ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সিডরের ৫ বছর পূর্তি: সাজানো সংসার লণ্ডভণ্ড হওয়া স্মৃতি

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩০, ১৮ নভেম্বর ২০১২   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
সিডরের ৫ বছর পূর্তি: সাজানো সংসার লণ্ডভণ্ড হওয়া স্মৃতি

রাইজিংবিডি২৪.কম:

১৫ নভেম্বর ভয়াবহ সিডরের ৫ বছর পূর্তি। ২০০৭ সালের এই দিনে সিডর নামক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সমগ্র উপকূলকে। শতাব্দীর ভয়াবহ ঐ ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ৫ হাজার মানুষ। নিখোঁজ হয়েছিল কয়েক হাজার।

সে রাতে ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে বঙ্গোপসাগর থেকে সিডর দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। রাত ৩টায় প্রথমে বরিশাল-খুলনার উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করতে গিয়ে ধ্বংসের থাবা বসায়।

খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জসহ আশপাশের অন্তত ১৬ জেলায় চলে ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা। এছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানেও আঘাত আনে। সিডরের আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘরের ভেতর-বাইরে সবখানে লাশের ওপর লাশ পড়ে থাকে। হাজার হাজার বসতবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত আর বনাঞ্চল মাটির সঙ্গে মিশে উজাড় হয়ে যায়। অনেক জায়গায় ঘর-বাড়ি পুরোপুরি বিলীন হয়ে পড়ে।

সরকারি হিসেবে ২০ লাখ ঘরবাড়ি ভেসে যায় পানির স্রোতে। প্রায় ৪০ লাখ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়। মৃত্যু হয় ৪ লাখ ৬৮ হাজার গবাদিপশুর। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরায় মারা যায় ৭০ হাজার গবাদিপশু। বাকি গবাদিপশুর মৃত্যু হয়েছে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। সিডরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলা।

সিডর আক্রান্ত এলাকায় কাফনের কাপড়ের অভাবে অনেকে নিহতের লাশ পলিথিনে মুড়িয়ে দাফন করেন। এছাড়া কবরের জায়গার অভাবে গণকবরও দেওয়া হয়।এমনও হয়েছে একটি কবরে এক সঙ্গে দাফন করা হয় ২৪ জনকে। বহু লাশের কোনো পরিচয়ও পাওয়া যায়নি।

তাদেরকে অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে দাফন করা হয়। এ সময় চারদিকে মানুষের লাশ আর মরা জীবজন্তুর পচা গন্ধে পরিবেশ দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে।

প্রায় ১ মাস পরও ধানক্ষেত, নদীর চর, বেড়িবাঁধ, গাছের গোড়া আর জঙ্গলসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয় অনেক হতভাগার কঙ্কাল। কেউ কেউ সিডর আঘাত হানার অনেক দিন পর স্বজনদের কাছে ফিরেও আসেন। তবে না ফেরার সংখ্যাই ছিল বেশি।

মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের বেশির ভাগেরই সলীল সমাধি হয় সাগরে। যাদের কোনো অস্তিত্ব পরে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এ দিনের স্মৃতি উপকূলবাসীর খুবই করুণ। কোনোভাবে ভুলবার নয়। যাদের পরিবারের কেউ নিহত অথবা নিখোঁজ হয়েছিল, তারা আজকের রাতকে স্বজন হারানো বেদনায় স্মরণ করবে। সেদিন শুরু হওয়া এ কান্না যাদের এখনও থামেনি, যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ছোট্ট ঘরখানি, গৃহপালিত পশু আর বৃক্ষরাজির সঙ্গে নাড়িছেঁড়া ধন, আপনজন ভেসে গিয়েছিল বানের পানিতে- গত পাঁচ বছরে তাদের প্রতিটি দিনই গেছে দুঃসহ যন্ত্রণা আর স্বজন হারানো বেদনায়। এই দিনটি তাই তাদের কাছে নিজের অস্তিত্বের মতোই স্মরণীয়।

২০০৭ সালের এই দিনে তাদের সাজানো সংসার লণ্ডভণ্ড করে দিতে এসেছিল ভয়ঙ্কর প্রকৃতির দানব-‘সিডর’। ভয়াবহ মূর্তিতে গভীর রাতে দেশের উপর আঘাত হানে। তাই ‘কালো রাত’ হিসেবে এখনও তাদের চোখে এ রাতটির অন্ধকার বর্তমান হয়ে আছে।

এই মহাপ্রলয় কেড়ে নিয়েছে কারও সন্তান, কারও মা-বাবা, ভাই-বোন, কারও বা স্বামী।

অনেক পরিবার আছে, যার একজন সদস্য ছাড়া বাকি সবাইকে সিডরের কাছে সঁপে দিতে হয়েছে। চোখের সামনে বানের পানিতে সন্তান ভেসে যাচ্ছে। দেখে শেষ চেষ্টা করেও অনেক বাবা সেদিন বাঁচাতে পারেনি তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে। ভালবাসার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেনি স্বামী। তাই উপকূলবাসীর এই কালো রাত এখনও চোখে জল আনে, এখনও কাঁদায় স্বজন হারানোর তীব্র আর্তনাদে।

সিডর পাল্টে দেয় দক্ষিণাঞ্চলের মানচিত্র। পৃথিবীর বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় কল্পনাতীত। শতাব্দীর ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এখানকার এক তৃতীয়াংশ বনভূমি বিধ্বস্ত হয়। মাইলের পর মাইল উজাড় হয় বন। এ কারণে জীব বৈচিত্র্যের এই উদ্যান থেকে বিলীন হয় অনেক বিরল প্রজাতির বৃক্ষ ও প্রাণী। সিডরের আঘাতে যে পরিমাণ ক্ষতি দেশের হয়েছে, তা আজও পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। যার ক্ষতচিহ্ন এখনও সুন্দরবনে লেগে আছে।

