ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শুভ বিয়েবার্ষিকী

আমাদের যৌথ জীবন || পূরবী বসু

পূরবী বসু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমাদের যৌথ জীবন || পূরবী বসু

বিয়ের ছবি; নিচে বাঁ থেকে তৃতীয় পূরবী বসু, উপরে ডান থেকে দ্বিতীয় জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৭ সালের ২০ অগাস্ট, রোববার, তাদের ঢাকার বাসায়, ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডে। আর ১৯৬৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, রোববার, পরিচয়ের ঠিক ছয় সপ্তাহ পরে, আমাদের বিয়ে হয়, মুন্সীগঞ্জে আমাদের বাড়িতে। বিয়ের আগে চারবার তার সঙ্গে দেখা হয় আমার, ২০ অগাস্ট, ২৭ অগাস্ট, ৩০ অগাস্ট ও ৩ সেপ্টেম্বর। মাঝখানের এই ৩০ অগাস্ট অবশ্য দেখা হয়েছিল মাত্র এক বা দু’ মিনিটের জন্যে। সায়েন্স এনেক্স থেকে স্ট্যাটিস্টিক্সের ক্লাস করে জগন্নাথ হল আর ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাঝখানের কোনাকুনি রাস্তা ধরে হেঁটে রোকেয়া হলে ফিরছিলাম আমি। আর জ্যোতি তখনই রিকশা থেকে নেমে তাদের বাসার সামনের গেট খুলে ভেতরে ঢুকছিল। পড়ন্ত বিকেলে আমাকে বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে থামে সে। হাত তুলে থামায় আমাকেও। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মিনিট দু’এক কথা বলি আমরা। ঘরে গিয়ে এক কাপ চা খাবার আমন্ত্রণ জানায় জ্যোতি, যা কোনো এক অজুহাতে অনায়াসে পাশ কাটিয়ে যাই।

অপরিচিত সে মোটেও নয়, এ বাড়িতে ইতোমধ্যে দু’বার গেছি আমি, মধ্যাহ্ন ভোজনেও অংশগ্রহণ করেছি। তবু কেন জানি সেই বিকেলে বাড়ির ভেতরে যেতে দ্বিধা হয়। সঙ্গে দুলি নেই, ড. দেব ঘরে আছেন কিনা জানি না, ইত্যাদি কারণ মনে কাজ করেছিল কিনা বলতে পারব না। জ্যোতি জানায় সেই সন্ধ্যায় ব্রিটিশ কাউন্সিলে একটা বিদেশি ছবি দেখতে যাবার কথা ছিল তার, কিন্তু এখন ভাবছে আর যাবে না। রোকেয়া হলে আমার বিশেষ বন্ধু, দিনাজপুরের মেয়ে দুলি (জয়ন্তী সরকার; প্রাণিবিদ্যার ছাত্রী)। তার সঙ্গেই বাকি তিনবার, অর্থাৎ পরপর তিন রোববার, গেছি ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডের বাড়িতে। দুলির লোকাল গার্জিয়ান/গার্ডিয়ান ছিলেন দার্শনিক ড. গোবিন্দ দেব, যিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান। ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডের বাড়িটি, জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট হিসেবে ড. দেবের বাসস্থান। প্রফেসর দেব জ্যোতিকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। গত বেশ কয়েক বছর ধরে জ্যোতি এ বাড়িতেই থাকে। দুলি মাঝে মাঝেই আসতো এ বাসায় তার দাদু অর্থাৎ স্থানীয় অভিভাবকের সঙ্গে দেখা করতে। জীবন্ত কিংবদন্তি, ঋষিতুল্য মানুষ ড. দেবের প্রতি কৌতূহল ছিল আমার নিজেরও তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করবার বাসনা নিয়েই প্রথম সে বাড়িতে যাই দুলির সঙ্গে; ২০ অগাস্ট। বাড়ির সামনে লনের একপাশে বাঁধানো রাস্তাটির ওপর তখন ক্রমাগত পায়চারি করছিলেন ড. দেব। পরে জেনেছি, তাঁর বহুমূত্র রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে শরীরচর্চার অংশ হিসেবেই এই প্রাত্যহিক পায়চারি। এত শুনেছি যাঁর কথা, তাঁকে প্রথম সামনাসামনি ও স্বচক্ষে দেখছি। তাঁর সঙ্গে দুলি আমাকে আলাপ করিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমাদের বাসার ভেতরে নিয়ে যান। জ্যোতির সঙ্গে তিনি যখন আমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, প্রবল সর্দিতে আক্রান্ত জ্যোতি তখন টেবিলের ওপরের বিশাল এক গামলায় ফুটন্ত জল রেখে তোয়ালে দিয়ে পুরো মাথা ঢেকে চেয়ারে বসে মুখ নিচু করে স্টিম নিচ্ছে। তার নাম ধরে ডাকলে, মাথা থেকে তোয়ালে সরিয়ে ফোলা ফোলা লালচে নাক-চোখসহ পুরো মুখম-লটা বের করে আমাদের দিকে তাকায় জ্যোতি। আর সেই জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সঙ্গে জীবনে প্রথম সাক্ষাৎ আমার। পরিচয়ের পর আমার প্রথম প্রশ্নটিই ছিল, কুয়াশার লেখক ‘জ্যোতি প্রকাশ দত্ত’ তিনিই কি না? হেসে সম্মতি জানায় জ্যোতি, সেই সঙ্গে খানিকটা সংকোচও হয় বুঝি তার। উত্তীর্ণ কৈশোরের সেই অপরিণত রচনার জন্যেই কি? অথবা বিসর্গযুক্ত নামের জন্যে?

