ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মনোযোগী হওয়ার এখনই সময়

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ২২ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মনোযোগী হওয়ার এখনই সময়

হাসান মাহামুদ : বর্তমান বিশ্বে ‘বিশ্বায়ন’ উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী একটি বিষয়। একে বলা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ বিশ্ব অর্থনীতির চাবিকাঠি। বিশ্বায়নের বিশাল সুযোগ সুবিধাগুলো কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছে অধিকাংশ দেশ। আবার কেউ কেউ বিশ্বায়নের বিষয়টি ভীতির চোখেও দেখছেন। তারা মনে করছেন, এটি জাতি সমূহের মধ্যে বৈষম্য ও অসমতা বৃদ্ধি করে চলেছে। তাদের মতে, পাহাড়সম সম্পদের বৈষম্য, জীবন ধারনের মান ও কর্মের অসম প্রতিযোগিতা তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ভীষণভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে।  বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে দেখা কিংবা এর ভালো-মন্দ উভয় দিক সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সেই হিসেবে যুগোপযোগী চাহিদায় পরিণত হয়েছে বলা চলে।

এমনকি বাংলাদেশের মতো ক্রমবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশের জন্য বিষয়টি আরো বেশি ভাবনার। বিশ্বায়নের সবচেয়ে স্বীকৃত সংজ্ঞা হচ্ছে: ‘বিশ্বায়ন পারস্পরিক ক্রিয়া এবং আন্তঃসংযোগ সৃষ্টিকারী একটি পদ্ধতি, যা বিভিন্ন জাতির সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের মধ্যে সমন্বয় ও মিথস্ক্রিয়ার সূচনা করে’। এই পদ্ধতির চালিকাশক্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ, আর এর প্রধান সহায়ক শক্তি হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি।

বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার এবং অন্যতম ফোকাস বিষয় হচ্ছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়া। তাই তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়টি নিয়ে উদগ্রীব হতে হচ্ছে না আমাদের। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতিও খুব খারাপ নয়। বৈদেশিক বিনিয়োগও অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি আসছে দেশে। আমাদের ভাবনার জায়গাটি রয়ে গেছে ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য’ ঘিরে। বিশ্বায়নের প্রধান এই চালিকাশক্তিতে আমরা এখনো অপরের মুখাপেক্ষি- কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের অর্থনৈতিক পুর্নগঠন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) নামের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন করা এবং মুক্তবাজার অর্থনীতিকে গতিশীল করার উদ্দেশ্য ১৯৪৭ সালে জেনেভায় এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গ্যাট মূলত একটি বাণিজ্যিক চুক্তি। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে চুক্তিটিকে একটি বহুপাক্ষিক বাণিজ্য সংস্থায় রূপান্তর করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ প্রয়োজনেই ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত গ্যাটের কর্তৃত্ব আরো শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে চুক্তিটির আলোচনার মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা গঠনের উদ্যোগ শুরু হয়, অবশেষে ১৯৮৬ সালে গ্যাটের উরুগুয়ে রাউন্ড আলোচনার মধ্য দিয়েই চুক্তিটি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) রূপান্তর লাভ করে। ১৯৯৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১১৭টি দেশ এই চুক্তিতে সম্মত হয়।

বাংলাদেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। সংস্থার লক্ষ্য ছিল সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্য রক্ষা করা। কিন্তু বাণিজ্যিক ছাড়ের ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণে সংস্থাটি কার্যত ব্যর্থ হয়। যার বড় উদাহরণ ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা’ বা দোহা রাউন্ড নিয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়া। এজেন্ডার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার অধিকারী দরিদ্র দেশগুলোর সমান অংশগ্রহণ। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর আপত্তির কারণে ধনী-দরিদ্র দেশগুলোর মাঝে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষার এ আলোচনা আটকে যায়।

