ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নাজিমুদ্দিন শামীমারাই ‘আসল বাংলাদেশ’

নিজামুল হক বিপুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪৫, ২৯ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নাজিমুদ্দিন শামীমারাই ‘আসল বাংলাদেশ’

আমাদের দেশে ইস্যুর শেষ নেই। প্রতিদিনই নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হয়। সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। এখন তো করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করেই হরেক রকম ইস্যু তৈরি হচ্ছে। ত্রাণের চাল চুরি, চুরির অভিযোগে চেয়ারম্যান-মেম্বার বরখাস্ত, গ্রেপ্তার। কেউ কেউ তো চাল চুরি করে নিয়ে যাবার সময় হাতেনাতে ধরাও পড়েছেন। এরকম আরও অনেক ইস্যু আছে।

এই করোনাকে ঘিরেই আছে রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজি। এসব ইস্যু নিয়ে লিখতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যাবে। কিন্তু এসব ইস্যুর বাইরে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরও অনেক ইস্যু। যেগুলো খুব কমই আলোয় আসে। আবার যেগুলো প্রকাশিত হয় সেগুলো নিয়ে দু’চারদিন মাতামাতির পর অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

এই করোনাকালে ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াটা আমার মনে ভীষণ দাগ কেটেছে। আমার ধারণা, আমার মতো সারাদেশের আরও অনেক মানুষের মনেও জায়গা করে নিয়েছেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ নাজিম উদ্দিন। পেশায় ভিক্ষুক হলেও তিনি যে বিশাল হৃদয়ের মানুষ তাতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। অন্তত আমার নেই। এই নিদানকালে অসহায় মানুষের কষ্ট বুঝার মতো ক্ষমতা যিনি রাখেন, যিনি তিল তিল করে সঞ্চয় করা অর্থ হাসিমুখে বিলিয়ে দেন মানুষের জন্য তার চেয়ে বড় মনের মানুষ তো আর কেউ হতে পারে না।

শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার গান্ধীগাঁও গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ নাজিম উদ্দিন। ভিক্ষাবৃত্তি করেই সংসার চালান। ভিক্ষা করে যা আয় করেন সেখান থেকে একটু একটু করে টাকা জমাতেন। উদ্দেশ্য একখানা ঘর বানানো। বিন্দু বিন্দু করে তিনি ১০ হাজার টাকা জমিয়েছেন। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে তার আর ঘর তোলা হলো না। ভিক্ষা করতে গিয়েই তিনি জানতে পেরেছেন দেশে রোগবালাই দেখা দিয়েছে। এই রোগবালাইয়ের কারণে মানুষ ঠিকমত কাজ করতে পারছে না। আয় রোজগারও হচ্ছে না। ফলে নিজেও খেতে পারছে না, স্ত্রী-সন্তানদের মুখেও খাবার তুলে দিতে পারছে না। বিষয়টা তার মনে ভীষণ পীড়া দিয়েছে। তার বিবেককে নাড়া দিয়েছে। না খেয়ে থাকা মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে, তাদের সাহায্য করতে তিনি উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তিনি নিজে ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালান। অথচ তার পরাণ কাঁদছে অসহায় মানুষের জন্য। তিনি জমানো ১০ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য ছুটে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে এবং সেই টাকা তার হাতে তুলে দেন। এই হলো তার কলিজা!

অথচ আমাদের দেশে এখন কোটিপতি তো বটে, শত কোটিপতি, হাজার কোটিপতির অভাব নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ৭৫ হাজার। এর মধ্যে শত কোটিপতির সংখ্যা কমপেক্ষ ২০ হাজার। প্রত্যেক জেলায়ই কমবেশি এরকম ধনীক শ্রেণীর মানুষ আছে। যারা চাইলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। তাহলে এই করোনাকালে একজন মানুষও না খেয়ে থাকবে না। কিন্তু গত এক মাসেরও বেশি সময়ে আমরা দেখলাম, খুব কমসংখ্যক সম্পদশালী সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। ধনী, বিত্তশালী, কোটিপতিদের বড় অংশই নিজেদের আড়াল করে রেখেছেন। আসলে ধন-সম্পদ, অর্থ-বিত্ত হলেই হয় না। লাগে কলিজা, আকাশের মতো খোলা হৃদয়। যা নাজিম উদ্দিনের আছে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। ঘুরছে না কলকারখানার চাকা। শ্রমিকের হাত অলস বসে আছে। নেই রেমিটেন্স। সব খাতেই অশনি সংকেত। করোনা উত্তর দেশের অর্থনীতি কী হবে- এ নিয়েই এখন বিস্তর আলোচনা। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে কৃষি। কৃষিনির্ভর আমাদের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে বোরো ফসল। সেই ফসল ঘরে তোলা নিয়ে যখন শঙ্কা, ঠিক তখন আমরা দেখেছি হাওরে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের দুই একজন। দাঁড়িয়েছে ছাত্রলীগও।