জ্যোতির নামে বিসর্গ ব্যবহারের পেছনের কাহিনি শুনেছি আরো পরে। ওর ছোট মামা ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবার সময় ‘জ্যোতি’ ও ‘প্রকাশ’-কে শুধু যে আলাদা করে লিখেছিলেন তা নয়, ‘‘জ্যোতি’-র পরে একটা বিসর্গও বসিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে উঠতি লেখক জ্যোতিঃপ্রকাশ যখন তার প্রথম ও মধ্যম নামকে জোড়া দিয়ে এক করে ফেললো, তখনো অনেকদিন মাঝখানে বিসর্গটা টেনে বেরিয়েছিল। ‘কুয়াশা’ ও ‘পরমাত্মীয়’-এর মাঝে কোনো এক সময় বিসর্গ ঝরে পড়েছে।

গল্পগুজব ও খাওয়া দাওয়ার পর শেষ অপরাহ্নে যখন দুলি ও আমি হলে ফিরে যাচ্ছি, তখন জ্যোতি আমাদের পরের রোববার দুপুরে তার নিজের হাতের রান্না খিচুড়ি খেতে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানালো, যেটা সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলাম আমরা। এভাবে পরপর দুই রোববার দেখা হবার পরই জ্যোতি আমি উভয়েই টের পাই, এটা নেহায়েত সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়। এর ঠিক পরেই, বুঝবার বিকেলে ৩০ অগাস্ট, এক-দু’ মিনিটের জন্যে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সেই বাক্যালাপ। তারপরে সেপ্টেম্বরের তিন তারিখে, অর্থাৎ আমাদের সাক্ষাতের চতুর্থদিনে, জ্যোতি আমাকে ও দুলিকে দুটি ছোট ছোট ফরাসি পারফিউম উপহার দেয়- ‘মাই সিন’ ও ‘মা গ্রিফ’ যেগুলোর নাম। সেই সঙ্গে জানায়, পড়াশোনা করার জন্যে বিদেশে চলে যাচ্ছে সে, আর মাত্র কয়েকটা দিন পরেই ৩০ সেপ্টেম্বরে। কিন্তু যাবার আগে সে নিশ্চয়তা পেতে চায় যে সে ফিরে আসা না পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব এবং আমার পরিবার অন্যত্র আমার বিয়ের ব্যবস্থা করবে না। অর্থাৎ আমার অভিভাবকদের কাছ থেকে একটা পাকা কথা চায় তারা। ড. দেব ও জ্যোতির ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হায়াৎ মামুদের একই মত। বোঝা গেল, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আঠারো বছরের একটি মেয়ের নিজস্ব ইচ্ছার শক্তি বা সামর্থ্য সম্পর্কে তাদের সকলেই মনে সন্দেহ রয়েছে। এই মুহূর্তে অভিভাবকদের যুক্ত করার ব্যাপারে আমার ভয়ানক আপত্তি ছিল, অন্য অনেক কিছুর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে কারণ সেটা হলো, আমার তিন বছরের বড় বোন আরতি, ইকোনমিক্সে স্টাফ ইয়ার এম.এ’র ছাত্রী, রোকেয়া হলে আমারই রুমমেট, তখনো অবিবাহিতা। কিন্তু জ্যোতি ও আমার ভাবি শ্বশুরের দুশ্চিন্তা মোচন করতে এবং তাঁদের বিশেষ অনুরোধে আমি সেই ছোড়দি অর্থাৎ আরতির মাধ্যমেই বাড়িতে কথাটা জানালাম। আমিও দিদির সঙ্গে গেলাম মুন্সীগঞ্জে। ঘটনাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মহা হুলস্থুল বেঁধে গেল চারদিকে। মনে হচ্ছিল সমস্ত বসুবাড়ি জুড়ে যেন প্রচণ্ড ঝড় বেয়ে গেছে। সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। কেননা, আমি বাড়ির সবচেয়ে ভালো ছাত্রী, কিছুদিন আগেই ফার্মেসিতে অনার্স শুরু করেছি। আমার অত্যন্ত আকর্ষণীয় বড় বোন সবে এম.এ-তে ভর্তি হয়েছে, যার একাধিক বিয়ের সম্বন্ধ বাবা সম্প্রতি নাকচ করে দিয়েছেন, পড়াশুনায় তার ব্যাঘাত ঘটবে বলে। এখুনি আমার বিয়ের প্রসঙ্গে কথাবার্তার জন্যে কেউ তাই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিল বাবা নিজে, আমার পড়াশুনা নিয়ে যাঁর অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা। এছাড়া সেসময়ে জ্যোতির জীবনযাপন সম্পর্কেও কিছু তথ্য হাজির করেছিলেন আমার মেজো জামাইবাবু যা জগন্নাথ হলের কোনো ছাত্রকে জিজ্ঞেস করে তিনি জেনেছিলেন। জ্যোতি মদ, সিগারেট, গরুর মাংস খায়, শুধু সেটাই নয়, শোনা যায়, সে বিগত বছরগুলোতে একাধিক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে আবার ভেঙ্গেও দিয়েছে। সব বিবেচনা করে এবং আমার মনোভাব জেনে জামাইবাবু ও অন্যান্য অভিভাবকদের মত হলো, সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনো কথা বা শর্তের মাঝে না গিয়ে ছেলে বিদেশে চলে যায় এবং সেখানে গিয়ে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে আসে। তারপরে বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবে। আর যদি পাকা কথা দিতেই হয়, বাগদান নয়, একেবারে বিয়ে হয়ে যাওয়াই শ্রেয়, কেননা, পাকা কথার পরে কে জানে সে যদি বিদেশে গিয়ে বিদেশি মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করতে শুরু করে! আর এখানে কিনা আমাদের মেয়ে তখন পথ চেয়ে বসে থাকবে!

