ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

অপ্রতিরোধ্য আওয়ামী লীগ

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪২, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অপ্রতিরোধ্য আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিহাস গড়ে রেকর্ড টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগ বছরজুড়ে চমক দিয়েছে। কখনো সরকারে, কখনো দলে; ঘটনার পালাক্রমে বছরজুড়ে নেয়া পদক্ষেপগুলোতে প্রশংসিত হয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান বছরের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু।

আর বছরের শেষে সঠিক সময়ে সম্মেলন করে নতুনভাবে দল সাজিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ছড়িয়ে দিয়ে সাংগঠনিকভাবেও সফল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে রাজনৈতিক ময়দানেও একক শক্ত অবস্থানে আওয়ামী লীগ অপ্রতিরোধ্য দাপটই দেখিয়েছে।     

জয়ে শুরু

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগ বছরের শুরুতে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভার ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী এবং তিনজন উপমন্ত্রী বঙ্গভবনের দরবার হলে শপথ গ্রহণ করেন।

উপজেলা নির্বাচনে নৌকার জয়

জাতীয় নির্বাচনের পর পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনেও একক আধিপত্য দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। ৪৭৩টি উপজেলার নির্বাচনে ৩২০ জন চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আর ১৪৯টি উপজেলায় জিতেছে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী।

বিদ্রোহীদের শোকজ ও ক্ষমা

উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছিলেন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-সাংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় অনেক নেতা। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রায় ২০০ নেতা নৌকার বিপক্ষে নির্বাচন করেন। তাদের মদদদাতা হিসেবে প্রায় অর্ধশত সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। ১২ জুলাই আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে ‘বিদ্রোহী’ ও তাদের মদদদাতাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। তবে বন্যা, ডেঙ্গু ও শোকাবহ আগস্টের কারণে এ কার্যক্রম পিছিয়ে যায়। পরবর্তী সময় অধিকতর যাচাই-বাছাই শেষে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দেয়ার নির্দেশ দিয়ে দলীয় পদধারী ১৭৭ নেতার নামে ডাকে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠায় আওয়ামী লীগ। তবে শেষ পর্যন্ত শেষবারের মতো সতর্ক করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নিয়ে ক্ষমা করে দেয়া হয় তাদের।

বছরের শুরুতে ধাক্কা

চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সরকারের সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বড় ধাক্কা খায় দল। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সারা দেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি কিশোরগঞ্জ-১ (কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর উপজেলা) আসনে নৌকা প্রতীকে জয়ী হন। মৃত্যুকালে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।

কাদেরের অসুস্থতা ও ফিরে আসা

প্রয়াত সৈয়দ আশরাফের মৃত্যু শোক কাটতে না কাটতেই আবারো আঘাত আসে আওয়ামী লীগে। গত ৩ মার্চ ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ওই সময়েই তাকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু মেডিক‌্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসা দিতে দিতেই তার একটি হার্ট অ্যাটাক হয়। তারপর এনজিওগ্রাম করে দেখা যায়, তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক রয়েছে, যার একটিতে স্টেন্টিং করে দেয়া হয়। তার চিকিৎসার খোঁজ খবর নিতে আসেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষেদের সদস্য, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। চিকিৎসকেরা সিঙ্গাপুরে নেয়ার পরামর্শ দেন। তবে শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে সেদিন সেটা সম্ভব হয়নি। একদিন পর ৪ মার্চ ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে ঢাকায় আসেন উপমহাদেশের বিখ্যাত হৃদরোগ চিকিৎসক ডা. দেবী শেঠি। পরবর্তীতে তার পরামর্শে ওবায়দুল কাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে ২ মাস ১০ দিন পর অর্থাৎ ১৫ই মে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন তিনি।

ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহিত

বছরের মাঝামাঝিতে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনার খোরাক দেয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজির অভিযোগ ওঠার পর সংগঠন থেকে বাদ পড়েন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পান আল নাহিয়ান খান জয় এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান লেখক ভট্টাচার্য।

