ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

অজপাড়ার ছেলে পৌঁছেছিলেন বিজ্ঞানের শিখরে

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৮, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অজপাড়ার ছেলে পৌঁছেছিলেন বিজ্ঞানের শিখরে

হাসান মাহামুদ : বাংলাদেশ শিল্পায়নের দিকে এগুচ্ছে খুব বেশি দিন আগে থেকে নয়। এখনো আমাদের নীতিনির্ধারক শ্রেণি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়েও গ্রাম থেকে উঠে আসা অসংখ্য মানুষ পাওয়া যায়। গ্রাম থেকে উঠে এসে তারা সফল হয়েছেন। তবে নগরায়ন এবং রাজধানী ঢাকার দিকে মানুষ যে হারে ঝুঁকছে, তাতে বোধকরি গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষের সংখ্যা এক সময় কমে আসবে।

কয়েক বছর আগেও দেশে অনেক গ্রাম ছিল, যেখানে বিদ্যুতের আলো বা ডিজিটাল ছোঁয়া লাগেনি। যাকে আমরা ‘অজপাড়া গাঁ’ বলি। এ সংখ্যা এখন অনেক কমে আসছে। এই তো গত বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেক সভায় বলেছিলেন, আর তিন বছর পর দেশে বাঁশের সাঁকো থাকবে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তায়ও কালভার্ট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর থেকে সহজে অনুমেয়, অচিরে গ্রামগুলো পূর্বের চেহারা হারাবে।

তবে এ উৎকর্ষতার মধ্যেও একটি বিষয় ভাবাচ্ছে, তা হলো- যে হারে শিক্ষার হার বাড়ছে, সেই হারে কি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে? যে হারে জিপিএ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা, সে হারে কি জ্ঞানার্জন করছে তারা? প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এসব প্রশ্ন অবান্তর নয়, বরং সময়োপযোগী।

অথচ সেই ব্রিটিশ আমলে যখন আমরা শিক্ষা-দীক্ষায় একেবারেই পিছিয়ে ছিলাম, মাত্র কয়েক শতাংশ মানুষ লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারত, সেই সময়ে পদার্থ বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়ে গবেষণা ও তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা এক বাঙালি। তিনি অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা।

মেঘনাদ সাহার জন্ম ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকার কাছে শেওড়াতলী গ্রামে। গরিব ঘরে জন্ম তার। বাবা জগন্নাথ সাহা ছিলেন মুদি দোকানদার। ছেলেবেলায় সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে পড়েন এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঝুটা কাজের বিনিময়ে থেকে। অর্থাভাবে বহুপ্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে তার স্কুল শিক্ষা শেষ করেন। পরে তিনি ঢাকা কলেজ ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন।

ঢাকা থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে শেওড়াতলী গ্রাম। এ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ হতদরিদ্র। তাদের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দু’-একটি শ্রেণি পর্যন্ত। গ্রামের দরিদ্র মুদি দোকানি জগন্নাথ সাহা ও ভুবনেশ্বরী দেবীর ঘরে ভীষণ ঝড়বৃষ্টির রাতে জন্মেছিলেন বলে ঠাকুরমা নাম রেখেছিলেন মেঘনাথ। পরে স্কুলে যাবার সময় নাম বদলে মেঘনাদ করা হয়। আট ভাই-বোনের মধ্যে মেঘনাদ পঞ্চম। ছয় বছর বয়সে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করানোর পাশাপাশি মেঘনাদকে দোকানে নিজের পাশে বসিয়ে কাজও শেখাতে শুরু করলেন বাবা জগন্নাথ সাহা। তিনি সততই ভাবতেন, তার ছেলেদের এ দোকান চালিয়েই ভরণপোষণ চালাতে হবে। তাই ছেলে যদি স্কুলে একটু পড়তে এবং ছোটখাট হিসাব করতে শেখে, তাতেই কাজ চলবে।

কিন্তু দোকানে মন বসে না মেঘনাদের, মন পড়ে থাকে স্কুলের বইয়ে, অংকের খাতাতে। মেঘনাদের প্রতিভায় মুগ্ধ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা। প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তারা মেঘনাদের বাবাকে অনুরোধ করলেন- তার লেখাপড়া বন্ধ না করতে। কিন্তু বাবা ভাবলেন- অনেক হয়েছে, আর পড়াশোনার দরকার নেই। এবার ছেলে পুরোপুরি দোকানে বসুক। বড় ছেলে জয়নাথকে হাইস্কুল পর্যন্ত পড়িয়ে অনেক শিক্ষা হয়েছে তার। মাধ্যমিক-ই পাস করতে পারল না ছেলেটা। মাঝখান থেকে অতগুলো টাকা গচ্চা গেল। ম্যাট্রিক ফেল করে ছেলে এখন জুট মিলে কাজ করে মাসে ২০ টাকা পায়। সংসারের কী লাভ হলো তাতে? জগন্নাথ সাহা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন– মেঘনাদকে আর পড়াবেন না। অবশেষে, খারাপ ফলাফল করলে পড়াশুনা বন্ধ, এ শর্তে হাইস্কুলে ভর্তি হন কিশোর মেঘনাদ। নানান প্রতিবন্ধকতা, অর্থাভাব, আর সংগ্রামের মাধ্যমে পরবর্তী জীবনেও পড়াশুনা চালিয়ে যান মেঘনাদ। যার ফল তিনি পেয়েছিলেন অচিরেই।