জামাইবাবু বা অন্যরা যেটা বুঝতে পারছিলেন না, তাহলো, পাকা কথা নিয়ে চলে গিয়ে যা হতে পারে, বিয়ে করে গেলেও সেটা ঘটতে পারে, এবং বিয়ের পরে সেটা ঘটলে, ওটা হবে আরো বিপজ্জনক। তবে যাই হোক, পরবর্তীকালে দেখা গেছে, দৃষ্টির একাগ্রতা হারিয়ে কারো নজর যদি কখনো সখনো এদিক ওদিকে কিছুটা হেলে পড়ে থাকে বা অন্যত্র বিচ্ছুরিত হয়ে থাকে, সেটা ঘটেছে আমার বেলাতেই, জ্যোতির জন্যে তা কখনোই প্রযোজ্য হয়নি। বিয়ের আগে যতগুলো প্রেমই করে থাকুক না কেন, বায়ান্ন বছরের বিবাহিত জীবনে, আমি যতদূর জানি, একেবারের জন্যেও জ্যোতি অন্য নারীতে মনোসংযোগ করেনি। বরং প্রকৃত বন্ধুর মতো আমার হাত ধরে সে তার কাছে টেনে নিয়ে গেছে, আর একফোঁটা কটু কথা না বলে পরম মমতায় স্বস্থানে ফিরিয়ে এনেছে আমায়, যখন নিজের অজান্তে এবং অল্প সময়ের জন্যে একাধিকবার আমি বাইরের দিকে নজর দিয়েছিলাম, অলক্ষ্যে বন্ধুত্বের সীমানা অতিক্রম করতে বসেছিলাম। জ্যোতির মতো সংবেদনশীল, উদার, সহনশীল ও প্রকৃত আধুনিক একজন মানুষ চারপাশে কমই দেখি। এ কথাটা কখনো কানে কানে ফিস্‌ফিস্‌ করেও বলিনি তাকে, কিন্তু সেই অতি সত্য মন্তব্যটা আজ জনসম্মুখে প্রকাশ করতে আমার এতটুকু দ্বিধা বা সংকোচ নেই।

কোনোরকম মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া এমন তড়িঘড়ি করে বিয়ের আয়োজনে আমি ভীষণ মুষড়ে পড়ি। বড়বোনের আগে এভাবে হঠাৎ ও অতি দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করায় বারবার কেবল মনে হতে থাকে আমার, এটা যেন প্রচণ্ড এক অপরাধের জন্যে নির্মম ও গুরু শাস্তি। ফলে আনন্দের পরিবর্তে এই বিয়েকে কেন্দ্র করে কেবল মুন্সীগঞ্জের বাড়ির সকলের প্রতি নয়, জ্যোতি ও ভাবি শ্বশুরের প্রতিও আমার এক ধরনের গভীর ক্ষোভ ও অভিমান জমা হতে থাকে। এদিকে বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন আবার হলে ফিরে এলেও মূলত বাবার অনুরোধে এবং কিছুটা অভিমানবশত আমি জ্যোতির সঙ্গে আর দেখা করিনি। সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখের পর ওর সঙ্গে আমার দেখা হয় একবারে বিয়ের অনুষ্ঠানে। এই সময়ে বিয়ের ব্যাপারে আমার যে এতটা আপত্তি ছিল, জ্যোতির সেটা একেবারেই জানা ছিল না। সবশুনে বিয়ের রাতে জ্যোতি বলে, এটা যদি একবার তাকে জানাতাম আমি, তাহলে সে সময়ে বিয়ে কখনো সে হতে দিত না। আনন্দ করেছিল পুরো এক রাত, এক দিন।

 

 

