে যেমন অনিরাপদ করে, তেমনি তার বদলে যাওয়া মননেও আঘাত হানে। সন্দেহ জাগে তার মনে, এই নামে আখেরাতে কোনো অসুবিধে হবেনা তো?  

 

মেয়েদের কথা বলা বাহুল্য। তাদের নামের সাথে পোশাকও গেছে পাল্টে। একদা বাঙালি হবার সংগ্রামে নিবেদিত জাতি মুক্তির এত বছর পর বিজয়কে দেখে সন্দেহের চোখে। পাকিস্তানের পরাজয় ও আত্মসমর্পণ আজ অনেকের কাছে বেদনার। তারা এটিকে জাতিগত পরাজয় ও দুশমনের কাছে আত্মসমর্পণের সমার্থক মনে করে। 

 

আজ যখন দেশ এগুচ্ছে, উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে গায়ে আমরা এমন সব আচরণে নিজেদের ছোট করছি যা একাত্তরে ভাবা যায়নি। সেদিনের বিজয় ছিল সার্বিক মুক্তি ও স্বাধীনতার এক আনন্দ অধ্যায়। আজ যা আছে তা হলো দলবাজীর টানাটানিতে খণ্ডিত এক বেদনার ইতিহাস। এমন দেশে এমন মারমুখো সমাজে আমার মত ভীতু মানুষের কাছে বিজয়ের চাইতে বড় হয়ে উঠেছে ভয়ের দিকটি। বিজয়ের ঠিক আগে যে হত্যাকাণ্ড আমাদের দেশকে মেধাহীন করে ফেলেছিল আমাদের পঙ্গু করে রাখতে চেয়েছিল আজ তার বিভীষিকা আবার তার ছায়া ফেলছে। মনে পড়ে দেশটি তখন বাঙালি ঐক্যের দূর্গ। নেতা ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার ডাক দিয়ে অন্তরীণ হয়ে থাকলেন পাকিস্তানের কারাগারে। কিন্তু সংগ্রাম থামেনি। তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুলদের নেতৃত্বে মুক্তির লড়াই যখন একেবারে শেষ প্রান্তে, বিজয় যখন সুনিশ্চিত পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকারেরা তাদের মরণ ছোবল হেনেছিল। সুকৌশলে এদেশকে মেধাশূণ্য করার জন্য রায়েরবাজারে আমাদের সেরা মানুষদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল তারা। এসব আমাদের ইতিহাস। আমাদের জানা। কিন্তু আমরা জানতাম না সে ধারাবাহিকতা স্বাধীন দেশেও চলতে পারে। আজ এতবছর পর আমরা কী দেখছি? এই কদিন আগেও কলমসৈনিকদের জীবন কেড়ে নেওয়ার নারকীয় তাণ্ডব দেখেছি আমরা। যে দেশ বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে প্রতিবছর শোক পালন করে; মিডিয়া থেকে জনগণের ভেতর এক ধরণের বিষাদ নেমে আসে, সেদেশে এমন সিরিয়াল কিলিং কিসের ইঙ্গিতবাহী? 

 

ভালো করে দেখুন কতটা বদলে গেছে আমাদের সমাজ। আজ আমরা যেদিকে তাকাই এক বিশাল বৈপরিত্য। জানি না এ কিসের প্রতীক, তবে এটা বুঝি মগজে পচন ধরে গেছে আমাদের। সহজ স্বাভাবিক মুক্তচিন্তা এখন সমাজ নিতে পারে না। দেশের মানুষের মনে এক মুখে আরেক। জটিল এক স্নায়বিক লড়াই চলছে যেন। অন্তরে সাংস্কৃতিক উদারতা থাকলেও আজ আর সে তা বলতে পারে না। ধর্ম আগে ছিল, এখন আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু সবকিছু এত স্পর্শকাতর কখনো দেখা যায়নি। সে সুযোগে ঘাতকদের হাতে অনায়াসে উঠে  এসেছে চাপাতি। কী ভয়ানক! একাত্তরে যাদের চোখ বেঁধে নিয়ে যেতে হয়েছিল এখন তাদের চোখ খোলা, হাত খোলা, মুখ খোলা রেখেই প্রকাশ্যে কুপিয়ে মারা হয়। বাড়িতে অফিসে রাস্তায় কোথাও নিরাপদ না তারা। যেদেশের শাসনে মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি দল, চেতনার রাজনীতি বলে যারা মিডিয়া দাপায় তাদের আমলে শুধু ষড়যন্ত্র করে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটানো কী আসলে সম্ভব? নাকি এর পেছনে আছে সমাজের নীরব সমর্থন?

