ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কামাল লোহানীর বিপ্লব-মন্ত্রের প্রথম পাঠশালা

এম আবদুল আলীম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১১ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
কামাল লোহানীর বিপ্লব-মন্ত্রের প্রথম পাঠশালা

রাজপথে স্লোগানে মুখর তরুণ কামাল লোহানী

কামাল লোহানী (১৯৩৪-২০২০) বিপ্লব-মন্ত্রের প্রথম পাঠ গ্রহণ করেছিলেন পাবনা শহর থেকে। পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়ার দিকের কথা। কলকাতা পার্ক সর্কাস থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে চলে আসেন পূর্ববঙ্গে, থিতু হন ছোট চাচা তাসাদ্দুক হোসেন লোহানীর পাবনা শহরের হেমসাগর লেনের বাসায়। তাসাদ্দুক হোসেন লোহানী তখন ছিলেন পাবনা জেলা স্কুলের শিক্ষক। ছোট্ট কামাল লোহানীকে এই স্কুলেই ভর্তি করা হলো। কেমন ছিলো সেই দিনগুলো?

কামাল লোহানীর বাল্যকালের সহপাঠী ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘কলকাতায় সিনেমা তৈরি হতো তখন। আর সেই কলকাতা থেকেই আমাদের ক্লাশে পড়তে এলো কামাল। ওরা থাকতো পার্ক সার্কাসে; লোহানী স্যার ছিলেন কামালের চাচা। কামাল চাচার বাসায় এসে উঠলো। জরির কাজ করা টুপি আর শেরোয়ানি পাজামা মিলিয়ে কামাল ছিলো একেবারে আলাদা। আমাদের কাছে পার্ক সার্কাসের গল্প করতো যখন, তখন ভারি ভালো লাগতো।’ (ইচ্ছামতীর সোনালি-রুপালি)

পাবনা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাসের সূত্র ধরে এর সঙ্গে আত্মিক বন্ধন স্থাপিত হয় শিশু কামাল লোহানীর। তখন পাবনা শহর পাকিস্তানি ভাবধারার উত্তাল জোয়ারে ভাসলেও ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবারের সন্তান কামাল লোহানী তাতে গা ভাসালেন না; বরং হাঁটা শুরু করলেন উজানপথে। পাবনা জেলা স্কুলে এই পথের পথিক তথা সহপাঠী হিসেবে পেলেন আব্দুস সামাদ (মেজর জেনারেল), আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কুতুব উদ্দিন, ফজলে হাসান আবেদ (ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা) প্রমুখকে। পেলেন উদার সংস্কৃতিমনা স্কাউট শিক্ষক মওলানা কসিমউদ্দিন আহমেদকে (মুক্তিযুদ্ধে শহিদ)। এর মধ্যে উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি করে প্রগতিশীল রাজনীতির দুর্গ পাবনা শহরে এলো ভাষা-আন্দোলনের ঢেউ। ভাষা-আন্দোলন পূর্ববঙ্গের তরুণসমাজের মধ্যে যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিলো, তা কিশোর কামাল লোহানীকেও জাগিয়ে তুললো। সেই জাগরণের মূলে ছিলো ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ভাষা-সংস্কৃতিকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবোধ। একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনা পাবনা জেলা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র কামাল লোহানীকে পড়ার টেবিল থেকে নিয়ে আসে রাজপথে। সে-বয়ান শোনা যাক তাঁর লেখা থেকেই : ‘আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী, ছাত্রহত্যার খবরটা শোনার পর আমার মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিলো। পরদিন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে যে-মিছিল বেরিয়েছিল পাবনায়, অন্যান্য জেলার মতো, সেখানে আমি স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করেছিলাম।... তীব্র ক্ষোভ জন্মেছিলো আমার মনেও। সেই থেকেই রাজনীতির জন্ম আমার মনে।... সেই সে ক্ষোভ ক্রোধে পরিণত হয়ে আমার মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটালো এক নতুন অভিজ্ঞানের।’ (স্মৃতিচৈতন্যে পাবনা)