বিয়ের পর প্রথম প্রথম জ্যোতি খুব চাইত আমি সুন্দর করে সাজি, ম্যাচ করে ভালো ভালো শাড়ি-ব্লাউজ পরি, চুলের যত্ন নেই, প্রসাধন সামগ্রী- বিশেষ করে ভালো সুগন্ধি ব্যবহার করি। এ ব্যাপারে, অত্যন্ত রুচিসম্পন্ন সাজগোজে অভ্যস্ত সুদর্শনা দেবী বৌদি (দ্বিজেনদার স্ত্রী) ছিল তার আদর্শ। কিন্তু কিছুকাল গেলেই ও বুঝতে পারল, মুন্সীগঞ্জের গাঁইয়া ভূতকে দিয়ে আর যাই হোক, সুন্দর করে সাজা বা ফিটফাট থাকা সম্ভব হবে না। মনে পড়ে, বিয়ের মাত্র কয়েকদিন পরেই ডায়াবেটিস হাসপাতালের ড. ইব্রাহিম এসেছিলেন আমাদের ৫, সেক্রেটারিয়েটের বাসায়, খুব সম্ভবত তাঁর কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে। দুপুরে খাবার নেমন্তন্ন ছিল তাঁদের। আমি তখন আমাদের পাচক মধুর সঙ্গে রান্না ঘরে গিয়ে রান্না করতে ব্যস্ত। শ্বশুর আর জ্যোতির ডাকে বাইরের ঘরে এসে দেখি, অতিথিরা সশরীরে এসে উপস্থিত। আমার শাড়িতে তখনো ছোপ ছোপ হলুদের দাগ। চুল এলোমেলো। মুখ ঘর্মাক্ত। শ্বশুরের আমন্ত্রণে মূলত আমাকে দেখতেই এসেছিলেন তারা, সেই সঙ্গে দুপুরের খাওয়া দাওয়া হবে, এই যা। ডা. ইব্রাহিম সেই দুপুরে আমাকে কাছে ডেকে খুব আন্তরিকভাবে একটা কথা বলেছিলেন, যা আজও ভুলতে পারিনি। তিনি বলেন, কেউ যখন এভাবে অন্য কারো বাড়িতে আসে, তারা শুধু ভালো খেতে আসে না, আরো কিছুও আশা করে সেই সঙ্গে। অতিথিরা যে এখানে প্রত্যাশিত ও স্বাগত, সেটা বোঝাবার জন্যে বাড়ির বাসিন্দাদের তাই অতিথি অভ্যর্থনা করবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হয়। কাপড়জামা পাল্টানো ও হাতমুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে বাইরের ঘরে অপেক্ষা করা তারই অংশ কেবল। কথাটা শুনে আমি নববধূ, মাড়হীন কুঁচকানো মলিন শাড়িতে আরো যেন মলিন ও লজ্জিত হয়ে উঠি জ্যোতি ও শ্বশুরের সামনে, যারা আমাকে বরাবর আমার মতো করেই চলতে দিয়েছেন।

১৯৭০ থেকে ১৯৯১ এই দুই দশক প্রায় একটানা বিদেশে ছিলাম আমরা। মাঝে মাঝে, যত ঘনঘন সম্ভব, দেশে বেড়াতে এসেছি। পড়াশোনা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফেরার জন্যে অনবরত চেষ্টা করেছি আমরা। তারই অংশ হিসেবে ১৯৮৭-১৯৮৮ সালে একবার দেশে ফিরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ নিয়ে থেকে যাবার চেষ্টা করেছিলাম। সফল হইনি। জ্যোতি, বাংলাদেশে প্রথম জার্নালিজমে পিএইচডি। আমেরিকায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। তা সত্ত্বেও সে ঢাকাতে একাধিকবার তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটা উপযুক্ত কাজ পেতে পেতেও শেষ পর্যন্ত পায়নি। এর ভেতর আমাদের দুজনেরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায়, আমার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ও আইসিডিডিআরবি-তে গবেষক পদে এবং জ্যোতির প্রেস ইনস্টিটিউটে পরিচালক পদে সম্ভাব্য নিয়োগের আশায় নিউ ইয়র্ক থেকে ঢাকা পর্যন্ত কয়েকবার যাতায়াত করেছি আমরা। নিজ খরচে ইন্টারভিউ পর্যন্ত দিয়েছি দু’জনেই। কিন্তু হতে হতে অজানা কারণে শেষপর্যন্ত আমাদের দুজনের একজনেরও বাঞ্ছিত সেই চাকরি কখনো হয়নি। তবে এক প্রাইভেট ওষুধের কোম্পানি ও এনজিওর বদান্যতায় অবশেষে আমরা নব্বই-এর দশকে দেশে ফিরে যাবার সুযোগ পেয়েছিলাম এবং নব্বই-দশকের একটা সিংহভাগ সময় ঢাকাতে কাটিয়েছি। দেশের বৃহত্তম দুটি এনজিওর মাধ্যমে পরিতৃপ্তির সঙ্গে কিছু ফলপ্রসূ কাজ করার সুযোগও পেয়েছি সেই সময়। তখন আমরা উভয়েই প্রচুর পরিমাণে লিখেছিও। নব্বই-এর দশকে যখন আমরা দেশে ছিলাম, তখনই আমাদের সবচেয়ে বেশি লেখা কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গ্রন্থও বেরিয়েছে। আর সেই সময়েই আমরা খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি, অনুভবে যতই কাছাকাছি থাকি না কেন, হৃদয়ে যতই বাংলাদেশ ধারণ করি না কেন, শারীরিকভাবে দেশ ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা ও দীর্ঘ প্রবাস জীবন, আমাদের বিশেষ করে জ্যোতির, সৃষ্টিশীলতার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলতে চাই। দীর্ঘ বিরতির পর জ্যোতি আবার যে লিখতে শুরু করেছিল ১৮৭/১৯৮৭ তে, তার পেছনে প্রধানত তিনটি বড় উদ্দীপনা কাজ করেছিল। ১) নিউ ইয়র্ক থেকে সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ্’র সম্পাদনায় প্রগতিশীল বাংলা কাগজে ‘প্রবাসী’র প্রকাশনা শুরু ও সেই কাগজের উপদেষ্টা হিসেবে জ্যোতির সম্পৃক্ততা; ২) জার্মানি থেকে বাহামা হয়ে নিউ ইয়র্কে কবি, গল্পকার ইকবাল হাসানের আগমন ও ‘প্রবাসী’ উপলক্ষ্য করে জ্যোতিকে আবার গল্প লেখায় ফিরিয়ে আনার জন্যে তার ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ; ৩) ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দেবার জন্যে বাড়িগাড়ি বিক্রি করে সপরিবারে আমাদের ঢাকায় ফেরা।