বাংলাদেশের মাতৃভাষার সংগ্রাম আজ পৃথিবী জুড়ে স্বীকৃত। একুশে ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। এটি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের, গৌরবের। তেমনি গত কয়েক বছরে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল আমাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম বয়ে আনা মনীষীর যৎসামান্যই। তেমনি একজন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা। সেই ব্রিটিশ আমলেই তিনি এ অঞ্চলের নাম সারা বিশ্বে পরিচিত করেছিলেন। এমনকি তার প্রসঙ্গে প্রশংসা বাক্যও উচ্চারণ করে গেছেন আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানিও।

মেঘনাদ সাহা পদার্থবিজ্ঞানে থার্মাল আয়নাইজেশন তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাত। তার আবিষ্কৃত সাহা আয়নাইজেশন সমীকরণ নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মাবলী ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয়। আধুনিক জ্যোতি-পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে উঠেছে যে কয়জন মানুষের মৌলিক তত্ত্বের ওপর, অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা তাদের অন্যতম।

ভারতের বিকাশপিডিয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহার তাপীয় আয়নায়নের সমীকরণ (আয়নাইজেশন ইকুয়েশন) প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জ্যোতি-পদার্থবিজ্ঞানে যত গবেষণা হয়েছে, তাদের প্রায় সবগুলোই সাহার সমীকরণ দ্বারা প্রভাবিত। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পারমাণবিক তত্ত্ব থেকে শুরু করে বিগ-ব্যাং তত্ত্বের পরীক্ষণ পর্যন্ত সহজ হয়ে উঠেছে যে যন্ত্রের উদ্ভাবনের ফলে– সেই সাইক্লোট্রনের উদ্ভাবক নোবেল বিজয়ী আর্নেস্ট লরেন্সসহ অসংখ্য বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন মেঘনাদ সাহা তার কাজের মধ্য দিয়ে।’

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানি আর্নল্ড সামারফেল্ড, নীল্‌স বোর, ম্যাক্স বর্ন, আলবার্ট আইনস্টাইন, আর্থার এডিংটন, এনরিকো ফার্মি, আর্থার কম্পটন প্রমুখ দিকপাল মুগ্ধতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন মেঘনাদ সাহার অনন্য প্রতিভার কথা। মেঘনাদ সাহা পরমাণু বিজ্ঞান, আয়ন মণ্ডল, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা করেন। তাপীয় আয়নবাদ সংক্রান্ত তত্ত্ব উদ্ভাবন করে জ্যোতি-পদার্থবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে বিশ্বের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এবং ভারতের বিজ্ঞান-গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার ব্যাপারে মেঘনাদ সাহার অবদান অনস্বীকার্য। গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাওয়ার পাশাপাশি মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন চার বার। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্বমাপের বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার অক্লান্ত পরিশ্রমে। দেশে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান পড়ানো শুরু হয়েছে মেঘনাদ সাহার হাতে। নিরলস চেষ্টা ও পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন – সবগুলো সংগঠনই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই মেঘনাদ সাহার ‘টেক্সট বুক অব হিট’ বইটা পড়েছেন।

আজ থেকে ৬১ বছর আগে আজকের দিনে (১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি) এ মনীষী মৃত্যুবরণ করেন। দিনটি ছিল সরস্বতী পূজার দিন।

বাঙানি এ বিজ্ঞানি সারা দুনিয়ায় পরিচিত জ্যোতি-পদার্থবিদ হিসেবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মেঘনাদ সাহা পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। তিনি বিএসসি ও এমএসসি পাস করেছেন মিশ্র গণিতে। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পদার্থবিজ্ঞান শুধু শিখেছেন তাই নয়– ক্রমশ পৌঁছে গেছেন এ বিষয়ের শিখরে। উপমহাদেশে প্রথম সাইক্লোট্রন স্থাপিত হয় মেঘনাদ সাহার প্রচেষ্টায়। অধ্যাপক ও বিজ্ঞানি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও থেমে থাকেননি তিনি। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন তিনি। দরিদ্র অশিক্ষিত মা-বাবার সন্তান হয়েও মেধা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার জোরে একজন মানুষ যে কত বড় হয়ে উঠতে পারেন, মেঘনাদ সাহা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

লেখক: সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/হাসান/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়