তারপর থামতে হয়নি তাঁকে। ভাষা-আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ স্তিমিত হয়ে এলে কামাল লোহানী ১৯৫২ সালের শেষদিকে ভর্তি হন এডওয়ার্ড কলেজে। এ কলেজ তখন ছিলো মেধাবী তরুণদের বিপ্লব আর নবচেতনায় জেগে ওঠার পীঠস্থান। সহপাঠী হিসেবে পেলেন এক ঝাঁক মেধাবী তরুণদের, যাঁদের হাতে ছিলো প্রগতিশীল রাজনীতির ঝাণ্ডা আর চেতনায় ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদী অগ্নিমন্ত্র। সেই তরুণদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- আব্দুল মতিন (লাল মিয়া), এইচ টি ইমাম, জিয়া হায়দার, রণেশ মৈত্র, জয়নাল আবেদীন খান, মোজাম্মেল হক, এম এ সামাদ প্রমুখ। এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়েই প্রগতিশীল এই তরুণরা ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে আলাদা প্যানেল দেন এবং একটি পদ বাদে পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভ করেন। কামাল লোহানী বিজয়ী হন সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে।

১৯৫৩ সালে ‘শিক্ষা ঐক্য শান্তি ও প্রগতি’ স্লোগান নিয়ে পাবনা শহরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের শাখা গঠিত হলে কামাল লোহানী ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হন। ঐ বছর পাবনা শহরে ঘটে আরেক ঐতিহাসিক প্রতিবাদী ঘটনা। ২১ ফেব্রুয়ারির কয়েকদিন আগে পাবনা স্টেডিয়ামে আহ্বান করা হয় মুসলিম লীগের সম্মেলন। সে-উপলক্ষে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন, পূর্ব পাকিস্তানের দেশরক্ষা মন্ত্রী আবদুর রব নিশতার, পাকিস্তান মুসলিম লীগ নেতা খান আবদুল কাইউম খান, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আফজাল প্রমুখ নেতা এ-উপলক্ষ্যে পাবনায় আসার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ভাষা শহিদদের রক্তে যার হাত লাল, সেই খুনি নূরুল আমীনের পাবনায় আগমন প্রতিহত করতে প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ও ছাত্রসমাজ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন এ সম্মেলন ভণ্ডুল করার। ১২ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পাবনা স্টেডিয়ামে বিশাল প্যান্ডেল তৈরি করা হয়। এদিকে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঐ দিন খুব ভোরে নদীপথে নূরুল আমীন পাবনায় আসেন। এ খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে কামাল লোহানীসহ ছাত্রনেতারা এডওয়ার্ড কলেজ হোস্টেল থেকে কয়েকটি কুকুরের গলায় কাপড় ঝুলিয়ে তাতে মোটা অক্ষরে লিখে দেন ‘নূরুল আমীন’। এই প্রতিবাদী কর্মসূচির মাধ্যমে শহরবাসীকে বার্ত দেওয়া হয় কুকুরবেশী নূরল আমীন পাবনায় এসেছে, তাকে প্রতিহত করতে হবে। তখন ছাত্র-জনতা এবং সর্বস্তরের মানুষ মিছিল নিয়ে পাবনা স্টেডিয়ামের দিকে অগ্রসর হয়। এক পর্যায়ে তাঁদের সঙ্গে মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং নূরুল আমীনসহ মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সেই কর্মসূচি ভণ্ডুল হয়ে যায়। এ ঘটনায় কামাল লোহানীসহ ৬৯ জন ছাত্রনেতা ও রাজনীতিবিদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাঁদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়। এটা ছিল তাঁর প্রথম কারাগারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা।