এমনই একজন হচ্ছে শামীমা শাহরিয়ার। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য। চলতি মাসের শুরুর দিকে তিনি ছুটে গেছেন তার নিজের এলাকা সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ-ধরমপাশার মানুষের কাছে। কৃষকের পাশে। হাওরের বুকে সোনালী ফসলের মৌ মৌ গন্ধ নিতে কৃষকরা যখন উদগ্রীব তখন তারা শ্রমিক পাচ্ছিলেন না মাঠের ফসল ঘরে তোলার। শামীমা শাহরিয়ার নিজে হাওরে গিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিজে হাতে কাঁচি নিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। এই নিদানকালে তিনি কৃষকের জন্য রান্না করে খাবার নিয়ে গেছেন মাঠে। খোলা আকাশের নিচে কৃষকের সঙ্গে বসে সেই খাবার খেয়েছেন।

তার পাশাপাশি সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক(ডিসি)সহ স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাহস যুগিয়েছেন। এই দুর্যোগে কৃষক যেন ভেঙে না পড়েন সেজন্য ডিসি নিজে ধান কেটে কৃষকদের উৎসাহ দিয়েছেন। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও কৃষকের ধান কেটে দিয়েছেন। এটা আমাদের আশাবাদী করে তোলে।

কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও আছে। দেশে ভোট আসলেই আমরা বহু লোককে দেখি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতীক নিয়ে সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে। এদের কেউ কেউ নির্বাচিত হন। কেউবা পরাজিত হন। কিন্তু এই করোনাকালে, এই মহামারির সময়ে, এই দুর্যোগে, দুঃসময়ে এসব জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগকেই দেখা যাচ্ছে না। যারা নির্বাচীত হন নাই তাদেরকে তো পাওয়াই যাচ্ছে না। কিন্তু যারা নির্বাচিত, যাদের হাতে অপার ক্ষমতা আছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, মানুষের জন্য কিছু করার, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার- সেই জনপ্রতিনিধিদের বেশির ভাগের ছায়াটাও দেখা যাচ্ছে না। তারাও যেন লকডাউনে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন।

অথচ শামীমা শাহরিয়ার বা তার মতো অন্য যে কয়জন জনপ্রতিনিধি করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে যদি ঘর থেকে বের হতে পারেন, দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন- তাহলে অন্যরা কেন পারেন না বা পারবেন না? আসলে প্রয়োজন সদিচ্ছা, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা।

এই করোনাকালে দেশের মানুষের একটা বড় অংশ বেশ আর্থিক সংকটে পড়েছে বা পড়তে যাচ্ছে। এর মধ্যে শহরে বসবাসকারী মধ্যবিত্ত, নির্দিষ্ট এবং স্বল্প আয়ের মানুষের সংকট সবচেয়ে বেশি। তারা শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। এদের অনেকেই এখন বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করা নিয়ে আছেন সংকটে। ইতোমধ্যে বাড়ি ভাড়া না দেওয়ার কারণে বাড়িওয়ালা কর্তৃক বাসা থেকে বের করে দেওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যেও ব্যতিক্রম আছে কিছু মানুষ। তাদেরই একজন রাজধানীর সায়েদাবাদের বাড়িওয়ালা শেখ শওকত আলী। তিনি দুটি বাড়ি ও কয়েকটি দোকান ঘর থেকে ভাড়া পান মাসে প্রায় চার লাখ টাকা। দুই মাসের ভাড়া তিনি নেবেন না জানিয়েছেন। আরেক বাড়িওয়ালা লালবাগ এলাকার মোয়াজ্জেম হোসেন অপু। তিনি ছাত্রলীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। তিনি তার চারটি বাড়ির ভাড়াটিয়াদের এপ্রিল-মে মাসের ভাড়া নেবেন না জানিয়েছেন। যেখান থেকে তিনি মাসে পেতেন চার লাখ টাকার বেশি। এরকম ঢাকা চট্টগ্রাম, সিলেটসহ অনেক শহরেই বেশ কিছু বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া না নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এরকম যদি প্রতিটি শহরের বিত্তশালী বাড়িওয়ালারা তাদের ভাড়াটিয়াদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, দয়ালুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তাহলে দেশের মানুষের একটা বড় অংশ উপকৃত হবে নিঃসন্দেহে। তাদের আচরণেই ফুটে উঠবে অন্য এক বাংলাদেশের চেহারা।

এই দুঃসময়ে, দুর্যোগকালে, মহামারির সময়ে নাজিমুদ্দীন, শামীমা শাহরিয়ার, মোয়াজ্জেম হোসেন অপু, শওকত, সুনামগঞ্জের ডিসি’রাই হচ্ছেন আসল বাংলাদেশ। আসল মানুষ। খাঁটি দেশপ্রেমিক।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়