ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

চীন ভারত যুদ্ধ: কে কার পক্ষে

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ২৭ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
চীন ভারত যুদ্ধ: কে কার পক্ষে

বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোর মধ্যে রেষারেষি নতুন নয়। চীন এবং ভারত উভয় দেশই পরমাণু অস্ত্রসমৃদ্ধ। সম্প্রতি দুই দেশের প্রবল উত্তেজনা এবং যুদ্ধাবস্থা বিশ্বে হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত বিশ বছর দুই দেশই সমরাস্ত্র তৈরির পাশাপাশি অস্ত্র আমদানি করেছে। ভারত টানা পাঁচ বছর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। এদিকে অস্ত্রের বাজারে চীনের আধিপত্যও কম নয়।

ভারত-চীন নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয় লাদাখে দুই দেশের সেনাদের সংঘর্ষের কারণে। এরপর কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে প্রাথমিক শান্তির বার্তা এলেও কেউ নিজ অবস্থান থেকে সরে আসেনি। চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে ভারতের অভ্যন্তরে চীনবিরোধী মনোভাব প্রবল হচ্ছে। চীনা পণ্য বয়কটের ডাক উঠেছে। কিন্তু বাস্তবতা আসলে কতটুকু? বেশ কয়েক বছর ধরেই চীন তার বলয় শক্তিশালী করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যা চীনবিরোধীদের মাথাব্যথার বড় কারণ। যদিও ভারত এবং চীনের সংঘাত নতুন নয়।

১৯৬২ সালে অরুণাচল ও আকসাই নিয়ে দুই দেশের সীমান্তে যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে চীনা সেনাবাহিনী এই দুটি অঞ্চল দখল করে নেয়। পরে চীন অরুণাচল ভারতকে ফিরিয়ে দেয়। এর পাঁচ বছর পর ১৯৬৭ সালে নাথুলা ও চাওলার যুদ্ধে চীন পরাজিত হয়। ১৯৮৭ সালে অরুণাচলের সুলুলা ও বুমলাতে দুই দেশের সেনা পুনরায়  মুখোমুখি হয়। ভারতের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী এনভি তিওয়ারি বেইজিং গেলে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। ২০১৩ সালে ফের নিয়ন্ত্রণ রেখায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। ২০১৭ সালে ডোকালামে ৭৩ দিন মুখোমুখি অবস্থানে থাকে দুই দেশের সেনাবাহিনী। সে বছর মে মাসে পেংগং লেকের পাশে পাথর ছোড়াছুড়ি ও হাতাহাতিতে জড়ায় দুই দেশের সেনারা। সুতরাং এই উত্তেজনা নতুন নয়।

বর্তমান সময়ে কোনো দেশ বিশেষ করে সমরাস্ত্র সক্ষমতাসম্পন্ন দেশগুলো একটি বলয়ের ভেতর থেকে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। অবশ্য ভারতের সঙ্গেও রাশিয়ার সম্পর্ক মধুর। এদিকে পাকিস্তান এবং মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা বেশি। তবে নেপাল ও ভুটানের সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কে চিড় ধরিয়েছে বলেই মনে হয়। যা ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্বের ভেতরেই এই উদ্যোগ অনেক প্রশ্ন জন্ম দিচ্ছে। ভারত লিপুলেখের সঙ্গে তিব্বতের মানস সরোবরে যাওয়ার নতুন রাস্তা তৈরি করতে গেলে নেপাল প্রতিবাদ জানায়। অথচ দুই বছর ধরে রাস্তা নির্মাণের কাজ চললেও নেপাল তখন কিছু বলেনি।

তাছাড়া উত্তরাখন্ডের তিনটি বিতর্কিত এলাকা নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভূক্ত করে নেপাল ভারতকে তো বটেই বিশ্ববাসীকেও অবাক করে দিয়েছে। অনেকে মনে করেন এর পেছনে হয়তো চীনের হাত রয়েছে। এদিকে ভুটানও যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাও বেশ অবাক করার মতো। ভারতীয় চাষীদের পানি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে ভুটান গণমাধ্যমে দাবি করেছে। যদিও সেচের পানি আটকে দেওয়ার খবরকে গুজব বলে দাবি করেছে ভুটান। ভারতীয় কর্তৃপক্ষও স্বীকার করছে প্রাকৃতিক কারণেই পানি আটকে গিয়েছিল এবং বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সে হিসেবে একসঙ্গে চার প্রতিবেশীর না হলেও তিন প্রতিবেশীর (চীন, পাকিস্তান, নেপাল) চাপের মুখে রয়েছে ভারত। এই ঘটনাকে তাই ভিন্নভাবে দেখছে না কেউ।

ভারত যেমন প্রতিবেশীদের নিয়ে বিরূপ অবস্থার মধ্যে রয়েছে, চীনও খুব একটা শান্তিতে নেই। দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বাড়ানোকে কেন্দ্র করে জাপানের সঙ্গেও চীনের সংঘাতের মাত্রা বেড়েছে। চীন সাগরের সামনেই প্যাট্রিয়ট পিএসি থ্রি এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করেছে জাপান। সরাসরি যার লক্ষ্য চীনের দিকে। জাপান জানিয়েছে, চলতি মাসের মধ্যেই চারটি সেনাঘাটিতে পিএসি থ্রি এমএসই মিসাইল বসানো হবে। চীন সীমান্তে জাপান সেনার সংখ্যাও বেড়েছে। আবার মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট মাইক পম্পেও বলেছেন, ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জন্য চীন বিপজ্জনক হয়ে ওঠাই ইউরোপ থেকে সেনা সরানোর অন্যতম কারণ। চীনা হুমকি সামলাতে এশিয়ায় সেনা বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, যুদ্ধে জড়িয়ে পরাটা ভারত বা চীন কারও জন্যই সুখকর হবে না। এমনকি তা এশিয়ার জন্যও দুর্ভোগ ডেকে আনবে। এর একমাত্র সমাধান আলোচনা। যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সর্বশেষ আলোচনার পর দুই দেশ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে সেনা সরাতে রাজি হয়েছে। কিন্তু উপগ্রহ চিত্রে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ১৫ জুন হওয়া সংঘর্ষ স্থলের কাছে চীনের বড় মাপের নির্মাণ কাজ চালোনোর ছবি ধরা পড়েছে। ফলে ভারত সীমান্তে আরও সৈন্য পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। এতে বোঝা যায় যত সহজে সমস্যার সমাধান হবে ভাবা হয়েছিল বিষয়টি অতটা সহজ হবে না। কিন্তু যুদ্ধ এড়াতে হলে দুই দেশকেই অতীতের হিসাব মেলাতে হবে। কারণ দুই দেশের এই সীমান্ত অস্থিরতা কেবল দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ছড়িয়ে পড়বে বিশ^ব্যাপী।

এর মধ্যে করোনা পরিস্থিতি বড় ভূমিকা রাখবে। চীন করোনা পরিস্থিতি সামলে উঠলেও ভারত হিমশিম খাচ্ছে। যাই হোক, ভারত-চীনের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও উদ্বিগ্ন। তিনি সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়েছেন। রাশিয়াও দুই দেশের মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, দুই দেশই হয়তো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে না। কারণ যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। বিশেষ করে এই করোনাকালে নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ হতে চাইবে না। এখন সমাধান একটাই। দুই দেশেরই উচিত কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা। 

লেখক: সাংবাদিক

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়