১৯৫৩ সালে কারামুক্ত হয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানারে পুরোদমে শুরু করেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেন ছাত্র, তরুণ, যুবক এবং শ্রমিকদের। পাবনার রাজপথে বিশাল বিশাল শোভাযাত্রা বের করে মুসলিম লীগের দুঃশাসনের ভীত কাঁপিয়ে তোলেন। এর মধ্যে একুশের চেতনার মশাল প্রজ্বলিত করে আসে চুয়ান্নর নির্বাচন। কামাল লোহানী ও তাঁর সহযোদ্ধারা যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কোমর বেঁধে নামেন। আওয়ামী লীগ নেতা এম মনসুর আলী, আবদুর রব বগা মিয়া, আমজাদ হোসেন প্রমুখের সঙ্গে পরামর্শ করে গঠন করেন ‘সর্বদলীয় কর্মশিবির’। কথকতা, নাটিকা, গান প্রভৃতি রচনা করে নির্বাচনী প্রচার চালান। এসব রচনার মূলে থাকতো বায়ান্নর শহিদদের রক্তশপথ আর তিতুমীরের লড়াই, তেভাগা আন্দোলন ও চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের প্রেরণা। এ সময় রাজনীতির পাশাপাশি পাবনার সাংস্কৃতিক অঙ্গনও সরগরম হয়ে ওঠে। অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতে আয়োজন করা হয় রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী। রূপবানী শিকদার, ব্রজেন বসাক, শম্ভু জোয়ার্দার প্রমুখ শিল্পীর গানে মুখরিত হতে থাকে পাবনা টাউন হল প্রাঙ্গণ। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতার অংশবিশেষ (হে মহামানব একবার এস ফিরে, এই গ্রামনগরের ভিড়ে, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো) সুর দিয়েছিলেন তরুণ শিল্পী শম্ভু জোয়ার্দার। এমন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জাগরণের মধ্যে কামাল লোহানী ও তাঁর সঙ্গীরা যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচারের জন্য লিফলেট, পোস্টার মাইক আর চুঙো হাতে ছুটে বেরিয়েছেন পাবনার গ্রাম-গঞ্জ, কল-কারখানা এবং ক্ষেত-খামারে। এই নির্বাচনী আমেজের মধ্যেই ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রেফতার করা হয় কামাল লোহানীকে। নির্বাচনে বিজয়ের পর মুক্তিলাভ করেন এবং ১৯৫৪ ৯২-(ক) ধারা জারির মাধ্যমে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন হলে ৩০ মে আবারও গ্রেফতার হন। ১৭ মাস কারানির্যাতন ভোগ করে মুক্তিলাভের পর ১৯৫৫ সালে ঢাকায় চলে যান এবং যুক্ত হন সাংবাদিকতা এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে।

কামাল লোহানী পরবর্তীকালে স্বাধিকার-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন। একজন গণমুখী সাংবাদিক এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নিজের চেতনা, বিশ্বাস ও আদর্শে আজীবন অটল থেকেছেন। এই তেজস্বী মানুষটিকে তৈরি করেছিলো পাবনা শহর। পাবনা জেলা স্কুল, এডওয়ার্ড কলেজ, অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি, শিখা সংঘ, পাবনা জেলখানা, এসডিও কোর্ট, জিন্নাহ স্টেডিয়াম (বর্তমানে শহিদ আমিন উদ্দীন স্টেডিয়াম), টাউন হল, কোতোয়ালি থানা, এ হামিদ রোড প্রভৃতি স্থান ছিল কামাল লোহানীর বিপ্লবমন্ত্র গ্রহণের এক একটি শ্রেণিকক্ষের মতো। পাবনা শহরের হোসিয়ারি, বিড়ি ও রিকশা শ্রমিক সংগঠনের  নেতা-কর্মীদের সান্নিধ্যে সেই কৈশোরেই তিনি লাভ করেছিলেন শোষিত মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগ থেকে মুক্ত করার প্রেরণা। প্রগতিশীল রাজনীতিক অমূল্য লাহিড়ী, সেলিনা বানু, বাবর আলী, আমিনুল ইসলাম বাদশা, প্রসাদ রায়, জসিম মণ্ডল প্রমুখের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সান্নিধ্যে তাঁকে দেয় সমাজতন্ত্রের দীক্ষা। সারাজীবন সে-আদর্শ লালন করেছেন। পাবনার মাটি থেকে কামাল লোহানীর বিপ্লবমন্ত্রের প্রথম পাঠগ্রহণ বিষয়ে এতক্ষণ যে আলোকপাত করলাম তার ইতি টানি স্বয়ং কাথামালা দিয়েই।

‘স্মৃতিচৈতন্যে পাবনা’ শীর্ষক লেখায় কামাল লোহানী দ্বিধাহীন চিত্তে উচ্চারণ করেছেন: ‘‘এই সেই পাবনা, যেখানে ভারত বিভাগের পর আমরা পাকিস্তানি হয়ে গেলাম এবং এ শহরে চলে এসেছিলাম। এই শহরই আমাকে শৃঙ্খল ভাঙার পথ দেখিয়েছিল সেদিন। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। পড়তে পেতাম সাপ্তাহিক ‘মতামত’, পাক্ষিক ‘মুখপত্র’ এবং মাসিক ‘নতুন সাহিত্য’। স্বপ্ন দেখতাম নতুন দুনিয়া গড়ার। পাবনার তৎকালীন সংগ্রাম আমাকে কর্মী, সংগঠক, বক্তা, আবৃত্তিকার ও চোঙা ফোঁকা শিখিয়েছে। ... আমাকে নির্ভীক, সৎ ও কর্মনিষ্ঠ হতে শিখিয়েছে। ... সেই পাবনা আমার চৈতন্যে সদা জাগরুক হয়ে আছে এবং থাকবে।’’

গত ২০ জুন কামাল লোহানী প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়