বাংলানিউজের বিশেষ এক অনুসন্ধানে জানা যায়, ৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর পুনর্বাসনের উদ্যোগের সুফল ক্ষতিগ্রস্ত ৭০ ভাগ মানুষই পাননি। এনজিওগুলোর নীতিমালার নামে যে কঠিন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে তাতে সিডর আক্রান্ত মানুষ পুনর্বাসিত হতে পারেনি। অভাব তাদের এখনো তাড়া করে বেড়ায়। এরই মাঝে আবার ঘুরে এসেছে ভয়াল সেই স্মৃতির দিন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপকূলীয় জনপদ খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ চরম দুর্ভোগ ও দুরাবস্থার মধ্য দিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। দীর্ঘ ৫টি বছর পর অনেক ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে পানিমুক্ত হলেও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও চরম কর্মসংস্থানের অভাবে গোটা ইউনিয়নের মানুষের মাঝে চলছে মানবিক বিপর্যয়।

দক্ষিণ বেদকাশী’র ইউপি চেয়ারম্যান এমএমএ মান্নান বাংলানিউজকে জানান, বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা অবহেলিত একটি ইউনিয়ন। যে ইউনিয়নের গৃহহারা মানুষ সিডরের পর তাদের বাস্তুভিটায় এখনও ফিরতে পারেননি।

স্থানীয় স্কুল শিক্ষক মো. আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, পানি বন্দি হয়ে থাকার কারণে এলাকার অনেক জায়গায় ধানচাষ হয় না, ঘেরে নেই মাছ, চরম কর্মসংস্থানের অভাবে ক্রমেই এলাকাটি জনশূন্য হয়ে পড়ছে।

তিনি আরও জানান, এরই মধ্যে ৪০ শতাংশ অধিবাসী দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা শহর ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাড়ি জমিয়েছে কর্মসংস্থানের জন্য। সেখানে তারা কেউ দিনমজুরি, কেউ ভ্যান-রিকশা চালিয়ে, কেউ হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের আব্দুল জলিল মোড়ল বাংলানিউজকে বলেন, “কি শুনবেন সিডরের কথা।” একথা বলে তিনি অঝোরে কেঁদে ওঠেন।

তিনি বলেন, “সিডরের পাঁচ বছর হলেও মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পাইনি। যার কারণে দুই ছেলে মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে খুলনায় হোটেলে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি।”

বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদীর পাড়ের বাসিন্দা আয়েশা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, “ঘরের বেড়া নেই। কোনো রকমে কয়েকটা বাঁশের ঢ্যাশা দিয়ে চালা বানাইয়ে ঘরডা খাড়া করছি। পলিথিন দিয়ে ঘরের চারাডা ঢাকছি। বিষ্টিতে ঘরের মধ্যে পানি ঢোকে। শীতে শোয়া-বসা যায় না। এ অবস্থায় বাঁচার থেইক্যা মরণও ভালা ছিল। সিডর থেকে বাঁচলেও এহন ছেলে-মেয়ে নিয়ে আর বাঁচতে পারছিনে। আমার দুই বিঘে জমি ছিল। তার প্রায় সবই বলেশ্বর নদী গিলেছে। যেটুকুন ছিল তাও সিডরের সময় ঘরবাড়িসহ নদীতে গেছে। এহন চরের ভিটেই দুইচালা খাড়া করে ছেলে, মেয়ে ও পরিবার নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি।”

বলেশ্বর নদীর চরের ছিন্নমুল গৃহহীন কোহিনুর বেগম, মুক্তা হাওলাদার, সাউথখালীর গাবতলা এলাকার জয়তুন বিবি ও রহমত আলী বাংলানিউজকে জানান, গত পাঁচ বছরেও তারা ঘরবাড়ি পুননির্মাণের কোনো সহায়তা পাননি। তাদের অভিযোগ, ক্ষতিগ্রস্তদের গৃহনির্মাণসহ পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হলেও বাঁধের বাইরে অবস্থানরত পরিবারের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার মহিষচরণী গ্রামের ৬০ ঊর্ধ্ব হায়াতুন বেগম বাংলানিউজকে বলেন, “সিডরের পর অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছি, কিন্তু কেউই মাথা গোঁজার ঠাইটুকু পুনঃনির্মাণে সহায়তা করেনি। এখন ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে ছেলে বউ ও নাতি নিয়ে বসবাস করছি।”

খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সোহরাব আলী সানা বাংলানিউজকে জানান, সরোয়ার খালি ক্লোজারটি মেরামত ও দক্ষিণ বেদকাশীর মানুষের যাতায়াতের রাস্তাগুলো সংস্কারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনি আশা করেন, দ্রুতই এসব দুর্গত মানুষের দুঃখ লাঘব হবে।

খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আজও সিডরের নাম শুনলে আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। এখনো তারা স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। গৃহহারা মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। তাদের মাথা গোজার ঠাঁই এখনো হয়নি। সরকার এবং দাতা দেশগুলো সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সুন্দরবনসহ বৃক্ষরাজি এবং পরিবেশকে বাঁচাতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

খুলনা নাগরিক ফোরামের সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট এম ফিরোজ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, “সিডরের ৫ বছর পূর্তি হলেও দুর্গত মানুষের দুঃখ লাঘব হয়নি। একের পর এক দুর্যোগ উপকূলবাসীকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।”

তিনি এসব দুর্গত মানুষের সহযোগিতায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে আরও বেশি সহযোগিতা করার আহবান জানান।

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়