২০১৩ সালে অষ্টম মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠক শেষে কৃষি, শিল্পপণ্য এবং সেবাপণ্যে ও মেধাস্বত্ব আইনের ব্যাপারে মুক্ত বাণিজ্যের পথ খুলে দিতে ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। এ ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় কারণ ধনী দেশগুলো শুধু নিজেদের স্বার্থই দেখছে। যদিও দরিদ্র দেশগুলোর জন্য তারা মুখে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এটি যখন কৃষির ব্যাপারে আসে, দেখা যায় উন্নত দেশগুলো ভর্তুকি প্রত্যাহারে রাজি নয়। ২০০৮ সালের অক্টোবরে জেনেভায় অনুষ্ঠিত দোহা আলোচনা এ কারণেই ভেঙে গিয়েছিল। এর কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের কৃষকদের যে পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে তা কমাতে তারা রাজি নয়। অন্যদিকে দরিদ্র দেশগুলো তাদের কৃষকদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে যে ভর্তুকি দিচ্ছে তার বিরোধিতা করছে উন্নত দেশগুলো।

এসব কারণে আমরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। যেমন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা (আইটিও), ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি), ট্রান্স-আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ (টিটিআইপি), ট্রেড রিলেটেড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস (ট্রিপস) প্রভৃতি।

এসব এগ্রিমেন্ট বা চুক্তির সাথে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিঃসন্দেহে দুঃখজনক যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১২২টি দেশের জন্য জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হয়েছিল গত বছর। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো উপেক্ষিত। এরই মধ্যে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র গত বছর ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি বা ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর ফলে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিনা শুল্কে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারবে। এর অর্থ পরিষ্কার, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের যে চাহিদা রয়েছে, তা এখন দখল করে নেবে ভিয়েতনাম। তবে এক বছরে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি আমাদের পোশাকের বাজারে। যদিও শঙ্কা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায়। এমনিতেই বাংলাদেশি তৈরি পোশাকশিল্প প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন ও সেই সঙ্গে বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন অত্যন্ত শক্ত অবস্থানে গিয়েছিল, যা কিনা জিএসপি সুবিধা বাতিলের ব্যাপারে একটা ‘ভূমিকা’ রেখেছিল বলে ধরে নেওয়া হয়। যদিও এটা সত্য, প্রায় ১৬ শতাংশ (১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ) শুল্ক পরিশোধ করেই আমরা যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের বাজার সৃষ্টি করেছি।

এখন টিপিপি চুক্তির ফলে ভিয়েতনাম শুল্কমুক্তভাবে তাদের তৈরি পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যাবে। ফলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে। ইতিমধ্যেই চীনের পর ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বড় রপ্তানিকারক। বাংলাদেশকে লক্ষ্য করেও এখন টিপিপি চুক্তির কথা উঠছে। কিন্তু আমরা কতটা ভাবছি এই চুক্তির প্রভাব নিয়ে। জিএসপির বদলি হিসেবে টিপিপি কতটা কার্যকর হবে, সেটা ভাববার বিষয়।

যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুদিন ধরেই প্যাসিফিক অঞ্চলভুক্ত ১১টি দেশের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছে। এ আলোচনা এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। তবে এই টিপিপির বিরুদ্ধে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই একটি বড় বিরোধিতা রয়েছে। কিন্তু বিলিয়নিয়ার ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসায় আবার সব হিসাব উল্টে গেছে। এখন আমাদের সামনেও জিএসপি’র পরিবর্তে টিপিপি’র প্রস্তাব লোভনীয় মনে হতে পারে।

এরই মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতি পর্যালোচনা করার সময় এসে গেছে। আগামী বছরেই সংস্থার প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসবে। তারা বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতিসহ বিনিয়োগ পরিস্থিতি, মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি, শিল্পনীতি, শ্রমমান, মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ও সুশাসন ইত্যাদি বিষয়ও পর্যালোচনা করবে।  আমাদের সামনে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার হাতছানি। এই সময়ে আমরা কোনোভাবেই চাইবো না দূর্বল বাণিজ্য উপস্থাপন। আবার পরবর্তীতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সভাতেও আমরা গতবারের মতো এবারের সম্মেলনেও উন্নত দেশগুলোতে পণ্যের কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের দাবি করতে পারি। তাহলেও ঘুরে ফিরে টিপিপি’র বিষয়টি সামনে আসতে পারে।

কিন্তু টিপিপি চুক্তি বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, সে বিষয়ে কোনো সুষ্ঠু গবেষণা এখনো হয়নি। এখন জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল না হওয়ায় টিপিপি চুক্তিটিও আমাদের জন্য কোনো ‘বিষফোড়া’ হিসেবে সৃষ্টি হয় কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

লেখক : সাংবাদিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ জানুয়ারি ২০১৭/হাসান মাহামুদ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়