ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অরণ্যে বনমোরগের বিচরণ

মামুন চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অরণ্যে বনমোরগের বিচরণ

হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অপেক্ষাকৃত দুর্গম পাহাড়ি স্থানে অবস্থিত রেমা-কালেঙ্গা ও সাতছড়ি।

এরমধ্যে রেমা-কালেঙ্গা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ প্রাকৃতিক বনভূমি। এর আয়তন প্রায় ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর। এজন্যই সমৃদ্ধ মিশ্র চিরহরিৎ এ বনটি এখনো টিকে আছে।

অভয়ারণ্যটির আশেপাশে রয়েছে ৩টি চা বাগান। এ বনে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও পশুপাখির আবাসস্থল।

জরিপ মতে জানা গেছে, এখানে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ৭ প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।

আদিবাসী সম্প্রদায় ত্রিপুরা, সাঁওতাল ও উড়ং এই বনভূমির আশেপাশে এবং অভ্যন্তরে বসবাস করছে। বিরল প্রজাতির বাঘের বিচরণও রয়েছে এ জঙ্গলে। আছে বনমোরগ ও বনমুরগি। এ প্রাণিটি এ বনের ঐতিহ্য বহন করছে।

সাতছড়িতে উদ্ভিদবৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে দুইশতাধিক প্রজাতির গাছপালা। এর মধ্যে শাল, সেগুন, আগর, গর্জন, চাপালিশ, পাম, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, ডুমুর, জাম, জামরুল, জারুল, আওয়াল, মালেকাস, আকাশমনি, বাঁশ, বেত গাছ ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য।

জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ১৯৭ প্রজাতির জীব-জন্তু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর। আরো আছে প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখি।

এটি বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পাখিদের একটি অভয়াশ্রম। বনে লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, চশমাপরা হনুমান, শিয়াল, কুলু বানর, মেছোবাঘ, মায়া হরিণের বিচরণও রয়েছে।

সরিসৃপের মধ্যে সাপ, পাখির মধ্যে ধনেশ, বনমোরগ, লালমাথা ট্রগন, কাঠ ঠোকরা, ময়না, ভিমরাজ, শ্যামা, ঝুঁটিপাঙ্গা, শালিক, হলদে পাখি, টিয়া প্রভৃতির আবাসস্থল।

গাছে গাছে আশ্রয় নিয়েছে অগণিত পোকামাকড়। ঝিঁঝিঁ পোকা তাদের অন্যতম। পরিদর্শনে যে কেউ এসব অবলোকনে মুগ্ধ হবে।

এ ব্যাপারে বনগবেষক মো. আহমদ আলী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বনমোরগ ও বনমুরগি মানুষের পায়ের শব্দ পেলেই ত্বরিত বেগে পালিয়ে যায়। এরমধ্যেই কক্-কক্ ডাক শুনে আর একঝলকের দেখাতেই তৃপ্তি মেটাতে হয়। তারপরও মানুষের কবল নিজেদের রক্ষা করতে হিমশিম খেতে হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘স্থানীয় একশ্রেণির লোকেরা বনমোরগ-বনমুরগি শিকারে সুযোগে থাকেন। ঘরে পোষা মুরগি থাকা সত্ত্বেও বনের এই পাখির প্রতি এসব লোকদের লোভের সীমা নেই। সে কারণে কমে গেছে এদের সংখ্যা। পড়ে গেছে বিপন্ন পাখির তালিকায়।’

তিনি বলেন, ‘সিলেট বিভাগের চা-বাগানগুলো ও বন না থাকলে বনমোরগ প্রায় বিলুপ্তই হয়ে যেত। শিকারিরা চা-বাগানে ঢুকতে পারে না বলে ঘন চা-বাগানে এরা অনেকটা নিরাপদে থাকে। তবে প্রাকৃতিক বনে বাস করা শিকারিরা বনমুরগি শিকার তো করেই, উপরন্তু তাদের বাসা থেকে ডিমও সংগ্রহ করে। এ কারণে প্রাকৃতিক বনে এদের সংখ্যা কমছে।’

তিনি বলেন, ‘রেমা-কালেঙ্গা ও সাতছড়ি বনে এখনো বনমোরগের বসবাস আছে। এরা খুবই সতর্ক পাখি। খুব সকালে ও সন্ধ্যার আগে বনের কাছাকাছি খোলা জায়গায় খাবার খেতে বের হয়। দ্রুত দৌড়াতে পারে এবং উড়তে পারে।’

বাংলাদেশের সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম বিভাগের চিরসবুজ বন, চা-বাগান, শেরপুর ও মধুপুর শালবন ও সুন্দরবনে বনমোরগ বাস করে।

বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ায় বনমোরগ ও মুরগি দেখা যায়।

পাহাড়ের পাদদেশে ঘন প্রাকৃতিক ঝোপের ভেতর মাটিতে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এরা বাসা করে।

পাহাড়, টিলা, চা-বাগান ও প্রাকৃতিক ঘনবনের কাছাকছি নিরাপদ খোলামাঠে একাকি, জোড়ায় ও দলবদ্ধভাবে চরে বেড়ায়। প্রধানত, ফল, বীজ, শস্যকণা, কচিপাতা, কেঁচো ও কীটপতঙ্গ এদের খাদ্য। শীতের সময় কুয়াশা থাকা অবস্থায় খাদ্যের সন্ধানে বের হয়।

বনের কোনো গাছতলায় পাকা ফল ঝরে পড়া শুরু করলে বনমোরগ-বনমুরগি প্রতিদিন সকাল-বিকাল সেই গাছতলায় আসে। আবার বনের বড় গাছে উঠেও এদের ফল খেতে দেখা গেছে। দেখতে আমাদের গৃহপালিত মোরগ-মুরগির মতোই। তবে মোরগের লেজের দুটি পালক লম্বা থাকে।

ধারণা করা হয়, এরাই গৃহপালিত মোরগ ও মুরগির পূর্বপুরুষ। সুদূর অতীতে এশিয়া অঞ্চলে বনের এই পাখিকে পোষ মানানো হয়।

রেমা-কালেঙ্গা বনের কালিয়াবাড়ি আদিবাসী পুঞ্জির হেডম্যান বিনয় দেববর্মা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এ বনে প্রচুর বনমুরগি ও বনমোরগ রয়েছে। নানা সময়ে এদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা এগুলো রক্ষায় বন বিভাগকে সার্বিকভাবে সহায়তা করছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘এগুলো মাঝারি আকারের ভূচর পাখি। এদের মাথায় ঝুঁটি ও গলার দুই পাশে দুটি ঝুলন্ত লতিকা থাকে।’

সাতছড়ি বন্যপ্রাণি রেঞ্জ কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এ উদ্যানটি প্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ এখানে যাতায়াত সহজ। এখানে নির্মল প্রকৃতিতে বন্যপ্রাণির বিচরণ রয়েছে। রয়েছে বনমোরগের বিচরণ।’


হবিগঞ্জ/মামুন চৌধুরী/জেনিস

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়