 

যদি তা না হয়, কীভাবে একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হলো না? শাস্তি পেলো না অপরাধীরা? বরং আমরা দেখছি একদল মুক্তমনা ব্লগাররা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। দেশ ছাড়বে কারা? যারা অন্ধকারের জীব যাদের হাতে কুড়াল, চাপাতি, বন্দুক তারা? না যাদের হাতে কলম তুলি বাঁশী বা কাগজ তারা যাবে দেশ ছেড়ে? একবারও কি ভাবা হচ্ছে কী হতে পারে এর পরিণতি? যারা আজ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী তাদের কাছে কি বার্তা পাঠাচ্ছে আমাদের রাজনীতি? যে বড় হলে কখনো আর এসব ভাববে না? এসব করবে না? করলে তোমার মগজ পড়ে থাকবে রাস্তায়। আঙুল উড়ে যাবে, রক্তে ভাসবে অফিস ঘর। দু’একদিন সবাই হা হু করলেও সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। পিতামাতা-স্বজনদের বুক খালি ছাড়া আর সব ভরে উঠবে সময়ের নিয়মে। এটাই কি মুক্তসমাজের ভাবনা?

 

একাত্তরে রায়ের বাজার বধ্যভূমি আমাদের জানিয়েছিল দুশমনদের শেষ টার্গেট হয় মুক্তচিন্তা। তারা আলো সহ্য করতে পারে না। কাকে বলে এনলাইটমেন্ট? যতদূর আলো যায় ততদূর দেখা এবং মেনে নেওয়ার নামই হলো বোধ। তাকেই বলে আধুনিকতা ও উদারতা। সেটা থমকে গেছে। যে কারণেই হোক আজ আমরা আলোতে থাকতে চাই না। আলোতে এমন সবকিছু দেখা যায় যা আমরা নিতে পারি না। সমাজ ও বাস্তবতার সাথে আদর্শিক সংঘর্ষে পাল্টে যাওয়া বাঙালি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে বটে ধারণ করতে পারে না। অথচ আমাদের মনে এখনো ঘোর দূর্দিনের অন্ধকার। আকাশে চিলের আনাগোনা। কত রূপে কত ভাবে যে এরা সেসব কালো দিন কালো রাত ফিরিয়ে আনতে চায় জেনেও আমরা সুশীলের নামে অন্ধকারের দিকে পাশ ফিরে ঘুমাই। সাবধান না হলে এরা সুযোগ পেলে কাউকে আস্ত রাখবে না। যারা ভাবছেন কিছু না বলাটা নিরাপদ, না লেখাটা তাদের বিপদমুক্ত রাখবে তারা আহম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। এবার এরা কাউকে ছাড় দেবে না। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস আর উগ্র মৌলবাদের সাথে গাঁটছড়া বাধা এরা কাউকে ছাড় দেবে না। তাই নিজের লেখা একটি ছড়ার লাইন দিয়েই বলি :

‘এই দেশে আজো যখন লিখছো আঁকছো বলছো তুমি

চোখের তারায় জাগিয়ে রেখো রায়েরবাজার বধ্যভূমি।’

 

বিজয়ে দিবসে তারপরও আমরা আনন্দের কথা ভাববো। ভাববো একদিন আমাদের লেখাপড়ার জগত থেকে বৈষম্য দূর হবে। আমরা ধর্মীয় পড়াশোনার নামে দেশের এক বিশাল অংশকে পেছনে টেনে ধরে রাখবো না। ইংরেজি শিক্ষার নামে এমন সব বিষয় টেনে আনবো না যাতে জাতির পরিচয় সংকট তৈরি হয়। দেশের সব বিদ্যালয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না আজো। এতবড় অপমান আর বেদনা নিয়ে কবরের মত নীরব বুদ্ধিবৃত্তিকে ঘৃণা করতে শিখবো আমরা। এ দেশের মেয়েরা আর কোনদিন ধর্ষিতা হয়ে সংবাদ শিরোনাম হবে না। আর কোনদিন ভোটের নামে রাজনীতির নামে মানুষের লাশে ভরে উঠবে না সকালের মিডিয়া। জনক বড়, না কোন এক সেনানায়ক বড়-এনিয়ে ঝগড়া করবো না আমরা। বিজয়ের দেশে বিজয়ী ভয় পাবে না বিজিতদের। সবার ওপরে যেমন আকাশ তেমনি আমাদের সবার মগজে গাঁথা থাকবে দেশের নাম। আমরা যে যা করি যাই করি আমাদের দিনান্তের শেষাশ্রয় হবে বাংলাদেশ। আজ তার মানুষ বুড়িগঙ্গা থেকে আটলান্টিক বা প্রশান্তপাড়ে ছড়িয়ে থাকা বিশ্বনাগরিক। আমরা চাইলেই পারি। পদানত করি হিমালয়, মাঠে গর্জে উঠি বাঘের ডাকে। আমি সে দেশের মানুষ যে দেশের নেতা সাধারণ এক গ্রাম থেকে উঠে এসে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়ে গেছেন। আমার সেই দেশ কখনো পরাভব মানেনি। আজ তার বিজয় পরিণত বয়সে তার কাছে ভালোবাসার প্রতিদানে শান্তি ও অগ্রগতি চাইতেই পারে।

 

সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। আমরা তোমায় ভালোবাসি।

 

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়