লেখার কথা যখন উঠলোই, একটা কথা বলতে দ্বিধা নেই। নিজের লেখালেখির ব্যাপারে জ্যোতির একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে, যেটা সহজে দৃশ্যমান নয়। তার লেখার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে বা আলোচনায় যেতে তার বড়ই কার্পণ্য। এই একটি বিষয়ে অত্যন্ত বেশি প্রাইভেসি রক্ষা করে সে। ওকে যদি লেখার জন্যে আমি আবদার করি, বা তাগাদা দিই, সে বেশ মনোক্ষুণ্ন হয়। পাঠক আর প্রকাশকের এখতিয়ারেই এটা পুরোপুরি রেখে দিতে চায় সে। নিজের লেখা (বিশেষ করে যে লেখা পরিকল্পনা বা নির্মাণের পর্যায়ে রয়েছে) নিয়ে আমার সঙ্গে তেমন আলাপ করে না, বা আমার লেখা নিয়েও বিশেষ কোনো কথা বলে না। নিয়মিত লেখালেখি করার অভ্যেস তার নেই, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কমই লেখে জ্যোতি। তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে হয়। কাগজ বা ম্যাগাজিন থেকে পুনঃপুন তাগাদা আসতে আসতে, যখন আর না দিলেই নয়, তখন একেবারে শেষ মুহূর্তে, এক রাতে, লিখতে বসে সে। সাধারণত একটি লেখা একবারে বসেই শেষ করে, যদিও চিন্তা করতে থাকে কয়েকদিন আগে থেকেই। লেখা শেষ হলে পাঠাবার আগে কোনো লেখা বা তার অংশবিশেষ কখনো আর দ্বিতীয় বার কপি করে না, বা পরিবর্তন করে না। কাটাকুটি অপেক্ষাকৃত কমই হয়। হাতের লেখাও সুন্দর ও স্পষ্ট। সবাই ঘুড়িয়ে পড়লে গভীর রাতে একটা টেবিলের সামনে গিয়ে বসে সাদা রুল টানা কাগজ টেনে লিখতে শুরু করে জ্যোতি। বিশেষ একধরনের রুল টানা কাগজ তার পছন্দ যার সমান্তরাল রেখাগুলো খুব কাছাকাছি নয়, আবার বেশিদূরেও নয় এবং সেই কাগজের প্যাডে কোনো মার্জিন বা মার্জিনে কোনো ফুটো থাকা চলবে না। হাতে লেখা রচনাই কাগজে পাঠাতো বরাবর।

আমার গল্প নিয়ে সমালোচনা বা কোনো মন্তব্য করা, অথবা কোনো ধরনের পরিবর্তনের পরামর্শ দেবার ব্যাপারে তার অনাগ্রহ বরাবর; বলে, সরাসরি পাঠকের কাছে ছেড়ে দাও। শুধু বানান দেখে দেয় সে, প্রয়োজনে সংশোধন করে। তবে বিয়ের পর আমার প্রথম যে গল্প আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছিল (একান্ত দর্পণ, ১৯৬৮), জ্যোতি সেই গল্পটি পছন্দ করেছিল এবং তখন আমাকে আমার মতো করে এভাবে সহজ করে গল্প লেখার জন্যে উৎসাহিত করেছিল। এছাড়া, পুনঃপুন অনুরোধে, আমার আর মাত্র দু’একটি গল্পের ব্যাপারে মন্তব্য করেছে জ্যোতি যা খুবই গঠনমূলক বলে আমি মনে করেছি। তবে, আমার অনেক গল্পের নামই জ্যোতির দেয়া। গল্পের শিরোনাম বাছাই বা স্থির করতে আমার বড়োই অসুবিধে হয় মাঝে মাঝে। আমার বেশ কয়েকটি গল্পের শিরোনাম দিয়েছেন লেখক আলম খোরশেদ, প্রাবন্ধিক শফি আহমেদ ও গল্পকার সাদ কামালী। জ্যোতি ও আমি দুজনেই যদিও মূলত ছোটগল্প লিখি, যারা আমাদের লেখার সঙ্গে পরিচিত তারা সকলেই জানেন, আমাদের লেখার ধরন একেবারেই দু’রকম। জ্যোতির লেখার শৈলী, ভাষা, চরিত্র নির্মাণ, দৃশ্য বা ঘটনার উপস্থাপনা ও বর্ণনা এতো আলাদা, এতো বিমূর্ত, এতো জটিল, আর আমার লেখা এতো সাদামাটা, গতানুগতিক, যে আমার ধারণা, যা জ্যোতি তীব্রভাবে অস্বীকার করে, আমার সৃষ্টিশীল লেখার ব্যাপারে ওর একটা প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য রয়েছে, যদিও আমাকে লিখতে সবসময়েই সে উৎসাহ দেয়, বই প্রকাশ করার ব্যাপারেও সাহায্য করে, তাগাদা দেয়। তবে স্পষ্ট করে না বললেও আমি বুঝি, আমার নারী সংক্রান্ত নিবন্ধ বা বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার ব্যাপারে জ্যোতির যে আগ্রহ বা উৎসাহ-উদ্দীপনা, আমার গল্পের ব্যাপারে সেটা নেই। আমি তার জন্যে তাকে দোষ দিই না। জ্যোতির মতো একজন বিশিষ্ট গল্পকার যে নিজেই ছোটগল্পের জন্যে একটা নিজস্ব ভাষা নির্মাণ করেছে, একেবারে নতুন আঙ্গিকে গল্প লেখা শুরু করেছে আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে থেকে, তার পক্ষে একশ বছরের পুরোনো স্টাইলে লেখা গতানুগতিক এসব গল্প পড়তে বিরক্তি লাগতেই পারে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ও প্রবলভাবে বিশ্বাস করি, অতি সাধারণভাবে, বিনা আড়ালে, সাদামাটা উপস্থাপনায়, একেবারে সহজ ও সুবোধ্য ভাষায়ও উন্নতমানের গল্প লেখা সম্ভব, আমি নিজে তা লিখতে অসমর্থ হলেও।