ক্যাসিনোকাণ্ড ও শুদ্ধি অভিযান

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে সেপ্টেম্বরে শুদ্ধি অভিযানে নামে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের মধ্যে শুরু করা এই অভিযান দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নিজ দলের মধ্যে থেকে দুর্নীতি বিরোধী এই অভিযান প্রশংসা পায় দেশের মানুষের কাছে। দাবি ওঠে প্রতিটি স্তরে এই অভিযান শুরু করার।

ক্যানিনোকাণ্ডে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। গ্রেপ্তার হন যুবলীগের ঢাকা মহানগর সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী  সম্রাট ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ হোসেন ভূঁইয়া। পরে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানকে দলকে ব্যবহার করে অবৈধ অর্থ ও সম্পদের মালিক হওয়ার অপরাধে সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হয়। কারাবন্দী হন কথিত যুবলীগ নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম।

সব মিলিয়ে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুদ্ধি অভিযানে বাদ পড়েন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথ। ৬ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ  যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেফতার করা হয়।

সহযোগী সংগঠনে প্রাণচাঞ্চল্য

আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে দীর্ঘদিন মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন করার নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী ২ নভেম্বর কৃষক লীগ, ৯ নভেম্বর শ্রমিক লীগ, ১৬ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ২৩ নভেম্বর যুবলীগের কাউন্সিল হয়। ঘোষণা করা হয় মহানগর উত্তর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তারিখ। ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মহানগর উত্তর-দক্ষিণ  আওয়ামী লীগে নতুন নেতৃত্ব আসে।

চমক জাগানিয়া সম্মেলন আওয়ামী লীগের

বছরের শেষে গত ২০ ও ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনে রেকর্ড টানা নবম বারের মতো আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পান শেখ হাসিনা আর দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। ৮১ সদস্য বিশিস্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে একাধিক চমক উপহার দিয়েছেন শেখ হাসিনা। নতুন নেতৃত্ব পেয়ে নেতা-কর্মীরাও নতুন উদ্যামে কাজ শুরু করেছে।

রাজনীতির মাঠে একক আধিপত্য

বছরজুড়ে বিভিন্ন ইস্যু পেলেও কার্যত রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সামনে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। ফলাফল মাঠে দাপট দেখায় আওয়ামী লীগ। বছরজুড়ে বিএনপি যতটা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়েছে, ঠিক তার বিপরীতে আওয়ামী লীগ ততটাই শক্তিশালী হয়েছে। যদিও দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়েছে এই সময়ে। কিন্তু সেটিতে বেশ ভালোভাবে ভারসাম্য রাখতে পেরেছে দলটি। বছরের একেবারে শেষে এসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ৩০ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রর কালো’ দিবস আখ্যা দিয়ে মাঠ গরম করতে চাইলে মাঠে দেখা যায়নি। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ ছিলো স্বরূপে। এদিন ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ দিবস পালন করে রাজনীতির মাঠে একক আধিপত্য দেখিয়েছে দলটি। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা সমাবেশও করেছে আওয়ামী লীগ। সেই সমাবেশ থেকে আন্দোলনের নামে যেকোনো নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার সতর্ক বার্তা দিয়েছে দলটি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আন্দোলন করুন। কিন্তু হিংসা-সহিংসতার পথে গেলে সমুচিত জবাব পেয়ে যাবেন। আর আন্দোলন যদি রাজনৈতিকভাবে করেন রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোও প্রস্তুত। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পাচঁ হাজার লোক জড়ো হয়ে যাবে। সেই শক্তি আওয়ামী লীগের রয়েছে।’

‘এই সরকারের শিকড় বাংলাদেশের মাটির গভীরে। এই সরকার এই দেশের মানুষের ভালোবাসার। কাজেই কচুপাতার ওপর শিশির বিন্দুর মতো একটা টোকা দিলেই সরকারের পতন হবে এই দিবাস্বপ্ন যারা দেখছেন তাদের রঙ্গিন খোয়াব অচিরেই কর্পূরের মতো উড়ে যাবে।’


ঢাকা/পারভেজ/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়