জ্যোতি মুখে কখনো কিছু বলে না, কিন্তু বুঝি ওর মনের খুব গভীরে একটা প্রচণ্ড অভিমান, একটা ভয়ানক কষ্ট আছে, এতদিনেও তার লেখার যথেষ্ট মূল্যায়ন হলো না বলে। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি, অগতানুগতিক ও জটিল মনস্তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক গল্পের পাঠকের সংখ্যা সবসময়েই সীমিত থাকে। তবে যাঁরা তার গল্পের প্রকৃত অনুরাগী, তাঁরা প্রায় সকলেই বিদগ্ধ পাঠক ও একনিষ্ঠ ভক্ত। আরো বলি, জনপ্রিয় হতে চাইলে এই ধরনের ভাষা, শৈলী বা আঙ্গিক সে বেছে নিত না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এটাও মনে করি, কোনো পাঠকই নিজেকে গৌণ ভাবতে চায় না। কোনো লেখকের লেখা পড়ে যদি পাঠক ধরতে না পারে, বুঝতে না পারে, গোলক ধাঁধায় পড়ে যায়, লেখা পড়তে যতই ভালো লাগুক, এবং পড়ে যতই নিশ্চিত হোক এটা একধরনের উঁচু মাপের লেখা, কিন্তু আধুনিক অনেক কবিতার মতো শেষপর্যন্ত যদি ঠিক বুঝতে না পারে লেখক কী বলছেন, পাঠশেষে তখন কিন্তু সেই লেখককে অনিবার্যভাবেই প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ পাঠক। কেননা লেখকের মতো প্রতিটি পাঠকেরও নিজস্ব একটা অহংকার আছে এবং সে অহংকার বা গর্ব থেকে সে নিজেকে কখনোই বোকা, কমবোদ্ধা বা গৌণ ভাবতে রাজি নয়।

জ্যোতি সংসারি, আবার একই সঙ্গে অসংসারীও। বাইরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া সে যতই পছন্দ করুক না কেন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যাকে ফেলে রেখে বা তাদের অবহেলা করে সেটা কখনো করেনি। বেহিসেবীও সে কখনও নয়, কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে দু’ হাতে খরচ করতে মোটেও পিছপা হয় না। যেমন, গাড়িতে দূর-দূরান্তে বেড়ানো, প্লেন ভাড়া, হোটেলে থাকা, ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়া ইত্যাদি। অন্ধকার বা স্যাঁতসেতে ঘরবাড়ি একেবারে সইতে পারে না জ্যোতি। সে চায় বাড়িতে আলো বাতাস সবসময় খেলা করবে। রাতেও ঘরবাড়ি আলোয় উজ্জ্বল করে রাখতে চায় সে। যে ঘরে কেউ নেই সেখানেও পারলে সবসময় আলো জ্বালিয়ে রাখে। প্রতিটি বাতি আমি একবার নেভাই, সে জ্বালায়। সুন্দর করে গুছিয়ে থাকতে ভালোবাসে জ্যোতি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে বড়োই অগোছালো। দিনের পর দিন মেঝেতে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা কাগজ বা কাপড় আমার কাছে মোটেও অসহনীয় মনে হয় না, গায়ে জ্বালা ধরায় না। এটা জ্যোতির একটা বড় মনোবেদনার কারণ।  তবে রান্নাঘর ও বাথরুম যদি নোংরা থাকে, আমি কিন্তু অস্থির হয়ে উঠি, জ্যোতির আবার তাতে তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না। টিপটপ সুন্দর করে থাকতে অভ্যস্ত জ্যোতি কেবল একরাতের জন্যে কোনো হোটেলে উঠলেও সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রুমটিকে নিজের পছন্দমত করে তোলে।

 

 

আমাকে দেবার জন্যে উপহার নির্বাচনের বেলায় নিজের পছন্দ, সমাজের প্রচলিত ধারা, শোভনতাবোধ অথবা গতানুগতিক প্রত্যাশাকেই বেশি প্রাধান্য দেয় সে, আমি আসলে কী চাই, তার বদলে। যার জন্যে, জন্মদিনে, বিবাহবার্ষিকীতে, মাদার্স ডেতে ফুল, গয়না, শাড়ি, পারফিউম, বা চকোলেট, এবং কার্ড আনতে ভোলে না জ্যোতি। আমি বহুবার বহুভাবে বলেছি, ছোটখাটো উপকরণ, একটা তরতাজা গাছ, চানাচুর বা বাদাম বেড়ে দেবার জন্যে কোনো সুন্দর পাত্র, প্রিয় গানের কোনো সিডি কিংবা পছন্দের ছায়াছবির একটি ডিভিডি যদি নিয়ে আসতো, তাহলে আমি বেশি খুশি হতাম। সুতি শাড়ি, বিশেষত তাঁতের শাড়ি, পরতে খুব ভালো লাগে আমার, কিন্তু জ্যোতির পছন্দ সিল্কের শাড়ি, এবং বরাবর তার পছন্দমত ভালো ভালো সিল্কের শাড়িই কিনে এনে দেয় আমাকে। ফলের মধ্যে আমার বিশেষ প্রিয় তাল-শাঁস, কালো জাম, কামরাঙা, কিন্তু এর কোনোটাই প্রকৃত ফলের আওতাতেই পড়ে না জ্যোতির বিচারে। তাই গরমকালে, ভালো ভালো আম, লিচু, পেঁপে ঘরে আসবে, কিন্তু আমার ওইসব অদ্ভুত ভালোলাগার জিনিসগুলো তার হাতে উঠবে না কখনো। সাদা ও কালো রং-এর শাড়ি আমার বিশেষ পছন্দের, কিন্তু পোষাকের জন্যে এ দুটি রং-ই জ্যোতি অপছন্দ করে, এবং কখনো আমার জন্যে সাদা বা কালো শাড়ি কেনে না সে। আমার বিয়েতে জ্যোতি যে বেনারসি দিয়েছিল তার রং লাল বা খয়েরি ছিল না, ছিল রুপোলি-ছাই। বায়ান্ন বছর আগে বিয়েতে এরকম রং-এর বেনারসি আর কেউ তার স্ত্রীকে দিয়েছে কিনা জানি না, তবে সেটি আমার খুবই পছন্দ হয়েছিল, সন্দেহ নেই। এবং সেটা আজও রয়েছে সযত্নে।

শিশুকালে মাতৃবিয়োগ, পিতার কর্মহীনতা, কঠিন দারিদ্র্য, অবহেলিত বাল্যকাল, ভগ্নগৃহ, দেশভাগ, ক্রমাগত জীবনযুদ্ধ- তার অতীত জীবনের এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে রোমান্টিকতা বা সহানুভূতি উদ্রেকের কোনো সুযোগ দেয় না জ্যোতি, কোনোভাবে মহিমান্বিতও করে না নিজেকে। প্রাত্যহিক কথা বার্তায় কখনো এসব প্রসঙ্গে উঠে আসে না। কিন্তু এ সম্পর্কে আবার কোনো হীনম্মন্যতাও নেই তার, নেই কারো প্রতি কোনো ক্রোধ, অভিযোগ অথবা ঘৃণা। বাল্যকালের এসব অভিজ্ঞতার কথা যেমন বলে বেড়ায় না সে, কোনোরকম রাখঢাকের চেষ্টাও করে না। রাজহাঁসের মতো পাঁকে থেকেও মাথা আর কণ্ঠ উঁচু করে রাখতে জানে সে, কাদা তাকে স্পর্শ করতে পারে না, সব ঝেড়ে ফেলে কালিমামুক্ত হতে শিখেছে। জ্যোতি ছাড়া এই উপমাটা আমি আরেকজন সম্পর্কেই কেবল দিয়েছিলাম একবার। নির্মলেন্দু গুণের সম্পর্কে তসলিমা নাসরীনকে একদিন বলেছিলাম কথাটা, যা তসলিমা তার বইতে গুণ সম্পর্কে নিজেই উদ্ধৃত করে দিয়েছে। ভাবতে বড় অবাক লাগে জ্যোতি যেভাবে বড় হয়েছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ যখন পেলো সে, তখন অর্থ রোজগারের বাসনা নিয়ে অন্য কোনো বিষয় না পড়ে বাংলা সাহিত্যে অনার্স কেমন করে পড়তে এলো, কেমন করেই বা এমন কঠিন সুবাতাসহীন শিশুকাল, কৈশোর আর প্রথম যৌবন কাটাবার পরও সাহিত্য, শিল্প, সংগীতের প্রতি এমন দুর্বার আগ্রহ ও আকর্ষণ বজায় রাখল, সৃষ্টিশীলতা অটুট রইলো, নান্দনিক অভিব্যক্তি একটু হারালো না, হাসিখুশি ও কৌতুকবোধ অক্ষুণ্ন থাকলো! এতরকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়া সত্বেও জ্যোতি মানবিক গুণাবলিও কিছু হারায়নি, যা হারানো খুব স্বাভাবিক ছিল তার পক্ষে। মনস্তত্ত্ববিদরা কী বলবেন জানি না, তবে আপাতদৃষ্টিতে তার চরিত্রে স্থায়ী কোনো ক্ষতের বা ঘাটতির সন্ধান পাওয়া যায় না, এ বড় বিস্ময়ের ব্যাপার। বরং ক্রমাগত আগুনে পুড়ে পুড়ে আরো যেন শুদ্ধ ও খাঁটি হয়েছে সে। আমার জানা ও দেখা অন্যান্য অনেকের চাইতে উন্নততর মানুষ সে। তার সত্যবাদিতা, সততা, বিনয়, ভণিতাহীনতা এবং সহমর্মিতা ঈর্ষণীয়। এসব গুণাবলি বিকশিত হতে আমার ধারণা তার প্রাগযৌবনে বাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগেরও একটা মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। বাংলায় এমএ পাস করলেও পরবর্তীকালে মাস কমিউনিকেশনসে মাস্টার্স ও জার্নালিজম-এ পিএইচডি করে আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর জার্নালিজম ও ইংরেজি পড়িয়েছে জ্যোতি। ম্যানহাটনে পৃথিবী জোড়া নামকরা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছে। এসব দুঃসাধ্য অর্জনের কথা যখন ভাবি, মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। মনে প্রাণে প্রকৃত আধুনিক, বন্ধুবৎসল জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের দেশের প্রতি গভীর টান, অসাম্প্রদায়িকতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি তার প্রতি আমার আগ্রহ ও মমত্বকে দিনের পর দিন আরো পরিণত, আরো সুগঠিত করেছে।

বায়ান্ন বছর তো কম কথা নয়! জীবনের অনেকটা চড়াই-উতড়াই পথই আমরা হেঁটে এসেছি একসঙ্গে। সেই কোন ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিল। বলতে গেলে জ্যোতির সঙ্গেই বেড়ে উঠেছি আমি। আমাদের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন আশেপাশের আর দশটা জীবনের মতোই ভালোমন্দে, হাসি-কান্নায়, দ্বন্দ্বে-ছন্দে মেশানো। রূপকাহিনির একটানা সুখের বা সাফল্যের গাথা এটা নয়, হয়তো কারো বেলাতেই সেটা ঘটে না। আজ অতীতের দিকে তাকালে অনেক নির্মল আনন্দ, ভালোলাগা ও সমঝোতার কথা যেমন মনে পড়ে, তেমনি মনে পড়ে অনেক সমস্যা-বিপদ-সঙ্কট-ঝড়-বন্যা-যুদ্ধ-রোগ-শোক-মৃত্যুকে যৌথভাবে মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতার কথা। এত কিছু এত দীর্ঘকাল যাবৎ আমরা একত্রে পার করেছি যে জ্যোতি আর আমি আজ পরস্পরের কাছে যেন আমাদের নিজস্ব হাত, পা, নাক, কান বা শরীরের অন্য কোনো বাহ্যিক অঙ্গের মতোই পুরোপুরি পরিচিত ও মুখস্থ হয়ে গেছি। নিখুঁত নয় কোনোমতেই; কিন্তু চেনা, আপন, এবং নিঃসন্দেহে আরামদায়ক ও নিঃশর্ত, নিরাপদ এক আশ্রয়। এসব সত্ত্বেও প্রাত্যহিক জীবনে প্রচুর ঝগড়া, তর্ক করেছি আমরা, এখনো করি। আমি বিশ্বাস করি, দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যাদের স্বাধীনভাবে ও মৌলিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে, যদি পাশাপাশি একত্রে বসবাস করে, তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিতণ্ডা হবেই। এবং সেটাই স্বাভাবিক। এর অনুপস্থিতি অসমত দুজন মানুষের একত্রে বসবাসের ইঙ্গিত দেয়, অথবা একজনের অবদমন কিংবা উভয়ের অসংবেদনশীলতার কথাই স্মরণ করায়।

নির্বিবাদী, শান্তিপ্রিয়, শহুরে, ভদ্রলোক জ্যোতি কখনো কারো সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যেতে চায় না, এমনকি তার জন্যে যদি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় পাশ কাটিয়ে যেতে হয়, তবুও নয়। নরম, মধুর, বিনীত ও মার্জিত ব্যবহার, উচ্চস্বরে কথা না-বলা, কারো প্রতি বিরোধ বা বিরাগ পুষে না-রাখা, প্রতিশোধে বিশ্বাস না-করা, সহনশীলতা ও ধৈর্য বজায় রাখা এবং মান-অপমানবোধ বা রাগ-অভিমানের ব্যাপারে অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা পরিহার করে চলা জ্যোতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

যে পাঁচ-ছয়টি উপকরণ সাধারণত বিবাহিত জীবন ভেঙে পড়বার জন্যে বিশেষভাবে দায়ী থাকে, যেমন দীর্ঘ বিরহ, তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব, শ্বশুরবাড়ির সমস্যার অনুপ্রবেশ, সন্তান লালনপালনের সময়টাতে স্বামী-স্ত্রীর দুজনেরই নিজস্ব কেরিয়ার গঠনের তৎপরতা, দীর্ঘ প্রবাস জীবন, আর্থিক টানাটানি, এসবই কিন্তু ছিল আমাদের জীবনে, কোনো না কোনো সময়। কিন্তু আমার মনে হয়, এই বিপরীত বা বিরুদ্ধ শক্তিগুলো নেতিবাচক নয়, প্রকারান্তরে এবং এক অদ্ভূত-আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের বিবাহিত জীবনকে আরো মজবুত করতেই সাহায্য করেছে।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়